রাত পোহালেই ভোট গণনা শুরু হবে। এই গণনার ফলাফলের ভিত্তিতেই ঠিক হবে আগামী পাঁচ বছর পশ্চিমবঙ্গের দেখভাল করবে কারা। বর্তমানের এই ভয়ঙ্কর করোনা পরিস্থিতিতে এবারের নির্বাচনের ফলাফল অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ যারাই ক্ষমতায় আসুক তাদের প্রথম লক্ষ্য হবে রাজ্যবাসীকে করোনার এই ভয়াল গ্রাস থেকে রক্ষা করা। স্বাভাবিকভাবেই হাজার তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে যে পরীক্ষা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি, রবিবার শিক্ষক অর্থাৎ জনতা জনার্দনের দেওয়া রায়ের ভিত্তিতে তার ফল প্রকাশ হবে। সেই ফল প্রকাশের মহা মুহূর্তের ঠিক আগের দিন রাতে আমরা এবারের বিধানসভা নির্বাচনে উঠে আসা প্রধান দশটি উল্লেখযোগ্য দিক আপনাদের সামনে তুলে ধরব।


১) ভাঙা-গড়ার খেলা-

বাংলার রাজনীতি সম্বন্ধে বিশ্লেষকরা এক সময় বলতেন এ যেন ‘নিস্তরঙ্গ পুকুর’। এখানে ওঠাপড়া খুব কম। কারণ একদল থেকে অন্য দলে গিয়ে নেতাদের যোগ দেওয়ার ঘটনা খুবই বিরল ছিল পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু এবারের বিধানসভা ভোটের আগে এত দিনের চেনা ছবিটা এক লহমায় বদলে গেল রাজ্যবাসীর কাছে। অনেকে এই ছবি দেখে উৎফুল্ল হয়েছেন। তবে বেশিরভাগ জন‌ই ভবিষ্যতের কথা ভেবে আশঙ্কা অনুভব করেছেন। হতে পারে এতদিনের দেখা অভ্যস্ত ছবিটা হঠাৎ করে বদলে যাওয়াতেই তারা ঠিক মিলিয়ে নিতে পারেননি।

এবারের বিধানসভা ভোটের বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই ধাপে ধাপে দলবদলের খেলা চলছিল‌। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করার পরই ঝাঁকে ঝাঁকে তৃণমূলের বিধায়ক, নেতা এমনকি মন্ত্রীরা পর্যন্ত বিজেপিতে গিয়ে সামিল হন। একসময় পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে তৃণমূল থেকে কোন নেতা বিজেপিতে যাচ্ছেন না সেটাই খবরে পরিণত হচ্ছিল!


২) যোগদান মেলা-

ভোটযুদ্ধে জিততে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নানারকম ট্যাকটিস নিয়ে থাকে। কিন্তু অন্য দল থেকে নেতাকর্মীদের ভাঙিয়ে নিয়ে আসার জন্য ‘যোগদান মেলা’ শিরোনামে কর্মসূচি গ্রহণ করা পশ্চিমবঙ্গ কেন, গোটা ভারতবর্ষে সম্ভবত প্রথম! ২০২১ এর ভোট যুদ্ধে বারবার বিজেপির পক্ষ থেকে এই যোগদান মেলা আয়োজন করা হয়েছে। একটা সময় তৈরি হয়েছিল যখন প্রতিদিন রাজ্যের নানা প্রান্তে যোগদান মেলা আয়োজন করছিল বিজেপি। বাংলার রাজনৈতিক পটভূমিতে এ সত্যি মজার খেলা।


৩) নতুন যৌবনের দূত-

বামপন্থীদের গায়ে এক সময় তকমা লেগে গিয়েছিল তারা সাদা চুলের দল। এ রাজ্যে সর্ববৃহৎ বামপন্থী দল সিপিআই(এম)’কে বারবার কটাক্ষের সম্মুখীন হতে হয়েছে যে তারা বৃদ্ধাবাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এবারের বিধানসভা নির্বাচনে সৃজন, দীপ্সিতা, মীনাক্ষী, প্রতিকুর, চণ্ডীচরণ, আকিক, পৃথা, মোনালিসাদের মত এক ঝাঁক নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের প্রার্থী করে সেই দুর্নাম ঘুচিয়ে ফেলতে পেরেছে বামেরা। ভোটের লড়াইয়ে জিততে পারবে কিনা সেটা বলা সম্ভব নয়, কিন্তু আগামী দিনে এই নবীন প্রজন্ম যে বাংলার রাজনীতিতে হিল্লোল তুলতে সক্ষম হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এদের মধ্যে অনেকের বয়স এখনও ৩০ পেরোয়নি। তাই নিশ্চিত রূপে বলা যায় বাংলা আগামী দিনে তাজা রক্তের সৈনিক পেয়ে গিয়েছে এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।


