■ পর্ব:০১■
★★ আমার জেলা মুর্শিদাবাদ ★★

মুর্শিদাবাদ, আমার জেলা…প্রাণের জেলা। বিদগ্ধ জনেরা বলে, পিছিয়ে পড়া জেলা।
আমি বলি, যাই হোক না কেন, আমার জেলা… যার পাতায় পাতায় গল্প, কোণায় কোণায় ইতিহাস, কোণে কোণে রহস্য আর হৃদয় জুড়ে ভালোবাসা।
সত্যি ভালোবাসতে জানে মুর্শিদাবাদ নিবাসীরা। হৃদয়ের গহীনে অতিপাতি করে খুঁজলে প্রেম, মায়া, মমতা ও আতিথেয়তা পাওয়া যাবে নিরন্তর। শুধু খুঁজে নিতে হবে।

 পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি জেলা এই মুর্শিদাবাদ। রূপাই আর সাজুর দুটি গ্রামকে যেমন একটা নদী আলাদা করে দিয়েছিল, ভাগীরথী নদী তেমনই এই জেলাকে দুইভাগে ভাগ করেছে।
গঙ্গানদী মুর্শিদাবাদেই বিভক্ত হয়ে ভাগীরথী নামে মুর্শিদাবাদ হয়ে কলকাতায় পৌঁছেছে হুগলি নামে। এ নদীর পশ্চিমের অংশ রাঢ় ও পূর্বের অংশ বাঘিড়া( প্রচলিত ,বাগড়ি) নামে পরিচিত।

মুর্শিদাবাদের আয়তন ৫.৩১৪ বর্গ কিলোমিটার (২,০৬২ বর্গ মাইল)। এটি একটি জনবহুল জেলা। জনসংখ্যা ৭১.০২ লক্ষ। ভারতের ৬৪১টি জেলার মধ্যে নবমতম জনবহুল জেলা এটি।
এ জেলায় ৫টি মহকুমা আছে।
বহরমপুর, জঙ্গিপুর, লালবাগ, কান্দী ও ডোমকল।
মুর্শিদাবাদের ছাব্বিশটি ব্লক যথাক্রমে, মুর্শিদাবাদ, বহরমপুর, লালগোলা, ভগবানগোলা-১, ভগবানগোলা-১, রানীনগর-১, রানীনগর-২, জলঙ্গি, ডোমকল, হরিহরপাড়া, নওদা, বেলডাঙ্গা-১, বেলডাঙ্গা-২, ভরতপুর-১, ভরতপুর-২, কান্দি, বড়জ্ঞা, খড়গ্রাম, নবগ্রাম, সাগরদিঘী, রঘুনাথগঞ্জ-১, রঘুনাথগঞ্জ-২, সুতি-১, সুতি-২, সামসেরগঞ্জ, ও ফারাক্কা।
সাতটি পৌরসভা হলো, বহরমপুর, জঙ্গিপুর, মুর্শিদাবাদ, কান্দী, বেলডাঙা, জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ ও ধুলিয়ান।
মুর্শিদাবাদের সদর দপ্তর বহরমপুর।

মুর্শিদাবাদ সব সময়কার গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। প্রাচীন ও মধ্যযুগে একাধিকবার রাজধানীও ছিল। এমনকি সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণ-সুবর্ণ নাকি ছিল মুর্শিদাবাদেই। নবাবী আমলে অখণ্ড বাংলার (বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, 
পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ) প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল এটি।
১৭০৪ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে সরিয়ে ভাগীরথীর পূর্ব তীরে মুখসুদাবাদ গ্রামে নিয়ে আসেন। মুর্শিদকুলি খাঁ তার নিজের নাম অনুসারেই এর নাম দেন মুর্শিদাবাদ। এরপর ১৭১৬ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ নিজামতের কেন্দ্রও এখানে নিয়ে আসেন। ফলে এর গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়।

এই মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর মহকুমার রঘুনাথগঞ্জ সংলগ্ন বানীপুর গ্রামে আমি থাকি। জন্ম থেকে বেড়ে ওঠার মধ্যবর্তী কিছুটা সময় বাদে এই জেলাতেই কাটিয়েছি। দূরেও গিয়েছি, ফিরেও এসেছি অমোঘ আকর্ষণে।
মুর্শিদাবাদ সেই শহর, যেখানে সময় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে অব্যক্ত বেদনায়, অস্ফূট স্বরে। যে শহরের পথে-পথে আর জনপদে ঘুরে বারবারই শুধু মনে হয়, অতীত ঘটনাগুলো ‘ইতিহাস’ হয়ে ওঠেনি সময়ের দলিলে, যেন আজও বাস্তব হাতছানি দিয়ে ডাকছে অবিরত।
সেই ইতিহাসে ওঠা সে অতীত, আসলে অতীত নয়… যেন সম্ভবনাময় এক ভবিষ্যৎ। বাস্তবিকই ইতিহাসের জন্ম অতীতের গর্ভে, কিন্তু তার বিচরণ ভবিষ্যতের পটভূমিতে। সে ইতিহাস প্রবাহিত হয় শত বছর পরে, সহস্র বছর পরে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের রক্তস্রোতে।

