তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসার পর বিরোধী দলগুলোকে ভাঙিয়ে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি আরো বাড়িয়ে তোলে। সেই সময়ে তাদের দল ভাঙার ঘটনা এমন পর্যায়ে পৌঁছে ছিল যে এই রাজ্যের তৎকালীন বিরোধী দলগুলো অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে শুরু করে। বর্তমানে পাশার চাল সম্পুর্ন উল্টো দিকে ঘুরে গিয়েছে। ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের আগে থেকেই একাধিক শীর্ষস্থানীয় তৃণমূল নেতা দল বদলেছেন। দলত্যাগী নেতাদের মধ্যে প্রধান হলেন মুকুল রায়। শুধু মুকুলেই নয়, এই তালিকা বেশ লম্বা। বলতে গেলে এরাজ্যের বিজেপির প্রথম সারির একাধিক নেতার পুরানো “ঠাঁই” ছিল তৃণমূলেই। এখন আবার রাজ্যে জোর জল্পনা তৈরি হয়েছে শুভেন্দু অধিকারী দলত্যাগ করতে পারেন।
একের পর এক তৃণমূল নেতার দল ছাড়ার কারণ হিসাবে নানান সম্ভাবনার কথা বাজারে শুনতে পাওয়া যায়। সেইসব জল্পনায় কান না দিয়ে আমরা বরং সুনির্দিষ্ট ৫ টা কারণ খুঁজে দেখি, যেগুলির জন্য একাধিক তৃণমূল নেতা দলত্যাগ করছেন বা করার কথা ভাবছেন।
১) অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কাজ করতে কোনো তৃণমূল নেতার সমস্যা ছিল না। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ধারা মেনেই একাধিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতা তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল। এর কারণ হল তৃণমূল নেত্রীর রাজনৈতিক উচ্চতা। কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যত তৃণমূলের শীর্ষ স্তরে উঠে এসেছেন ততো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেছে ওই সব নেতারা। সেই সঙ্গে তারা বুঝে গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর দলের নেতৃত্ব যাবে অভিষেকের হাতেই।
মুকুল রায় তৃণমূলে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড নামে পরিচিত ছিলেন। বস্তুত মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পর তার হাতেই দলের কর্তৃত্ব যাবে বলে মনে করা হতো। কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থানের পর পরিষ্কার হয়ে যায় মুকুল রায়কে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হয়েই থেকে যেতে হবে। তিনি কখনই এক নম্বর আসনটা পাবেন না।
শুভেন্দু অধিকারীর মতো জনপ্রিয় নেতা যার একাধিক জেলায় প্রবল প্রভাব সেই তিনিও বুঝে যান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সামনে চলে আসায় তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা কখনোই সফল হতে পারবেনা তৃণমূলে থাকলে। সেইসঙ্গে দলের সবকিছু ক্রমশ অভিষেকের হাতে চলে যাওয়ায় অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগতে শুরু করেছেন শুভেন্দু অধিকারী।
একাধিক বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেই তৃণমূলে সামিল হয়েছিলেন একসময়। কিন্তু তারা বর্তমান প্রজন্মের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের খবরদারি মেনে চলতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নন। সেই কারণেই সম্ভবত তারা দল ত্যাগ করার পথে এগিয়ে গিয়েছেন।
২) প্রশান্ত কিশোর ফ্যাক্টর
সাম্প্রতিককালে মিহির গোস্বামী প্রশান্ত কিশোরকে দায়ী করে দল ছেড়েছেন। এছাড়াও শীলভদ্র দত্তর মতো একাধিক বিধায়ক প্রশান্ত কিশোর ও তার সংস্থার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেরই বক্তব্য রাজনীতিতে কর্পোরেট কালচার আমদানি করলে তা সফল হবে না। খুব তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে বিষয়টা রাজনীতিতে কর্পোরেট কালচার নিয়ে নয়, বিষয়টা হলো নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখা নিয়ে। প্রশান্ত কিশোর তার প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী দিয়ে পৃথকভাবে প্রতিটি তৃণমূল বিধায়কের কাজের মূল্যায়ন করেছেন। এর ফলে অনেকেরই “ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে।” আগে দলের জেলা সভাপতি বা সংগঠনকে ম্যানেজ করে অনেক নেতাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে বানানো রিপোর্ট পাঠাতেন। কিন্তু বাইরের সংস্থা এসে পৃথকভাবে সমস্ত কিছু পর্যালোচনা করার পরই প্রকৃত সত্য দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্তের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। এর পর থেকেই এই সমস্ত নেতারা উল্টো সুরে গাইতে আরম্ভ করেছেন।