৪) ঠাঁই নাই, বিদ্রোহ তাই-

এবারের বিধানসভা ভোটে প্রার্থী হতে না পেরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যেভাবে বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে ধরেছেন তাই এক উল্লেখযোগ্য বিষয়। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এই উদাহরণ আগামী দিনে লজ্জার গাথা হিসেবে লেখা থাকবে।

মূলত তৃণমূল এবং বিজেপির একের পর এক নেতাকর্মী টিকিট না পেয়ে বিক্ষোভ, অবরোধ, দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর, অন্য দলে যোগদানের মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন। তাদের এই ক্ষোভের হয়তো ন্যায্য কারণ ছিল। কিন্তু এই সমস্ত ঘটনা সার্বিকভাবে আমজনতার মনে রাজনীতি নিয়ে আরও খানিকটা বিতৃষ্ণা তৈরি করে দিতে সক্ষম হয়েছে। রাজনীতিবিদদের উচিত এই সমস্ত বিষয়ে আরেকটু দায়িত্বশীল হওয়া।


৫) ভাঙা পায়ে দাপিয়ে খেলা-

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক পথ এবং উদ্দেশ্য নিয়ে হাজারটা বিতর্ক আছে। কিন্তু তার লড়াকু ভাবমূর্তি এবং ক্ষমতা নিয়ে বোধহয় বাংলার একটিও মানুষ সংশয় প্রকাশ করবেন না। নন্দীগ্রামের বিরুলিয়া বাজারে ১০ মার্চ সত্যি তৃনমূলনেত্রীকে কেউ আহত করার চেষ্টা করেছিল নাকি গোটাটাই দুর্ঘটনা ছিল তা বিতর্কের বিষয়। এটাও বিতর্কিত যে এতদিন ধরে পায়ে প্লাস্টার বেঁধে রাখার সত্যি কোন‌ও দরকার ছিল কি না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু এটা নিয়ে বিতর্ক নেই যে পায়ে প্লাস্টার বাঁধা অবস্থাতেই একুশের বিধানসভার নির্বাচনে গোটা রাজ্য জুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।

হুইল চেয়ারে বসে রাস্তায় একের পর এক রোড শো করা, রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে গিয়ে সমাবেশ করা আর‌ও একবার সবার কাছে তুলে ধরল মমতার লড়াকু মনোভাবের পরিচয়। বিধানসভা নির্বাচনের ফল কি হবে তা পরের বিষয়। কিন্তু তৃণমূল শিবিরের মূল ভরসা যে তিনি তা আবারও বুঝিয়ে দিয়েছেন মমতা। তার দলের সমস্ত নেতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ থাকলেও আজও তিনি বাঙালির কাছে ‘ঘরের মেয়ে’। রবিবার ভোট গণনার সময় প্রমাণ হয়ে যাবে বাংলা তাদের এই ঘরের মেয়েকে চায় কিনা!


৬) নতুন জননেত্রীর উদ্ভব-

‘মীনাক্ষী মুখার্জি’ এই নামটার সঙ্গে এখন গোটা পশ্চিমবঙ্গবাসী পরিচিত। একুশের বিধানসভা নির্বাচন বাংলার রাজনীতিকে ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল জননেত্রী উপহার দিয়েছে। বিভিন্ন ভোট পরবর্তী সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে মীনাক্ষীর দল সিপিআই(এম) অত্যন্ত খারাপ ফল করতে চলেছে। শেষ পর্যন্ত তার নিজের দলের ফলাফল কি হবে সেটা পরের বিষয়, কিন্তু এটুকু পরিষ্কার রাজ্যের সমস্ত স্তরের মানুষের কাছে মীনাক্ষী মুখার্জির গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে গিয়েছে। আগামী দিনে তাকে মুখ করে যদি বামপন্থীরা এই রাজ্যে এগিয়ে যায় তাহলে সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে পেলেও পেতে পারে।

বাংলার অগ্নিকন্যা ঠিক যে পথ ধরে জননেত্রী হয়ে উঠেছিলেন, মীনাক্ষী মুখার্জিও কিন্তু সেই পথ ধরেই অগ্রসর হচ্ছেন। তাকে দেখার জন্য সমস্ত যুক্তি তুচ্ছ করে দিয়ে বিভিন্ন নির্বাচনী সমাবেশে গভীর রাত পর্যন্ত মানুষকে অপেক্ষা করতে দেখা গিয়েছে। এঘটনা বাংলার মানুষের সত্যি পরম প্রাপ্তির।


