ক্রিকেট মানেই অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে মোড়া একটা আদ্যপান্ত রোমাঞ্চকর খেলা। প্রতি মুহূর্তে ক্রিকেটের চিত্রনাট্য বদলে যেতে পারে, আর সেই অনিশ্চয়তাই হয় তো ক্রিকেটকে এত আকর্ষণীয় করে তোলে। ফুটবল থাকলেও ভারতবর্ষে ক্রিকেটের আবেগ, উন্মাদনার কাছে তা আসে না। নিঃসন্দেহেই ক্রিকেট হল ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা।
বিভিন্ন নিয়ম কানুন যা ক্রিকেটের আকর্ষণকে আরো বাড়িয়ে তোলে, তার মধ্যে অন্যতম হল ওয়াইড বল। ব্যাটসম্যানের চারপাশে একটি নির্দিষ্ট সীমানা দাগ কেটে বোঝানো থাকে বাইশ গজের দুই ধারে। এই সীমানার মধ্যেই বল ফেলতে হয় বোলারকে। যদি কোনো বোলার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দাগের বাইরে বল ফেলেন, তবে সেই বল ক্রিকেটের নিয়ম বিরুদ্ধ হিসেবে গণ্য হয়। সেই বলকে অ্যাম্পায়ার দু হাত ছড়িয়ে ওয়াইড বলের ইঙ্গিত দেন।
ওয়াইড বল করলে বোলারের সেই বলটি বাতিল হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে ওই নিয়ম বিরুদ্ধ বলের জন্য উপরি হিসেবে ব্যাটিং দলের খাতায় যোগ হয় একটি অতিরিক্ত রান। ফলে ওয়াইড বল করা যে কোনো বোলারেরই কাম্য নয়, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তবু ক্রিকেটে আকছার দেখা যায় অ্যাম্পায়ার দু হাত ছড়িয়ে ইশারায় ওয়াইড বলের কথা জানাচ্ছেন। বোলারদের এই নিয়ন্ত্রণহীনতা ক্রিকেটের একটি অঙ্গ।
ওয়াইড বল তো হয় আকছারই, কিন্তু এমন বোলার কি আছেন যিনি কখনো একবারের জন্যেও ওয়াইড বল করেন নি? ভাবতে অবাক লাগলেও এমন বোলার সত্যিই আছেন। নিজেদের নিষ্ঠার সঙ্গে কখনো তাঁদের আপোষ করতে দেখা যায় নি। কখনো নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে বল পড়ে নি তাঁদের হাত থেকে। আসুন আজ দেখে নেওয়া যাক তেমন ১০ জন বোলারের কথা যাঁরা কখনো ওয়াইড বল করেননি।
১) রিচার্ড হ্যাডলি:
নিউজিল্যান্ডের কিংবদন্তি খেলোয়াড় রিচার্ড হ্যাডলির কথা সবারই জানা। ৯০-এর দশকে বল হাতে বাইশ গজ মাতিয়ে রাখতেন তিনি। শোনা যায়, তাঁর বলের সামনে তাবড় তাবড় ব্যাটসম্যানেরও রীতিমতো পা কাঁপত। তিনি নিউজিল্যান্ডের জার্সি গায়ে খেলেছেন প্রায় ১৭ বছর। ডানহাতি ফাস্ট বোলার রিচার্ড হ্যাডলি তাঁর ১৭ বছরের দীর্ঘ কেরিয়ারে কখনো ওয়াইড বল করেননি।
২) ল্যান্স গিবস:
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ল্যান্স গিবসকে বিশ্বের সর্বকালের সেরা স্পিনারদের মধ্যে অন্যতম ধরা হয়। ল্যান্স গিবসের ইকোনমি রেট বা বোলিং গড়ের দিকে চোখ দিলে চমকে যেতে হয়। পৃথিবীতে যে হাতে গোনা কয়েকজন বোলারের বোলিং গড় ওভার প্রতি ২ রানেরও নীচে ল্যান্স গিবস তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ওয়েস্ট ইন্ডিজের জার্সিতে তিনি মোট ৭৯টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। কিন্তু বাইশ গজের দৌড়ে তিনি সম্পূর্ণ কেরিয়ারে কখনো একটিও ওয়াইড বা নো বল করেননি।
৩) ক্ল্যারি গ্রিমেট:
নিউজিল্যান্ডে জন্ম হলেও ক্ল্যারি গ্রিমেট আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে। নিজের সময়ে তিনি অস্ট্রেলিয়ার একজন সেরা স্পিনার হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। ক্ল্যারি গ্রিমেট তাঁর লেগ স্পিনে যে নতুন বৈচিত্র্য এনেছিলেন তার মাধ্যমে তিনি বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদেরকেও বিপদে ফেলতেন অনায়াসে। নিজের কেরিয়ারে মোট ৩৭টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন ক্ল্যারি গ্রিমেট। কিন্তু একটিও ওয়াইড বল তাঁর পরিসংখ্যানে নেই।
৪) ডেরেক আন্ডারউড:
