জানেন কি মানসিক সমস্যায় আয়ুর্বেদ কতটা উপকরী? মনের রোগ নিরাময়ে প্রাচীন এই চিকিৎসা পদ্ধতি কতটা কার্যকরী?
একবিংশ শতাব্দীর মতো দ্রুত গতির জীবনে মানুষ আজ বড়ো একা, নানা সমস্যায় জর্জরিত। সমস্যার নানা ধরনের মধ্যে মানসিক সমস্যা হল অন্যতম। আজকের যুগের প্রতিটি ব্যাক্তিই কম বেশি মানসিক সমস্যাগ্রস্ত। মনের সমস্যা আমরা সেভাবে বুঝতে পারিনা বলেই সারা বিশ্ব জুড়ে আজ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
স্ট্যাটিস্টিক অনুযায়ী সারা বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে ১ জন মানুষ মানসিক সমস্যার দরুন আত্মহত্যা করেন। https://www.who.int/news/item/09-09-2019-suicide-one-person-dies-every-40-seconds ওয়ার্ল্ড মেন্টাল হেল্থ ডে এর দিন (১০ই অক্টোবর), ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ মেন্টাল হেল্থ, ইন্টারন্যাশানাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন, ইউনাইটেড ফর গ্লোবাল হেল্থ সংস্থার মিলে করা একটি সার্ভেতে এই তথ্য উঠে আসে।
যে কোনও অসুখের ক্ষেত্রেই যদি অসুখের লক্ষণ চেনা না যায় তবে তার নিরাময়ের উপায়ও সন্ধান করা হয় না। মনকে বাইরে থেকে দেখা যায় না তাই তার অসুখের লক্ষণও আমরা সচরাচর বুঝতে পারিনা। মনকে নিয়ে আলাদা করে ভাববার সময়ও বোধকরি আজকের দিনে আমাদের কাছে নেই। তার সমস্যাগুলো জমতে জমতে যখন পাহাড় প্রমাণ হয়ে যায় তখন শারীরিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো আমাদের জানান দেয় মনের ঘরেও সব ঠিক নেই।
মানসিক কোনও সমস্যা ঘটলে আমরা সাধারণত চিকিৎসার সাহায্যের কথা ভাবিনা। মনের আসুখ মানে আমরা তাকে পাগল আখ্যা দিয়ে ব্রাত্য করে দেই চারপাশের সকলের থেকে। ব্যাক্তির মনের সমস্যা অতলেই থেকে যায়। চিকিৎসার নানা ধরনের মধ্যে আয়ুর্বেদকে আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। প্রাথমিকভাবে আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মাধ্যমে আমরা উপশম করতে পারি অনেক জটিল সমস্যারই। মানসিক সমস্যাও তার ব্যতিক্রম নয়।
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3705701/ এই ভারতীয় জার্নাল অনুসারে মানসিক সমস্যায় আয়ুর্বেদ কতটা কার্যকারী হতে পারে তার কয়েকটি রূপ এখানে পর্যালোচনা যাক। অন্যান্য শারীরিক সমস্যার উপশমের মতোই আয়ুর্বেদও রোগ নিরাময়ে “দশা” ও “গুণ” এর অসামঞ্জস্যতাকে যুক্ত করে। ভাবনা — দৃষ্টিভঙ্গি — অনুভূতি — অভিমত — চিন্তা সব কিছুই সমাধানের পথের কান্ডারী।
মানসিক সমস্যার দশার উপর নির্ভর করে তার উপশমের ধরণ নির্ধারণ করা হয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শাস্ত্রে। দশা মোটামুটি তিন প্রকার —
ভাটা – মানুষ যখন খুব অস্থির ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়। (A Vata mind will react quickly, impulsively, be hyper-sensitive and easily agitated and instable. A Vata mind can quickly be driven into fear, anxiety, compulsive thinking and uncontrollable pessimistic thinking.)
পিত্ত – মানুষ আগ্রাসী হয়ে যখন অন্যকে দোষারোপ করে এবং একটুতেই রেগে যায়। (A Pitta mind will tend to get easily frustrated, agitated and angry. There could be a tendency for confrontation, blaming, criticising, aggression and even narcissism. Deep down these displays may be triggered by insecurity and perceived loss of control.)
কপা – এই দশায় মানুষ ডিপ্রেশনের চরম সীমায় থাকে। অত্যধিক ঘুম, আবেশজনক ব্যবহার এর প্রধান লক্ষণ। (A Kapha mind can tend to become heavy, clouded and dull, and veers towards indulgent and obsessive behavioursm excessive sleep, insensitivity, interia and depression.)
উপশমের জন্য যে তিনটি পদ্ধতি সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেগুলি হল –
যোগআসন –
আয়ুর্বেদের অন্যতম পদ্ধতি হল যোগাসন, যোগব্যায়াম, ধ্যান বা মেডিটেশন। এর মাধ্যমে ব্যাক্তির চেতন অঙ্গগুলির উদ্বেগ নিরসন করে থাকে। যে ব্যাক্তি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত যোগাসনের ফলে তার স্নায়ুগুলো ধীরে ধীরে উত্তেজনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
পাচন প্রক্রিয়া –
মন দেহের বাইরে নয়। মনকে ভালো রাখতে সুস্বাদু, পুষ্টিকর, হজমে সহায়ক খাবার প্রয়োজন। সঙ্গে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী অশ্বগন্ধা (ashwagandha), ব্রাহ্মী (brahmi), মান্দুকাপর্ণী (mandukaparn)i, ভাচ (vacha), তাগারা (tagara), বালা (bala), শতাবরী (shatavari), জায়ফল (nutmeg), পুদিনা (mint) খাদ্য তালিকায় থাকলে তা মানসিক ভারসাম্য বজায়ের ক্ষেত্রে ফলপ্রদ।
মন্ত্রোচ্চারণ –
ধ্যান, যোগাসন মস্তিষ্কের স্থিতি স্থাপকতা ফিরিয়ে আনলেও তাকে গভীরভাবে কার্যোপযোগী করে হোম, মন্ত্র উচ্চারণের দ্বারা করা আসন। এতে ব্যাক্তির আধ্যাত্মিক বিশ্বাস উৎসারিত হওয়ার পাশাপাশি এক প্রকার পজিটিভ এনার্জিও তৈরি হয় যা সমস্যার উপশমে আভ্যন্তরীণ অনুরণন জাগায়।
মানসিক সমস্যার এই দশা “ডিপ্রেশনে” এখন বাচ্চা থেকে বয়স্ক সকলেই আক্রান্ত্র। আমাদের জীবনযাপন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, রোজগারের অনিশ্চয়তা, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের অধঃপতন “ডিপ্রেশন” নামাক কাঁটাকে আরও তীক্ষ্ণ করে তুলেছে। এই সমস্যার থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা নিঃসন্দেহে কার্যকারীতার দাবী রাখে।
ভারতবর্ষের এই প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি এখনকার যুগে অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথির সাথে পাল্লায় একটু প্রচারবিমুখ হয়ে পড়লেও সম্পূর্ণ ম্লান হয়ে যায়নি। আয়ুর্বেদের হাত ধরেই আবার সেরে উঠেছেন বহু মানুষ। বিশ্বাস না হারিয়ে নিয়ম মেনে মনের ভালো থাকার উপায় খোঁজা যাক। মানসিক শান্তি সকলের বজায় থাকুক, সুস্থ থাকুন সকলে।