৩) ভোটে হারার আতঙ্ক
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের বিধানসভা ওয়াড়ি ফলাফল অনুযায়ী এই রাজ্যে ১২১ টি বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে আছে বিজেপি। ১৬৬ বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে থেকে তৃণমূল রাজ্যে এখনো পর্যন্ত বৃহত্তম দল হলেও একাধিক তৃণমূল নেতা ভোটের পরাজয়ের আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেছেন। কারণ ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে মাত্র ৩ টি আসনে জয়লাভ করেছিল যে বিজেপি, সেই তারাই লোকসভার ফলাফল অনুযায়ী ১২১ টি বিধানসভায় এগিয়ে গিয়েছে। এর ফলে উত্তরবঙ্গ এবং জঙ্গলমহলের বেশিরভাগ তৃণমূল বিধায়ক তাদের কেন্দ্রে পিছিয়ে পড়েছেন।
লোকসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে যে সমস্ত তৃণমূল বিধায়করা তাদের কেন্দ্রে বিজেপির কাছে পিছিয়ে পড়েছেন তারাই মূলত ক্ষমতা ধরে রাখার লক্ষ্যে তৃণমূল ত্যাগ করতে শুরু করেছেন। এদের ধারণা ২০২১ এর বিধানসভা ভোটে রাজ্যে বিজেপির ঝড় বজায় থাকবে। সে ক্ষেত্রে তৃণমূলে থেকে গেলে নির্বাচনে জয় লাভ করা সম্ভব হবে না, এই সম্ভাবনার দ্বারা চালিত হয়ে বিজেপির দিকে পা বাড়িয়েছে এরা। এদের মূল লক্ষ্য নিজের বিধানসভা আসনটি সুরক্ষিত করার।
৪) কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্ত
সারদা-নারদা কান্ড সহ একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত বেশকিছু তৃণমূল নেতা। সেই সঙ্গে স্থানীয় স্তরের সমবায় ব্যাঙ্ক সহ আরো বেশ কিছু দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন অনেকেই। তার ফলে বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা মাঝেমধ্যেই তৃণমূলের মন্ত্রী বিধায়কদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করছে। আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলকে ব্যতিব্যস্ত করতে বিজেপির নির্দেশে সিবিআই ইডি সহ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি অতিরিক্ত সক্রিয়তা দেখাচ্ছে বলে বারবার অভিযোগ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির হাত থেকে বাঁচতেই অনেক তৃণমূল নেতা দলত্যাগ করেছেন বা করার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন। তাদের ধারণা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিলে রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি তাদের বিরুদ্ধে আর ততটাও সক্রিয় হবে না। তাদের মতে এরপরও যদি তৃণমূলে থেকে যান তাহলে জেলযাত্রা আটকানো মুশকিল হতে পারে!
৫) জনরোষ থেকে আগাম বাঁচার প্রচেষ্টা
এই রাজ্যের বিরোধী দলগুলি অভিযোগ করে তৃণমূলের শীর্ষস্তরের নেতারা থেকে শুরু করে একেবারে পাড়ার দাদারা পর্যন্ত এই ন’বছরের জনসাধারণের কাছ থেকে কাটমানি খেয়ে নিজেদের সম্পদ বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে নিয়েছে। সাম্প্রতিক আম্ফানের ত্রাণ বন্টনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় স্তরের একাধিক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল নেতাদের একাংশ মনে করছে আগামী বিধানসভা নির্বাচনের পর বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় আসলে তাদের ওপর মানুষের জনরোষ আছড়ে পড়বে। তার বদলে তারা আগাম বিজেপিতে গিয়ে সামিল হলে জনরোষের হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে বলে মনে করছে তারা।
জনরোষ থেকে বাঁচার এই ভাবনায় রসদ যোগাচ্ছে ২০১১ সালের পরিস্থিতি। সেইবার বামফ্রন্টকে পরাজিত করে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আসার পর তৎকালীন সিপিআই(এম) এর নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক জনরোষ আছড়ে পড়ে। সেই উদাহরণকে সামনে রেখেই এরা মনে করছে আগাম বিজেপিতে গিয়ে তরী ভেড়ানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
সত্যি বলতে কি দলত্যাগের এই পাঁচটি মূল কারণ ছাড়াও আরো একাধিক কারণ আছে। তার অন্যতম হলো সাম্প্রদায়িক বিভাজন একাধিক তৃণমূল নেতাকে বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। আবার অনেকে দলের গোষ্ঠী রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েও দল ছাড়ছেন বা সেই পথে পা বাড়িয়েছেন।
সমস্ত যুক্তিতর্কের পরও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দলত্যাগের ক্ষেত্রে বাঙালির এক প্রাচীন প্রবাদকে মনে রাখা উচিত “খলের ছলের অভাব হয় না !”