মন্দার বোস
মন্দার বোস

‘মন্দার বোসের এখন বাজার মন্দা চলছে’ ,একসময় এক আলাপীকে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন এইভাবে।

সোনার কেল্লায় অসাধারণ মন্দার বোসের চরিত্র যিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন সেই কামু মুখার্জী(মন্দার বোস) ছিলেন একাধারে রসিক মানুষ, পানিং,শব্দ নিয়ে খেলতে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনই ভালোবাসতেন মানুষকে। নানা গুণের পারদর্শী কামু মুখার্জী(মন্দার বোস) হেন কাজ নেই যে করেন নি। লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে একদিন কলিং বেল টিপলে একজন বেঁটে লোক দরজা খুলে দেয়। বাজখাই গলায় জিজ্ঞেস, ‘ যার সাথে দেখা করতে এসেছি, তিনি তো শুনেছি সাড়ে ছ’ফুট। তুমি কে হে বাবা !?’ আওয়াজের চোটে সত্যজিৎ বেরিয়ে আসেন। দেখামাত্রই কামু( মন্দার বোস) বলেন, আমার নাম কামু মুখার্জী, আপনার সিনেমায় অভিনয় করতে চাই। সত্যজিৎ জানান, এখন তো কোনো সুযোগ নেই ! কামু(মন্দার বোস) জানান, কিন্তু একদিন নিশ্চয়ই আসবে… বলে উধাও..

চারুলতায় মন্দার বোস 1975

পরে সত্যজিৎ ডেকে নেন চারুলতায় ছোট্ট একটা সিনে। সেখানে অসাধারণ প্রেজেন্স এবং তারপর তো ইউনিটের এবং রায় পরিবারের একরকম সদস্যই হয়ে গেলেন কামু মুখার্জী(মন্দার বোস)। কামু বলতেন, এই পৃথিবীতে বেশীরভাগ মানুষই Triple E, – ‘Entrance, Expiry, Exit’.. খুব কম লোক Triple H-এর দলে, Head, Hand, Heart.. তাঁর দেখায় সত্যজিৎ এই Triple H.. ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে একাধিক চরিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি গানও গেয়েছিলেন (আছো যেথা যত আমীর ও ওমরা), ‘হীরক রাজার দেশে’ তে দ্বাররক্ষী হয়ে বাঁধা অবস্থায় ওই ল্যাম্পপোস্টের মত পড়ে যাওয়া সহজ ছিল না। ‘জয় বাবা ফেলুনাথে’ অর্জুন হয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন নিজেই করবেন নাইফ থ্রোয়িং.. শুনে সন্তোষ দত্ত আঁতকে উঠেছিলেন।

রসিক লোক ছিলেন কামু(মন্দার বোস)। সোনার কেল্লায় নকল মুকুলের দাদুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিমল চ্যাটার্জী। অভিনেতার সাথে প্রথম দেখা করতে গিয়ে সত্যজিৎ তাঁকে বলেন, আপনাকে দেখতে অনেকটা নজরুলের মতো। সঙ্গে ছিলেন কামু(মন্দার বোস)। বলে উঠলেন, ‘নজরুল নয়, ইনি হলেন বিমরুল। বিমল আর নজরুল মিলিয়ে।’, সত্যজিতের অবস্থা সহজেই অনুমেয়..

মন্দার বোস
halfsamosa

তেমনই গুপী বাঘাতে ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’ গানের শুটিঙের মাঝে আকাশভরা মেঘে আলো হঠাৎ করে কমে আসে। পুরো ইউনিট নিয়ে বসে থাকা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই। কামু() গিয়ে সত্যজিতকে বলেন, ‘মানিকদা, শুটিং বন্ধ না করে, গানের কথা একটু পালটে দিলে হয় না?’ ‘কীরকম?’ আশ্চর্য হয়ে জানতে চান সত্যজিৎ’। কামুর() উত্তর, ‘ আহা কী আনন্দ ফ্যাকাশে আকাশে, আশেপাশে মেঘ ভাসে, কত কুৎসিত শোভা চারপাশে’… হো হো করে হেসে উঠেছিলেন সত্যজিৎ।

জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় মানিকদার সাথেই। তিনি বলতেন,

‘ যেহেতু আমার জন্ম হল কয়লাখনিতে,

খনির কুলি পারল নাকো আমায় চিনিতে।

মনের ব্যথা মনে চেপে ঘুরি হেথা সেথা-

মানিকদা এক চিনল আমায় ঘুচল মনের ব্যথা..’

