আজ ৫ই ডিসেম্বর –
দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ১০৩তম মৃত্যু দিবস।তিনি আজীবন বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ২০০৯ সালের নভেম্বর জাতিসংঘ ১৮ জুলাই ম্যান্ডেলার জন্মদিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যান্ডেলা ডে হিসেবে ঘোষণা করে।আজ সেই মহান নেতার মৃত্যু দিবস। তাই আজ স্মৃতির পাতায় রইলো নেলসন ম্যান্ডেলার সম্মন্ধে কিছু কথা –

নেলসন ম্যান্ডেলার শৈশব কাল –
নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই ট্রান্সকির প্রত্যন্ত গ্রাম ভেজোতে। তাঁর বাবা হেনরি ছিলেন টেম্বু গোত্রপ্রধান। জন্মের পর বাবা তাঁর নাম রাখেন রোহিলাহলা, যার অর্থ ‘ট্রাবল মেকার’। ম্যান্ডেলা যখন খুব ছোট, তখন একটি ঘটনা তাঁদের পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে দেয়। এক ব্যক্তি শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ করেন যে হেনরির একটি ষাঁড় তাঁর খেতের ফসল নষ্ট করেছে। ম্যাজিস্ট্রেট নেলসনের বাবা হেনরিকে তাঁর অফিসে তলব করে বসেন। হেনরি ছিলেন আবার ভুদিনএকগুঁয়ে স্বভাবের মানুষ। তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যেতে অস্বীকার করলেন। ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর বিরুদ্ধে অবাধ্যতার অভিযোগ আনেন। সেই সঙ্গে তাঁকে গোত্রপ্রধানের পদ থেকে পদচ্যুত করেন এবং তাঁর সমস্ত গবাদিপশু ও জমি-জিরাত বাজেয়াপ্ত করেন।ফলে বাধ্য হয়ে তিনি পৈতৃক ভিটা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী কুনুতে বসতি গড়েন। সাত বছর বয়সে হেনরি ম্যান্ডেলাকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দেন। স্কুলের শিক্ষকেরাই তাঁর নাম রাখেন নেলসন।

নেলসন ম্যান্ডেলার শিক্ষা ও কর্মজীবন :
শৈশবে নেলসন ম্যান্ডেলা ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে উইটওয়াটারস্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেন । তারপর তিনি জোহানেসবার্গে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে তিনি ক্রমে উপনিবেশ-বিরোধী সংক্রান্ত কার্যতে জড়িয়ে পরেন । তারপর তিনি ১৯৪৩ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৯৪৪ সালে ইয়ুথ লিগ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি সশস্ত্র সংগঠনের শক্তিশালী নেতা হিসাবে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে লড়াই চালান। তারপর ১৯৬২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
ম্যান্ডেলার জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। ছিলেন রাখাল, মিশনবয়, খনি পুলিশ, ল ফার্মের কেরানি, মুষ্টিযোদ্ধা, আইনজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, গেরিলাযোদ্ধা, বিপ্লবীনেতা এবং রাষ্ট্রনায়ক। বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতাদের ভূমিকায় ম্যান্ডেলা অলিভার ট্যাম্বো ও ওয়াল্টার সিসুলুকে নিয়ে ANC (এনসি) যুব সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যুবসমাজকে বর্ণবাদী আইন অমান্য ও স্বেচ্ছা কারাবরণে উদ্বুদ্ধ করে চলমান আন্দোলনে গতি সঞ্চার করেছেন। তিনি গোটা দেশজুড়ে কর্মীদের সংগঠিত করেছেন, ছদ্মবেশে দেশত্যাগ করে আফ্রিকার নানান দেশ ভ্রমণ করেছেন। ও বর্ণবিদ্বেষের প্রতি রুখে দাড়িয়েছেন। এই সব দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছ থেকে এএনসির জন্য সমর্থন, অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন। যৌবনকালে তিনি নেহেরুর আদর্শ দ্বারা ভীষণভাবে উদ্ভূত হয়েছিলেন।আবার পরিণত বয়সে আমরা ম্যান্ডেলাকে গান্ধীবাদে উদ্বুদ্ধ হতে ও আমরা দেখি।