ইংল্যান্ডের অন্যতম কিংবদন্তি বোলার হলেন ডেরেক আন্ডারউড। প্রাথমিক ভাবে তিনি ছিলেন স্লো লেফট আর্ম অর্থডক্স স্পিনার, তবে মিডিয়াম পেসেও কখনো কখনো বল ছুঁড়তে দেখা যেত তাঁকে। বৃষ্টি ভেজা আবহাওয়ায় বেশিরভাগ সময়ই ডেরেক আন্ডারউডের বলে ব্যাট ছোঁয়াতে পারতেন না খেলোয়াড়রা। ধারাবাহিক ভাবে নিখুঁত বল করতেন তিনি, ফলে কেরিয়ারে একবারের জন্যেও ওয়াইড বা নো বলের মাধ্যমে অতিরিক্ত রান দেন নি ডেরেক আন্ডারউড।
৫) গ্যারি সোবার্স:
৯০-এর দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল বিশ্ব ক্রিকেটে একাই রাজত্ব করত। যে সমস্ত কিংবদন্তি তারকার জন্ম দিয়েছিল সেদিনের ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন গ্যারি সোবার্স। প্রায় দুই দশক ধরে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের অন্যতম ভরসা গ্যারি সোবার্সকে বিশ্বের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারও বলা হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মোট ২০৬৬০টি বল করেছেন তিনি। বলা বাহুল্য, তার মধ্যে একটা বলও নির্দিষ্ট সীমার বাইরে পড়ে নি।
৬) ক্রিকেট: ইমরান খান:
ইমরান খানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এখন চেনে গোটা বিশ্ব। কিন্তু তিনি যে রাজনীতির আগে বল হাতে বাইশ গজের মাঠ কাঁপাতেন তা কিন্তু ভুলে যাওয়ার উপায় নেই একেবারেই। ১৯৮২ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্বের ভার গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৮৭তে পাকিস্তানের ঘরের মাঠে ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম ঐতিহাসিক জয়ের কান্ডারি ছিলেন ইমরান খানই। এছাড়া ১৯৯২-এর বিশ্বকাপ জয়ের পিছনেও ইমরান খানের অবদান অনস্বীকার্য। জীবনে কখনো ওয়াইড বল করেন নি পাকিস্তানের এই খেলোয়াড়ও।
৭) : ইয়ান বোথাম:
ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের মধ্যে অন্যতম ইংল্যান্ডের ইয়ান বোথাম। ইয়ান বোথাম একমাত্র খেলোয়াড় যিনি এক টেস্ট ম্যাচে ব্যাট হাতে সেঞ্চুরি এবং বল হাতে ১০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড গড়েছেন। ১৬ বছরের কেরিয়ারে একটিও ওয়াইড বল করেননি ইয়ান বোথাম।
৮) : ডেনিস লিলি:
অস্ট্রেলিয়ার ডেনিস লিলিও নিজের অসাধারণ ক্রিকেটীয় প্রতিভার মাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছেন এই তালিকায়। ১৯৭০-৮০ নাগাদ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলের অন্যতম ভরসা ছিলেন ডেনিস লিলি। বল হাতে রীতিমতো আগুন ঝরাতেন তিনি। ১৩ বছরের কেরিয়ারে ৭০টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন তিনি, একটিও ওয়াইড বল করেন নি।
৯) বব উইলিস:
১৯৭১ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের বোলিং আক্রমণকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বব উইলিস। বর্তমানে বব উইলিস ইংল্যান্ডের চতুর্থ সর্বোচ্চ উইকেট গ্রাহক। ৯০ টি টেস্টে তিনি ৩২৫টি উইকেট নিয়েছেন। কিন্তু ওয়াইড বল করেননি একটাও।
১০) ফ্রেড ট্রুম্যান:
সবশেষে যার কথা না বললেই নয় তিনি হলেন ইংল্যান্ডের আরেক অপ্রতিরোধ্য বোলার ফ্রেড ট্রুম্যান। ১৯৪৮ সাল থেকে প্রায় দুই দশক ধরে ইংল্যান্ডের ক্রিকেটে রাজ করেছেন ফ্রেড ট্রুম্যান। তিনি ৬৭টি টেস্ট ম্যাচে ৩০৭টি উইকেট নিয়েছেন, ওয়াইড বল করেন নি একটাও।
বিশ্বের এই সর্বকালের সেরা বোলারদের প্রতিভার কথা শুনলে নিঃসন্দেহে অবাক হয়ে যেতে হয়। সেই সঙ্গে অনিবার্য ভাবে বর্তমান বোলারদের সঙ্গে তুলনাটাও চলে আসে। বর্তমানে এই অবিশ্বাস্য রেকর্ড সৃষ্টি করা বোলার নিতান্তই ব্রাত্য।