মুর্শিদাবাদের ভাগ্যাকাশে যখন মধ্যগগনের সূর্য গণগণ করছিল। তখনই এক কালবৈশাখী আসে। তার কালো মেঘে ঢেকে যায় এই নীরব তীর্থভূমি। সেই তুমুল ঝড় ও ঘোর বর্ষণে দুইশত বছরের জন্য অস্ত যায় স্বাধীনতা সূর্য।
শুধু মুর্শিদাবাদ নয় পুরো ভারতবর্ষ তথা পুরো একটি জাতির ভাগ্যাকাশেও নেমে এসেছিল পরাধীনতার এক দীর্ঘ কালো মেঘ। আর তারই সাথে মুর্শিদাবাদের কপালে লেগে যায় ‘পরাজয়ের গ্লানি’। আরো যন্ত্রণার এ পরাজয় এসেছিল ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র হাত ধরে। আজও সে কালিমা আমরা হৃদয়ে বয়ে নিয়ে বেড়াই, আর তারই প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ ভালোবাসা উজাড় করে দিতে চাই সমস্ত পৃথিবীবাসীকে।
‘ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’…পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করল ভারত, মুর্শিদাবাদও বাদ গেল না। এক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শহর হিসেবে ইতিহাসে নাম রয়ে গেল।
আজও মুখে মুখে ফেরে সিরাজের নাম আর মীরজাফরের বদনাম। কোন করুণ পরিস্থিতির শিকার হন নবাব সিরাজদ্দৌলা আর কোন কুচক্রে মীরজাফর সাধের স্বাধীনতা তুলে দেন ইংরেজের হাতে… শুনতে মন চায় বারবার, পুরোনো হয় না সে কাহিনী। দুঃখ হয়, যন্ত্রণা হয়, কষ্ট হয়… তবু সমব্যথী হতে ইচ্ছে হয় ওই ইতিহাসের কলাকুশলীদের।

…মুর্শিদাবাদে কোনো ঘোরার জায়গা আছে? প্রশ্ন করল সেদিন আমায় একজন।
বললাম, ‘না, কোনো ঘোরার জায়গা নেই তো! পাথরের কোণে কোণে, দেওয়ালের ওই প্রতিটি গাঁথনিতে, সিঁড়ির ধাপে ধাপে, ছাদের কার্নিশে, পুকুরের জলে, মাটির ওপরে, মাটির নীচে… আছে শুধু ইতিহাস… শুধু ইতিহাস।
চুপ করে কান পেতে গিয়ে শুনবে, শুনতে পাবে ষড়যন্ত্রের সেই টানটান রোমাঞ্চের গল্প। নিঃশ্বাস বন্ধ করে অনুভব করলেই শুনতে পাবে দক্ষ প্রশাসক নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র দাপট। হাঁটার পথের বাঁকে বাঁকে নবার আলিবর্লি খাঁ-র দুরন্ত চতুরতার কাহিনী ফিসফিস করে শুনিয়ে যাবে পথের প্রতিটি ধূলিকণা। ঘাসের ওপর পা রেখে পথ চলবে, ওই প্রত্যেকটা ঘাসের ডগায় ডগায় স্মৃতি হয়ে লুকিয়ে আছে কত কথা, তারা জানান দেবে সাথে সাথেই। দেওয়ালে কান পাতলে শুনতে পাবে পলাশির যুদ্ধের পর বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার হাহাকার।
এই শহরের অলিতে গলিতে ইতিহাস যেন কথা বলে, পরতে পরতে চাপা পড়ে আছে কত কাহিনী। কখনো লুৎফার সাথে সিরাজের প্রেমালাপ, কখনো নবাবী গলার দৃঢ় হুঙ্কার, কখনো কাতর আর্তি এ বাংলাকে বাঁচানোর, কখনো বাঁচাতে না পারার হতাশায় সিরাজের কান্না শুনতে পাবে, শুনতে পাবেই মীরজাফরের পৈশাচিক হাসি, শুনতে পাবে ঘসেটির রুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস, চিনতে পারবে জগৎ শেঠের স্বরূপ, ওই ওই শোনো… আজিমুন্নিসার বাঁচবার আর্তি শুনতে পাচ্ছ… শুনতে পাবেই, বিদেশীদের সেই ষড়যন্ত্র… আরো কত কিছু, আরো কত কী…
কত মহান ব্যক্তিত্বের মাতৃভূমি এই মুর্শিদাবাদ…খ্যাতনামা কীর্তন-গায়ক ফটিক চৌধুরী, বিখ্যাত কবিয়াল গুমানী দেওয়ান,
বিখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা গোবিন্দদাস,
বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শরচ্চন্দ্র পণ্ডিত (দাদা ঠাকুর), সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ও মহাশ্বেতা দেবী, বিখ্যাত গায়ক অরিজিৎ সিং ও গায়িকা শ্রেয়া ঘোষাল প্রমুখ।
আবার একই সাথে কত রাজার কত কীর্তি। কত উপাসনা গৃহ আকর্ষণ করবে তোমায়।
কী সে অমোঘ আকর্ষণ… সে কথা বলি কী করে?

“আমার প্রাণের শহর মুর্শিদাবাদ”