৭) বাংলা দখলে দিল্লি-

দিল্লি বাংলা দখল করতে চাইছে এটা তৃণমূলের রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা। এর কোন‌ও সারবত্তা আছে কিনা তা ভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু। কিন্তু এটা ঘটনা একুশের বিধানসভা নির্বাচনে দেশের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করলেন পশ্চিমবঙ্গে তা অতীতে কখনও ঘটেনি। বাংলা দখলে মরিয়া হয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘনঘন এ রাজ্যে সমাবেশ করলেন, নাকি তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে সভা-সমাবেশ করতে বাধ্য করলেন সে নিয়েও বিতর্ক আছে। তবে এটা ঠিক যে ভবিষ্যতে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস যখন লেখা হবে সেই সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এভাবে একটি অঙ্গ রাজ্যের নির্বাচনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘটনার কথাও উল্লেখ থাকবে। তবে সেই ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে নাকি সমালোচনার বানে জর্জরিত হবে তা কেবলমাত্র ভবিষ্যৎ‌ই বলতে পারবে।


৮) কেন্দ্রীয় বাহিনীর খামখেয়ালি দাপট-

এবারের বিধানসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলির পাশাপাশি অন্যতম আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। গোটা রাজ্যে যেভাবে বিপুল সংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে এসে ভোট করিয়েছে নির্বাচন কমিশন তা এককথায় অভূতপূর্ব। কিন্তু এই বাহিনীকে ঘিরে কম বিতর্ক তৈরি হয়নি। সবচেয়ে বড়ো বিতর্ক ঘটেছে চতুর্থ দফা ভোটের দিন, অর্থাৎ ১০ এপ্রিল। সেদিন কোচবিহার জেলার শীতলকুচিতে ভোট চলাকালীন সামান্য অজুহাতে ৪ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে মেরে ফেলে এই কেন্দ্রীয় বাহিনী। অথচ অনেক সময় দেখা গিয়েছে তাদের সামনে দুটি রাজনৈতিক দল হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েছে আর তারা নীরব দর্শক হয়ে গোটা বিষয়টি লক্ষ্য করছে।

শেষ দফার ভোটের দিনে নতুন করে বিতর্কে জড়ায় কেন্দ্রীয় বাহিনী। দায়িত্বে থাকা অবস্থাতেই হঠাৎ করে বাহিনীর আইজি সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে তারাপীঠে পুজো দিতে চলে যান। তাই বলা যায় একুশের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনীর খামখেয়ালি আচরণ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে আসলো।


৯) নির্বাচন কমিশন আসলে আস্ত ধাঁধা-

সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের হাতে অপরিসীম ক্ষমতা ন্যস্ত আছে। তারা সুষ্ঠুভাবে ভোট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে যাদের হাতে এত ক্ষমতা সেই তাদের নির্দিষ্ট কোনও পরিকাঠামো নেই। ভোট পর্ব পরিচালনার জন্য কখনও কেন্দ্রের কাছ থেকে নিরাপত্তা বাহিনী, কখনও রাজ্য প্রশাসনের কাছ থেকে আমলাতন্ত্র ধার নিতে হয় কমিশনকে। স্বাভাবিকভাবেই আমলাতন্ত্র বা কেন্দ্রীয় বাহিনীর ওপর তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্টিত হয় না। এটা দীর্ঘদিনের পরিচিত বিষয়। কিন্তু একুশের ভোটযুদ্ধে দেখা গেল নির্বাচন কমিশন শুরু থেকেই বজ্রপাতের মতো একের পর এক কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করে চলেছে। কিন্তু কাজের বেলায় খানিকটা লবডঙ্কার মত বিষয় ঘটল।

স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের মনে প্রবল প্রশ্ন তৈরি হয়েছে নির্বাচন কমিশন আদৌ কিছু করতে পারে কি? তাদের কি আদৌ কোনও কিছু করার ক্ষমতা আছে? এই ধাঁধার সমাধান নির্বাচন কমিশন যত দ্রুত করতে পারবেন ততোই মঙ্গল ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে।


১০) বিভাজনের বিষ বাষ্পে জর্জরিত বাংলা-

একুশের বিধানসভা নির্বাচন বাংলাকে যদি সবচেয়ে খারাপ কিছু দিয়ে থাকে তা হল বিভাজনের রাজনীতি। পশ্চিমবঙ্গে বিভাজনের রাজনীতি এর আগে ছিল না বিষয়টা মোটেও তেমন নয়। তা বরাবরই অবস্থান করেছে এই রাজ্যে। কিন্তু কখনও এরকম তীব্র আকার ধারণ করেনি। কিন্তু এবারের নির্বাচনী লড়াইয়ে বিজেপি শুরু থেকেই ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটিয়ে ভোট আদায়ের চেষ্টা করেছে। পাল্টা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মীয় মেরুকরণের রাস্তায় হেঁটেছে বেশ কিছু জায়গায়। সব মিলিয়ে রাজ্যে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাসের স্থায়ী বাতাবরণ তৈরি হয়ে গিয়েছে। এই বিভাজনের বিষবাষ্প থেকে আগামী দিনে আদৌ বাংলার মুক্তি ঘটবে কিনা তা নিয়ে সত্যি সন্দেহ আছে। তবে এ যা হল তা মোটেও ভালো হল না রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কর্মভূমিতে!