করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করল ভারতে। প্রথম যখন সারা পৃথিবীতে করোনা আছড়ে পড়েছিল সেই সময় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপে এই মারুন ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকায়। কিন্তু সেই সময়েও দৈনিক যত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হতেন সেই সীমারেখাটাও ছাপিয়ে গিয়েছে ভারত। বলতে গেলে রোজ নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করছে তারা। এইরকম ভয়াবহ অবস্থায় যেখানে লকডাউনকেই একমাত্র পথ বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একাংশ, সেখানে চুটিয়ে ভোট পর্ব চলছে একটি রাজ্যে। হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গের কথা বলা হচ্ছে। এরকম ঘটনা সত্যি জনস্বাস্থ্যের লড়াইয়ের ইতিহাসে বিরল নজির।

করোনা ভাইরাস ড্রপলেটের পাশাপাশি বায়ুবাহিত বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সবচেয়ে মুশকিল হচ্ছে এই ভাইরাস প্রতিনিয়ত তার রুপ বদল করছে। এই মুহূর্তে করোনার দুটি স্ট্রেন ভারতের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। একটা মহারাষ্ট্রের, অপরটি পশ্চিমবঙ্গের। সবচেয়ে ভয়ের কথা হল পশ্চিমবঙ্গের স্ট্রেনটি ট্রিপিল মিউট্যান্ট। অর্থাৎ এর প্রকোপ থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। এমনকি যাদের আগে করোনা হয়ে যাওয়ার ফলে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে তারা, বা যারা ইতিমধ্যেই করোনা প্রতিরোধী ভ্যাকসিন নিয়েছেন তাদের কারোর শরীর‌ই এই ভাইরাসের স্ট্রেনটি আটকাতে সক্ষম নয়। তার কারণ এটি করোনা ভাইরাস হলেও অভিযোজিত হয়ে সম্পূর্ণ নতুন রূপ ধারণ করেছে। তবে এর মারণ ক্ষমতা হয়তো ততটা বেশি নয় এই যা রক্ষ্যে। তবে যেভাবে হুহু করে মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে তাতে উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে অনেকে মারা যেতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যারা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের অনেককেই স্বল্প সময়ের জন্য হলেও হসপিটালে ভর্তি করতে হচ্ছে। সেখানে দু-তিনদিন অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়ার পর তারা আবার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসছেন। মুশকিল হচ্ছে বেশিরভাগ করোনা আক্রান্ত মানুষকে যদি অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে হয় তাহলে এই রাজ্য বা দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় তা সম্ভব নয়। বলতে গেলে দেশের অন্যান্য অংশের মতো এই পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ভেঙে পড়ার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র পথ নতুন সংক্রমনের সংখ্যা কমানো। আর করোনার মত এরকম সংক্রমিত মহামারী থেকে রক্ষা পেতে হলে, অর্থাৎ সংক্রমিতের সংখ্যা কমাতে হলে যতটা সম্ভব একে অপরের থেকে শারীরিকভাবে এড়িয়ে চলতে হবে। বাজার রাস্তাঘাটে কোথাও এই ভিড় করা চলবে না।

কিন্তু ভোট পর্ব চলার ফলে পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে একজায়গায় হাজারে হাজারে মানুষের জড়ো হওয়ার বিষয়টি নিয়মিত ঘটনা। নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। তেমন এটাও মাথায় রাখতে হবে সাধারণ মানুষের জন্যই এই সমস্ত বন্দোবস্ত। যদিও ভারতে বর্তমানে নির্বাচন গণতন্ত্রের থেকেও অনেক বেশি ক্ষমতা দখলের লড়াই হয়ে গিয়েছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলি এই নির্বাচনী যুদ্ধ থেকে সরে আসতে চাইছে না। আবার এই যুদ্ধের যারা রেফারি সেই নির্বাচন কমিশন মোটামুটি গোটা পরিস্থিতি থেকে হাত ধুয়ে ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনে লড়াই চলার ফলে সাধারণ মানুষের মনে বেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। তাদের সেই মনোভাবের প্রতিফলন ইভিএম মেশিনে ঘটার সম্ভাবনা আছে। তাই আমরা খুঁজে দেখব করোনা আবহে ভোট নির্বাচনী ফলে কি কি প্রভাব ফেলতে পারে।


১) মানুষ যত বীতশ্রদ্ধ হবে বিজেপির বিপদ বাড়বে-

সাধারণ মানুষের একটা বড়ো অংশের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে করোনা সংক্রমণ হওয়া সত্বেও নির্বাচনী প্রক্রিয়া না পিছানোর মূল কারণ বিজেপি। তাদের জন্যই নির্বাচন প্রক্রিয়া যেমন স্থগিত রাখা সম্ভব হয়নি তেমনই ভোটের দফা কমাতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। স্বাভাবিকভাবেই এই নিত্যনতুন সংক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি বিজেপির বিরুদ্ধে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের এই মনোভাব যদি ইভিএম মেশিনে ভোট দেওয়ার সময় কাজ করে তবে বিজেপির বিপদ আছে। বিপুল সংখ্যক ভোট বিজেপির বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের নির্বাচনী ফলাফল খুব একটা ভালো হবে না বলে মনে হয়।


