ফুটবলের সঙ্গে বাঙালির আত্মিক যোগ আছে বরাবরই, শৈশব থেকে বৃদ্ধ বলুন কিংবা বাড়ির বৈঠকখানা থেকে পাড়ার রকের আড্ডাই হোক, অথবা ক্লাবের তর্কের বিষয়ে ফুটবলের আধিপত্য সর্বত্রই এবং নিয়মতি. আন্তর্জাতিক ফুটবল এ পেলে মারাদোনাই হোক বা মেসি রোনাল্ডও নেইমার , ফুটবল নিয়ে বাঙালি সবসময় মাতোয়ারা . আর সেখানে যদি দেশীয় ফুটবলের কথায় আসি , তাহলে সেই উম্মাদনা বাঙালির রক্তে বিরাজ করে . কারণ বাঙালি ঐতিহ্যশালী ,
আদি অনন্তকাল ধরে হয়ে আসা ঘটি বাঙালের লড়াই জায়গা করে নেয় .আর বলার অপেক্ষা রাখে না কারণ ক্লাব দুটির নাম ঐতিহাসিক ঐতিহ্যশালী মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল . যাদের ডার্বি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ও এশিয়ার সর্ববৃহৎ ডার্বি হিসাবে পরিচিত . আর এই লড়াই জুড়ে বাঙালি সমর্থকদের আবেগ এক অন্য মাত্রা নেয় . লক্ষ করলে দেখা যাবে বিশ্বের এমন কোনো জায়গা বাকি নেই যেখানে এই দুই দলের সমর্থকরা ক্লাব এর পতাকা মেলে ধরেননি.


আজ থেকে ১৩২ বছর আগে ভারতবর্ষ য্খন স্বাধীনতার সূর্য দেখেনি ব্রিটিশরাজে অত্যাচারিত ও নিপীড়িত , য্খন ফুটবলে বাঙালি তথা ভারতীয়দের কোনো অধিকার স্থান কিছুই ছিল না , ঠিক তখনি বাঙালি ফুটবলকেই বেছে নেয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিবাদের ভাষা স্বরূপ . ১৯১১ সালে খালি পায়ে ফুটবল খেলে ব্রিটিশ ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট দলের বিরুদ্ধে মোহনবাগান জয় ছিনিয়ে নিয়ে আসে IFA SHIELD ফাইনালে , সাথে সাথে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে নামটি তুলে নেয় এই জাতীয় ক্লাবটি .
এটাই ছিল ব্রিটিশ আধিপত্যের মূলে ভারতীয় তথা বাঙালির কুঠারাঘাত . মাথানত না করা , উল্টে পাল্টাঘাত করার এক ভাষা হিসাবে তুলে ধরে স্বাধীনতার যুদ্ধে . এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে চলতে থাকে বাঙালির একের পর এক ফুটবল সাফল্য কিন্তু কোথাও মতবিরোধের বীজও দানা বাধ্ধে থাকে . ১৯২০ সালে সেখান থেকেই ভারতবর্ষ তথা ওয়েস্ট বেঙ্গল এ জন্ম নেয় ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব . ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে ধীরে ধীরে জায়গা করে নেয় ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব এবং আন্তর্জাতিক সাফল্যেও অধিকারী হয়ে এই শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাব . প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এইভাবেই আবেগ উম্মাদনা নিয়ে বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে আছে এই দুই ক্লাব.


ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ সম্মান I – League মোহনবাগানের 2
ধীরে ধীরে অনেক জল বয়ে গেছে গঙ্গা দিয়ে . ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ সম্মান I – League দুবার জেতা হয়ে গেছে মোহনবাগানের . যদিও সেই সম্মান আজও অধরা ইস্ট বেঙ্গলের কাছে. এরই মধ্যে নীতা আম্বানির পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয়ে ISL ( ইন্ডিয়ান সুপার লীগ) , যেখানে ফ্রাঞ্চাইজি ফুটবলের নিদর্শন আমরা দেখতে পাই . খুব তাড়াতাড়ি ISL , AIFF এর থেকে আই লীগকে সরিয়ে ইন্ডিয়ার প্রথম সারির লীগ হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে . এবং ঐতিহ্যশালী আই লীগ তার মুকুট হারিয়ে নেমে আসে দ্বিতীয় সারির লীগ হিসাবে . স্বাভাবিকভাবেই বিপদে পরে এই দুই ঐতিহ্যশালী ক্লাব .
নিজেদের অস্তিত্ব প্রথম সারিতে টিকিয়ে রাখতে ক্লাব দুটি নিজেদের মধ্যেও বারবার বৈঠক করে. AIFF এর বিরুদ্ধে অনেকবার প্রতিবাদও দেখায় . কিন্তু পুঁজিবাদ এর সামনে তাদের প্রতিবাদ টিকে থাকতে পারেনি . বাধ্য হয়েই ISL খেলার পথ খুঁজতে হয়ে .


২০১৯- 2020 আই লীগ এ খেলার সময় ঐতিহ্যশালী জাতীয় ক্লাব মোহনবাগান স্পনসর জোগাড় করতে না পারায়, অনেক কটূক্তি ও দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হয়ে পড়শী ক্লাবের সমর্থকদের থেকে. এই সবকিছুর পরও ঐতিহ্যশালী জাতীয় ক্লাবটি ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ সম্মান আই লীগ এর শিরোপা দ্বিতীয়বারের জন্য জয় করে নেয় . মোহনবাগান ক্লাব ম্যানেজমেন্ট তখনি ঠিক করে নেয় তারা 2020 সাল থেকেই দেশের সর্বোচ্চ লীগ এর সদ্য সম্মান পাওয়া ISL এ নিজেদের নাম নথিভুক্ত করবে .
এরপরেই সঞ্জীব গোয়েঙ্কা ও প্রবাদপ্রতিম সৌরভ গাঙ্গুলীর ফুটবল সংস্থা ATK অর্থাৎ আতলেতিকো দে কলকাতা এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ISL খেলার জন্য কথাবার্তা এগোতে থাকে . দুবার ISL বিজয়ী এই ফুটবল সংস্থাও মোহনবাগানের এই বিশেষ ব্যাপী বিপুল সমর্থকদের দলে নিতে উদগ্রীব হয়ে পরে . দীর্ঘ আলোচনার পর জার্সি , লোগো , নাম দুপক্ষের সোহমতেই পরিণতি পায়ে এটিকে মোহনবাগান রূপে . এরপর দুবার ISL জয়ী কোচ আন্তেনিও হাবাস এর দল গুছিয়ে নিতে দেরি হয়নি . কিন্তু দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়.