রসিক মন্দার বোস

মন্দার বোস
pinterest

তিনিই বোধহয় তাই স্বচ্ছন্দে ‘নাগরা ফলস’ দেখাতে পারেন। বিজয়া রায় চা বিস্কুট দিলে বলতে পারেন, বৌদি, বিস্কুটগুলোতে কি আলাদা করে সাইলেন্সার লাগিয়েছেন? পরবর্তী সিনেমায় সবাই একটা করে রোল পেয়েছেন, কিন্তু কামুর নেই। কামুই() বলতে পারেন, ‘মানিকদা, চরিত্র না হোক, অন্তত দুশ্চরিত্র দিন একটা !’ ষাঁড় খুঁজে নিয়ে আসা হোক- কি পাবলিক আটকানো, জ্যান্ত বিছে ধরা হোক কি জাগলিং – কামু অনন্য। হারুনের চরিত্র করে খুব খুশী হয়েছিলেন। হারুন চরিত্রটাও বোধহয় ইতিহাসে লেখা হয়ে ছিল তাঁরই জন্য..,

সোনার কেল্লার শুটিংপর্বে এক রাতে দেখা গেল আড্ডায় সিগারেট শেষ। একমাত্র ভরসা মানিকদা ! কিন্তু চাইবে কে? অনেক জোরাজুরি করে কামুকে রাজি করা গেল ঘুমিয়ে পরা মানিকদার ঘর থেকে সিগারেট ‘চুরি’ করে আনার ব্যাপারে। বেড়ালের মতো নিঃশব্দে কামু যখন ওপাশ ফিরে ঘুমোনো সত্যজিতের ঘরে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করছেন, এক ব্যারিটোন গলা ভেসে এলো, ‘কামু, কালকের বাথরুমের জন্য অন্তত একটা রেখো।’ কামু(মন্দার বোস) পালিয়ে বেঁচেছিলেন…

ঘরে বাইরের পোস্টার নিয়ে চিন্তামগ্ন সত্যজিতকে উপায় বাতলেছিলেন, ‘মানিকদা, এরকম করে দিন, ‘ঘরে বাইরে by Ray’.. সত্যজিৎ সেটা না করলেও ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন কামুর(মন্দার বোস এই শব্দদক্ষতার। মগনলালের বজরার ছবি তুলতে ক্যামেরা যখন গম্বুজের মাথায় বসানো হচ্ছে, সেখানে পায়রার নানারকম কীর্তিকলাপ সাদা-কালো-খয়েরী-সবুজ-ধূসর রঙ নিয়ে এক দুর্দান্ত অবস্থা তৈরী করেছে। সত্যজিৎ দেখে আচমকা বলে ওঠেন, এ যে দেখছি Vista Vision ! কামু তৎক্ষণাৎ, ‘Vista Vision না বলে বলুন বিষ্ঠা ভীষণ !’

সত্যজিৎ চলে যাবার সময় পুরো যাত্রাপথে তাঁর পায়ের কাছে বসে হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে গেছিলেন এই মানুষটি। সত্যজিৎ সন্তানস্নেহে, ভ্রাতৃস্নেহে আজীবন আগলিয়েও রেখেছিলেন তাঁকে। আজ থেকে সতেরো বছর আগে, ২০০৩ সালে আজকের দিনে অজানায় পাড়ি দেন কামু মুখোপাধ্যায়()। সত্যজিৎ না থাকলে যাকে হয়তো আমরা পেতামই না। যিনি না থাকলে সত্যজিতের অনেক সিনেমার অনেক চরিত্র হয়তো জন্মাতই না !