বন্দিজীবনে বর্ণবাদী সরকারের মন্ত্রী ও পদস্থ কর্মকর্তারা তাঁকে অসংখ্যবার শর্ত সাপেক্ষে মুক্তির প্রস্তাব দেন। কিন্তু প্রতিবারই তিনি সব প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের মুক্তি অর্জন করাটাই প্রকৃত উদ্দেশ্য। তা সফল না হওয়া পর্যন্ত তিনি লড়াই করবেন। তাঁর এ দৃঢ়চেতা মনোভাব তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত করে।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ম্যান্ডেলা আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের “আফ্রিকানিস্ট” শাখার সাথে সম্পৃক্ত এএনসির সদস্য অ্যান্টন লেম্বেডের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ উপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বা কমিউনিস্টদের সাথে সম্পৃক্ততার ঘোর বিরোধী ছিল।কৃষ্ণাঙ্গের বাইরে ও কমিউনিস্টদের সাথে তার বন্ধুত্ব থাকা স্বত্ত্বেও ম্যান্ডেলা লেম্বেডের মতাদর্শকে গ্রহণ করেন এবং মনে করেন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের পুরোপুরিভাবে স্বাধীন হতে হবে।তাদের হার স্বীকারের বিপরীতে আফ্রিকানদের গণ-আন্দোলনের জন্য তরুণ শাখার গুরুত্ব বুঝতে পেরে এএনসির সভাপতি আলফ্রেড বিটিনি জুমার সাথে আলোচনা করতে ম্যান্ডেলা একটি প্রতিনিধি দলের সাথে যান জুমার সোফিয়াটাউনের সাথে সাক্ষাৎ করতে।

পরবর্তীকালে, তিনি সশস্ত্র বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে নেতা হিসাবে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার গ্রেপ্তার করে ও অন্তর্ঘাতসহ নানা অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এরপর ম্যান্ডেলা ২৭ বছর কারাবাস করেন। এই সময়ে তিনি অধিকাংশ সময়ই ছিলেন রবেন দ্বীপে, ভিক্টর ভার্স্টার ও পলসমুর কারাগারে।
১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ফেব্রুয়ারি তিনি কারামুক্তি হন। কারামুক্তি লাভের পর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের সঙ্গে বর্ণবাদ নিপাতের প্রচেষ্টায় শান্তি আলোচনায় অংশ নেন। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে এই ফলশ্রুতিতে সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণের ফলে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ম্যান্ডেলা তার দল এএনসি’র হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং পরবর্তীকালে জয়লাভ করে রাষ্ট্রপতিত্ব গ্রহণ করেন। ফলে,অবসান ঘটে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের এবং প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র।
বিশদে জানতে : https://www.nelsonmandela.org/content/page/biography
নেলসন ম্যান্ডেলার প্রাপ্ত পুরস্কার :
১৯৪৪ সালের পুণ্য রবিবারে বান্টু মেন্স সোশ্যাল সেন্টারে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস ইয়ুথ লিগ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি হন লেম্বেড এবং ম্যান্ডেলা এই দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হন।১৯৮৮ সালে তিনি শাখারভ পুরস্কারের অভিষেক পুরস্কারটি যৌথভাবে অর্জন করেন ।১৯৯৩ সালে ম্যান্ডেলাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে ভারতরত্ন পুরস্কার দেওয়া হয়।
নেলসন ম্যান্ডেলা শুধু অস্ত্র দিয়ে নয়, চিন্তা ও মনন দিয়ে আন্দোলন করেছিলেন । তিনি প্রায় ২৮টির বেশি বিখ্যাত গ্রন্থ লিখেছিলেন । তারমধ্যে লং ওয়াক টু ফ্রিডম, স্ট্রাগল ইজ মাই লাইফ, ম্যান্ডেলা, প্রিজনার ইন দ্যা গার্ডেন, কনভারসেশন উইথ মাইসেলফ, ইন হিজ ওন ওয়ার্ডস ইত্যাদি।আমৃত্যু তাঁর ধ্যান জ্ঞানই ছিলো মানুষের মুক্তি। সেই সংগ্রামী ম্যান্ডেলা ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের নিজ বাড়িতে ফুসফুস রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
আর ও পড়ুন : https://www.banglakhabor.in/শরীরকে-ফিট-রাখার-৫টি-মন্ত/amp/?