২) করোনা প্রতিরোধে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা তৃণমূলের বিরুদ্ধে যাবে-

করোনা মোকাবিলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গ সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ অতীতে নিয়েছিল। কিন্তু কার্যকরী ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা গিয়েছে যতটা প্রচার হয়েছে সুফল ততটা পাওয়া যায়নি। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্য সরকার এবং শাসক দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে সংবেদনশীলতা অভাবের অভিযোগ উঠেছে বারবার। নতুন করে করোনার সংক্রমণ ডালপালা মেলতে শুরু করায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ আবারও মনে পড়বে রাজ্যবাসীর। সেক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের ভোট কিছুটা হলেও কমার কথা।


৩) বামপন্থীদের কাজ সংযুক্ত মোর্চার ডিভিডেন্ড হবে-

গতবছর করোনার প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কায় দেশজুড়ে যখন লকডাউন চলছে সেই সময় গোটা রাজ্য জুড়ে অভাবনীয় কাজ করেছিল বামপন্থীরা। তাদের কমিউনিটি কিচেন, শ্রমজীবী বাজার, করোনা আক্রান্ত বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর মত ঘটনাগুলি যথেষ্ট ছাপ ফেলেছিল রাজ্যবাসীর মনে। মূলত ওই ঘটনার পর থেকেই রাজ্যের একটা অংশের মানুষ বামেদের নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করে। এবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পর নির্বাচনে লড়াইয়ের পাশাপাশি বামেরা আবার আগের মতো সাধারণ মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তাদের এই কর্মকাণ্ড সংযুক্ত মোর্চার নির্বাচনী ফল অনেকটাই ভালো করতে পারে।


৪) ভ্যাকসিন নিয়ে নতুন কেন্দ্রীয় নীতি বিজেপির বিপদ বাড়াবে-

দেশের সাধারণ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা বলেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু দুদিন আগেই তারা যে নতুন নীতি ঘোষণা করেছে তাতে দেশবাসীকে ভ্যাকসিন প্রদানের অনেকটা দায় রাজ্য সরকারগুলির উপর ঢেলে দিয়েছে তারা। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্পূর্ণ বিনা খরচে রাজ্যের প্রতিটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য অনেক দিন ধরেই প্রস্তুত আছে বলে জানাচ্ছে। কিন্তু ভ্যাকসিনের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির উপর ছেড়ে দেওয়ার পর বিপদ ঘটে। সিরাম ইনস্টিটিউট তাদের তৈরি কোভিশিল্ডের নতুন দাম নির্ধারণ করেছে। তাতে প্রতিটি ডোজ কেনার জন্য রাজ্য সরকার গুলিকে ৪০০ টাকা খরচ করতে হবে। এই বিপুল পরিমান টাকার দায়ভার যদি একটি রাজ্য সরকারের ওপর চেপে বসে সেক্ষেত্রে অর্থনীতি দুর্বল হতে বাধ্য। সাধারণ মানুষ এই হিসাবটা বেশ ভালোই বোঝেন। স্বাভাবিকভাবেই করোনা প্রতিরোধে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আর এই প্রশ্ন নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলাকালীন বিজেপির বিপদ আরও খানিকটা বাড়িয়ে দেবে বলেই মনে হয়।


৫) গতবছরের লকডাউনের সময় নেতাদের ভূমিকা বিজেপির পথের কাঁটা-

গত বছর যখন লকডাউন হয় দেশে সেই সময় বামপন্থীরাই পথে নেমেছিল। তারা প্রতিটি সাধারণ মানুষকে সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করেছে। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের একাংশ‌ও নিজেদের মতো করে সাধারণ মানুষকে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের সাংসদরা লকডাউনের সময় নিজেদের এলাকায় যাননি। এই নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ আছে। তবে অন্যান্য নানা বিষয় এসে সেই ক্ষোভে প্রলেপ পড়েছিল। কিন্তু নতুন করে করোনা পরিস্থিতি মাথাচাড়া দেয় এবং লকডাউনের সম্ভাবনা উঁকি মারতে শুরু করার পরেই সেই দিনগুলো আবার মনে পড়ছে রাজ্যবাসীর। সাধারণ ভোটারদের এই স্মৃতি যদি ভোট দেওয়ার সময় কাজ করে তবে তা তৃণমূল এবং সংযুক্ত মোর্চার সহায়ক হবে বলে মনে হয়। এই মুহূর্তে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বিজেপির নেতাদের একাংশের গাজোয়ারি মনোভাব তাদের বিপদ আরও বাড়িয়েছে।