"আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
            ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজে॥
            বাজতে বাজতে চলল ঢুলি।
            ঢুলি গেল সেই কমলাপুলি॥
            কমলাপুলির টিয়েটা।
            সুয্যিমামার বিয়েটা॥
            আয় লবঙ্গ হাটে যাই।
            ঝালের নাড়ু কিনে খাই॥
            ঝালের নাড়ু বড় বিষ।
            ফুল ফুটেছে ধানের শীষ।।"

শিশুপাঠ্য এই ছড়াটি আমরা ছোটবেলায় কে না পড়িনি। কিন্তু নিছক এই মজার ছড়াটিই প্রাচীন কালের বাঙালির বিস্মৃত বীরত্বের স্মারক হয়ে আছে।

গবেষকদের মতে, প্রাচীনকালে বাংলায় রাজারাজড়াদের যুদ্ধযাত্রার অগ্রণী সৈন্য ছিল ডোমযোদ্ধারা। যুদ্ধের শোভাযাত্রার সবার আগে (আগডুম), দুই পাশে (বাগডুম) পদাতিক এবং অশ্বারোহী (ঘোড়াডুম) ডোমসৈন্যরা থাকত। ঢাক, মৃদঙ্গ, ঝাঁঝর প্রভৃতি বাদ্যের সঙ্গে পা মিলিয়ে সৈন্যরা পথ দিয়ে এগিয়ে যেত। এইসব সৈন্যের মধ্যে বাগদি ও কৈবর্ত যোদ্ধারাও অসমান্য পরাক্রমশালী ছিল।

Youtube.com

ইতিহাসের সাক্ষ্য

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, পাল সাম্রাজ্যের রাজা রামপালের আমলে (আনুমানিক ১০৭৫ খ্রিঃ) উত্তরবঙ্গে বরেন্দ্রভূমিতে দিব্বোক ও তাঁর ভাই ভীমের নেতৃত্বে কৈবর্ত বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। বরেন্দ্রভূমি পুনরুদ্ধার করতে রামপাল বৃহৎ বঙ্গের সামন্তচক্রকে একত্রিত করে বিদ্রোহ প্রতিহত করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, এই ছড়াটি সেই সময়কার যুদ্ধযাত্রারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। পরবর্তীকালে কৈবর্তরা তাদের পাল-বিরোধিতা ও নদী অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গে আধিপত্য বিস্তারে সেন সাম্রাজ্যের রাজাদের নৌসৈন্যবাহিনীর অপরিহার্য অঙ্গ ছিল।

ঐতরীয় ব্রাহ্মণে ও প্রাচীন ভারতীয় পুরাণগুলিতে পূর্ব ভারতের কয়েকটি অবৈদিক জাতির উল্লেখ আছে। সেগুলি হল: বঙ্গ, বগধ ও চের। এদের মধ্যে বগধজাতির বাস ছিল বাংলার দক্ষিণভাগে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, এই বগধ জাতি থেকেই বাগদি কথাটির উৎপত্তি।

images 3
wikisource.org

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ‘বেণের মেয়ে’ নামক উপন্যাসটি সপ্তগ্রাম অঞ্চলের সহজিয়াপন্থী লুইপার শিষ্য বাগদী জাতির রূপারাজাকে কেন্দ্র করে লিখেছিলেন, যার সৈন্যবাহিনীতে ছিল বাগদী ও ডোম সেনা। মধ্যযুগে রচিত ধর্মমঙ্গল কাব্যে, লাউসেন ও ইছাই ঘোষের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে রাঢ়বাংলার বাগদি ও ডোম সৈন্যদের সাহসিকতার কথা ধরা আছে। একসময় এই ডোম সেনারাই বাংলার পশ্চিম-সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী ছিল। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের, রাজনগরের সামন্তরাজাদের ডোম সেনা ছিল। পরবর্তীকালে, তুর্কী শাসনব্যবস্থায় রাজসেনাবাহিনীতে তাঁদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে তাঁদের অস্পৃশ্যবর্গে ফেলে দেয়া হয় তৎকালীন সমাজপতিদের দ্বারা। যদিও, ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত জমিদারদের লেঠেলবাহিনীতে বাগদী সর্দাররাই মুখ্য ছিল।

পাল আমলে রচিত চর্যাপদে ডোম সিদ্ধাচার্যগণের বিশেষ উল্লেখ আছে। মধ্যযুগে এই বাগদি ও কৈবর্তদের অনেকেই উচ্চপর্যায়ের তন্ত্রসাধক ছিলেন। বর্তমানে, এরা ভারতীয় সংবিধানে তফশিলি জাতি হিসেবে পরিচিত।

ছড়াটির মর্মার্থ

প্রাচীনকালে ডোমযোদ্ধারা যুদ্ধের শোভাযাত্রায় কিভাবে যেতেন তার বর্ণনা রয়েছে ছড়াটিতে। তাছাড়া, তখনকার রাজারা বছরের কোন সময়ে যুদ্ধযাত্রা করতেন তার বিবরণও এতে রয়েছে। ছড়া অনুযায়ী, ডোম সৈন্যবাহিনী যখন কমলাপুলি অতিক্রম করছে তখন ‘সুয্যিমামার বিয়ে’ অর্থাৎ সকাল হচ্ছে। যুদ্ধযাত্রার সময় হিসাবে বলা হয়েছে ধানের শীষে যখন ফুল ফুটেছে অর্থাৎ বর্ষাশেষে শরৎকাল শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত, বিপক্ষ সৈন্য কর্তৃক যাত্রারত ডোমসৈন্যদের খাদ্যে বিষপ্রয়োগের কথাও উদ্ধৃত পংক্তিগুলিতে আছে। লবঙ্গ নামক নিযুক্ত চর সৈন্যদের খাদ্যরূপে প্রাপ্ত ঝালের নাড়ু পরীক্ষা করে বিষের সন্ধান পেয়েছে।