অন্যদিকে ঐতিহ্যশালী মোহনবাগান ক্লাবের এই সিদ্ধান্তকে নিয়ে প্রবল ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতে থাকে ইস্ট বেঙ্গল সমর্থকেরা . কিন্তু ভেতর ভেতর নিজেদের দ্বিতীয় সারিতে খেলা ক্লাব বলে মেনে নিতেও পারেননা . সমর্থকদের মধ্যেও মতবিরোধ দেখা দেয়. সমর্থকদের কথা মাথায় রেখে তাদের আশ্বস্ত করতে ক্লাব কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে , তারাও ISL খেলবে কিন্তু নিজেদের দমে খেলবে . এরপরই চলতে থাকে স্পনসরদের সাথে আলোচনা .
কিন্তু ইস্ট বেঙ্গলের চুক্তিবদ্ধ স্পনসর তাদের কিছুতেই ISL খেলার জন্য NOC দিতে রাজি হয়না. প্রয়জনে আইনি ব্যবস্থা নেবার কোথাও তারা জানায় . বেগতিক দেখে ক্লাব কর্তৃপক্ষ মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা বন্ধোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হয়ে . ফুটবলপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী সাহায্যে তারা অনেক আলোচনার পর স্পন্সরকে NOC দিতে রাজি করায়. কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যায় ISL এর খেলার আবেদনের .কোনো উপায় না থাকায় আবারও তারা ফুটবলপ্রিয় মাননীয়া দ্বারস্থ হয়ে. মুখ্যমন্ত্রী সাহায্যে আবারও পরিত্রান পায়ে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব . মাননীয়া তাদের খেলার ব্যবস্থা করে দেন শুধু তাই নয় এমনকি শ্রী সিমেন্ট গোষ্ঠীকে স্পনসর হিসাবে ইস্ট বেঙ্গলকে সাহায্য করতে আবেদন করেন . শ্রী সিমেন্ট গোষ্ঠী মাননীয়া ডাকে সারা দিয়ে ইস্ট বেঙ্গলকে স্পনসর করতে রাজি হয়ে.
কিন্তু এরপরও চলতে থাকে দীর্ঘ টালবাহানা , শ্রী সিমেন্ট ফুটবল ফাউন্ডেশন নামেই ISL খেলার আবেদন জানানো হয়ে. সমর্থকরা এই নাম নিয়ে তিব্র প্রতিবাদ জানায় . কারণ শতাব্দীপ্রাচীন ইস্ট বেঙ্গল নামটি সেখানে ছিল না . এইসব নিয়ে ক্লাব কর্তৃপক্ষ আবারও মাননীয়া দ্বারস্থ হয়ে. বরাবরই মাননীয়া পরিত্রাতা হয়ে দেখা দেয় ফুটবলের স্বার্থে . অনেক বৈঠকের পর শ্রী সিমেন্ট গোষ্ঠী ক্লাবের বেশ কিছু দাবি মেনে নেয় এবং SC East bengal নামে ISL খেলার অনুমতি পায়ে , যেখানে ৭৬% অংশীদারি শ্রী সিমেন্ট ও ২৪% ইস্ট বেঙ্গলের . এরপর খুবই কম সময় তাড়াহুড়ো করে দল গোছাতে থাকে ও এই জন্য ISL এর কাছে বাড়তি সময় নেয় .


সেই জন্য দুৰ্ভাগ্যবসত কিছুটা পিছিয়ে প্রথম ম্যাচ ডার্বি হয়ে দেখা দেয় কারণ প্রতিপক্ষ স্থির হয়ে শক্তিশালী মোহনবাগান .সব ব্যঙ্গ বিদ্রুপের জবাব দিয়ে ঐতিহ্যশালী মোহনবাগান ক্লাব পড়শী SC ইস্ট বেঙ্গলকে ২-০ গোলে লজ্জার হার উপহার দেয়. শতবর্ষের উজ্জাপন দুঃস্বপ্নের মতো দেখা দেয় ইস্ট বেঙ্গলের সমর্থকদের কাছে. ঐতিহ্যের শতবর্ষে আই লীগ অধরা, মোহনবাগান এর কাছে হার, প্রতিশ্রুতি নিজের দমে ISL খেলা , ধরে রাখতে না পারা , পড়শি ক্লাবকে বিদ্রুপ , সবকিছুই যেন বুমেরুং হয়ে ধাক্কা মারে. শুধু এখানেই শেষ নয়, শেষ ম্যাচে মুম্বাইয়ের বিরুদ্ধে ৩ গোল হজমও করতে হয়ে ইস্ট বেঙ্গলকে , এরপর তাদের কোচ ভারতীয় ফুটবলারদের মারাত্মক অপমান করেন . এই সবকিছুই মুখ বুজে সহ্য করতে হয়ে সমর্থকদের . ব্যর্থতার অন্ধকারে সমর্থকরা জেতার আশা ছেড়ে অন্তত বিপক্ষের জালে ১টি গোল দেখার আশায় দিন গুনছেন.