হ্যারি পটারের নাম শোনে নি এমন মানুষ পৃথিবীতে হাতে গোণা। হ্যারি পটারের সমস্ত বিষয়বস্তু বিস্তারিত না জানলেও অন্তত নামটুকু জানা সকলেরই। আর সেই সঙ্গে সকলেই জানেন জাদু বা ম্যাজিকের সঙ্গে আছে হ্যারি পটারের মোক্ষম যোগ। কিন্তু হ্যারি পটার এবং তার জাদুর দুনিয়া নিতান্তই অবাস্তব, বইয়ের পাতার রূপকথার গল্পের মতোই কাল্পনিক। আজগুবি এই গল্প সম্ভার কেবল হলিউডের সিনেমার পর্দাতেই মানায়, তা দিয়ে রোজকার জীবন চলে না, এমনটাই বলে থাকেন পৃথিবীর অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী।


হ্যারি পটার হল জে কে রাওলিং রচিত একটি ইংলিশ উপন্যাস সমগ্র, যার কাহিনীপটের মূল ভিত্তি জাদুবিদ্যা। ছোটো থেকে মাসির বাড়িতে মানুষ হওয়া হ্যারি তার ১১ বছরের জন্মদিনে হঠাৎই জানতে পারে নিজের আসল পরিচয়। সে জানতে পারে সে আদতে সাধারণ কোনো মানুষ নয়, তার ভিতরে জন্মগত ভাবেই রয়েছে জাদুর ক্ষমতা। এরপর জাদুবিদ্যার স্কুল হগওয়ার্টসে (Hogwarts) গিয়ে কীভাবে হ্যারি পটার বড়ো হয়ে উঠল, কীভাবে সে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ানক জাদুবিদকে হারিয়ে ম্যাজিকাল দুনিয়ায় সকলের ত্রাতা হয়ে উঠল, হ্যারি পটারের ৭টি বই সেই গল্পই বলে।


হ্যারি পটার নিয়ে ভক্তদের মধ্যে উৎসাহ উন্মাদনা কিন্তু আর পাঁচটা ফ্যান ফিকশনের (fan fiction) মতো নয় একেবারেই। গল্পের চরিত্রের সঙ্গে আকছার আমরা নিজেদের জীবনের মিল খুঁজে পাই, কিন্তু গল্পের চরিত্র বইয়ের পাতাতেই আটকে থাকে। হ্যারি পটারের পাঠককূল কিন্তু একে কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ কাল্পনিক কাহিনী মাত্র হিসেবে ভেবে নিতে নারাজ। একুশ শতকের বিজ্ঞানের জগতে সম্পূর্ণ বিশ্বাস রেখেও তাঁরা বলে থাকেন হ্যারি পটারের জাদুর দুনিয়া আদতে ঘোর বাস্তব। বইয়ের পাতায় নয়, বাস্তবেও অস্তিত্ব রয়েছে লুকোনো ম্যাজিকাল দুনিয়ার। হ্যারি পটার এবং ৭টি বই জুড়ে লেখা সমস্ত কাহিনীকে সত্যি বলে দাবি করে থাকেন তাঁরা। কেন এমন অদ্ভুত দাবি? আসুন জেনে নেওয়া যাক ৫টি কারণ।
১) হ্যারি পটারের উপস্থাপনা:


জে কে রাওলিং যেভাবে তাঁর বইয়ের ৭টি খন্ডের মধ্যে জাদুর দুনিয়ার নিখুঁত ছবিটা এঁকেছেন তা এই কাহিনীকে সত্যি মনে করার সবচেয়ে বড়ো কারণ। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হল তিনি কেবল ম্যাজিকাল দুনিয়ার কথা বলেই ক্ষান্ত হন নি। তিনি ম্যাজিকাল দুনিয়ার পাশাপাশি নন-ম্যাজিকাল দুনিয়াকেও এঁকেছেন। দেখিয়েছেন পাশাপাশি অবস্থিত এই দুই জগতের মধ্যেকার গোপন সম্পর্ক। দেখিয়েছেন কীভাবে আমাদের মাঝেই পরিচয় গোপন করে ঘুরে বেড়ান ম্যাজিকাল লোকজন, আমরা চাইলেও বুঝতে পারি না।
২) হ্যারি পটারের ডিমেন্টরস:


ডিমেন্টরস নামের এক ধরণের প্রাণীর অস্বিত্ব পাওয়া যায় হ্যারি পটারের ম্যাজিকাল দুনিয়ায়। আপাদমস্তক কালো আলখাল্লায় মোড়া এই ডিমেন্টররা আসলে চারপাশের সুখ শুষে নেয়। হাসি খুশি আশা এই সমস্তই তাদের খাদ্য। ফলে এরা সামনে এলে মানুষ চলে যায় চরম অবসাদে। জীবনে আর কখনো ভালো কিছু হবে না, সমস্ত আশা ভরসা শেষ, এমনটাই মনে হয় ডিমেন্টরদের প্রভাবে। এদের নন-ম্যাজিকাল ব্যক্তি দেখতে পান না। কিন্তু বলা বাহুল্য, ম্যাজিকাল দুনিয়ার এই প্রাণীর যে প্রভাব তা আমরা সকলেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কখনো না কখনো অনুভব করে থাকি। মনে করা হয় আমরা দেখতে না পেলেও ডিমেন্টরস বাস্তবেও আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, তাদের উপস্থিতি আমরা টের পাই খুব ভালো করেই।
৩) হ্যারি পটারের একটি স্পেল (spell):


জাদুকাঠি ঘুরিয়ে নানা রকম স্পেল বা মন্ত্র উচ্চারণ করেই জাদুবিদরা সমস্ত কাজ করে থাকেন। এই সমস্ত স্পেলের মধ্যে একটি স্পেল হল অবলিভিয়েট (obliviate)। এই স্পেলটি হ্যারি পটারের দুনিয়ার সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। অবলিভিয়েটের মাধ্যমে যে কোনো মানুষকে যে কোনো বিষয় ভুলিয়ে দেওয়া যায়।এর মাধ্যমেই জাদুর দুনিয়ার গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। হতে পারে আমরাও আমাদের চারপাশেই কখনো কোনো ম্যাজিকাল কাজ হতে দেখেছি, এবং আমাদের উপর অবলিভিয়েট স্পেল প্রয়োগ করে স্মৃতি থেকে সেই ঘটনা মুছে দেওয়া হয়েছে। হতে পারে এই ঘটনা আকছার ঘটে চলেছে আমাদেরই চোখের সামনে!
৪) হ্যারি পটারের সৃষ্টিকর্তা:


হ্যারি পটারের ভক্তকূলের মাঝে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং জে কে রাওলিংকে নিয়েও প্রচলিত আছে নানা ধারণা। হ্যারি পটারের কাহিনীতে ম্যাজিকাল দুনিয়ার এক সাংবাদিকের কথা বলা হয় যাঁর নাম রিতা স্কিটার। নিজের লাগামহীন এবং অসংবেদনশীল লেখালেখির জন্য তিনি খুব একটা আস্থাভাজন ছিলেন না কারোরই। মনে করা হয়, এই রিতা স্কিটারকে তাঁর নির্দিষ্ট কোনো এক অপরাধের শাস্তি দেওয়া হয়। শাস্তি হিসেবে তার কাছ থেকে সমস্ত ম্যাজিকাল ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়, এবং সেই সঙ্গে হ্যারি পটার এবং তার সঙ্গীদের সাফল্য নন-ম্যাজিকাল দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে পূর্ব জীবনের কথা ভুলিয়ে সাধারণ মানুষের মতো পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমাদের মাঝে। এখানে এসে রিতা স্কিটার ওরফে জে কে রাওলিং লিখে ফেলেন ম্যাজিকাল দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ।
৫) হ্যারি পটারের গোপনীয়তা:


ম্যাজিকাল দুনিয়ার পরিচালনা করে থাকে Ministry of Magic. এই মন্ত্রী মন্ডল নিজেদের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য নির্দিষ্ট করে দেয় বেশ কিছু নিয়মকানুন। ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাচু অফ সিক্রেসি (International statue of secrecy) হল সেই আইন যার দ্বারা নন-ম্যাজিকাল দুনিয়ার থেকে আলাদা করে রাখা হয় ম্যাজিকাল দুনিয়াকে।
কেন এই গোপনীয়তা? ম্যাজিকাল দুনিয়ার কারিগররা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান ঠিকই, কিন্তু সংখ্যায় অনেক কম। তাই সংখ্যালঘু হিসেবে তাঁরা তাঁদের পরিচয় জানিয়ে দিতে চান না সকলকে। তাঁরা গোপনেই দিন কাটাতে চান।


বস্তুত, আজকের এই প্রতিবেদন পড়ে অনেকেরই হয় তো আজগুবি অবাস্তব বলে মনে হতে পারে। তবে তার মানেই যে হ্যারি পটারের ম্যাজিকাল দুনিয়া সত্যি সত্যিই অবাস্তব হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। হ্যারি পটারের ভক্তদের মাঝে হ্যারি, হগওয়ার্টস আর ম্যাজিক রয়ে যাবে চিরকাল।