চতুর্থ দফার ভোট হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই হিংসার ঘটনায় একেবারে খবরের শিরোনামে থাকছে ১০ এপ্রিল হয়ে যাওয়া চতুর্থ দফার নির্বাচন। কেন্দ্রীয় বাহিনী গুলি চালিয়েছে কোন‌ও কিছু বিবেচনা না করে, এরকম একটা সম্ভাবনার কথা সর্বত্র উঠে আসছে। একইসঙ্গে আরেকটা প্রশ্ন জাগছে এই চতুর্থ দফার ভোট হঠাৎ কেন এতটা হিংসাত্মক হয়ে উঠল? যে ৪৫ টি কেন্দ্রে ভোট হয়েছে সর্বত্র একের পর এক হিংসার ঘটনা সামনে এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা এই দফাতেই নির্বাচন দক্ষিণবঙ্গের গন্ডি ছাড়িয়ে উত্তরবঙ্গ প্রবেশ করল। সব মিলিয়ে বলা যায় চতুর্থ দফার ভোট এবং ভোট পরবর্তী ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে জমজমাট।

মূল একটা প্রশ্ন সর্বত্র তৈরি হয়েছে চতুর্থ দফার ভোট কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল? আমরা এই প্রশ্নটাকে সামনে রেখেই বিশ্লেষণ করব প্রতিটি রাজনৈতিক পক্ষের কাছে চতুর্থ দফার নির্বাচন ঠিক কি কি কারনে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।


[  ]  তৃণমূলের হিসেব মেলানোর দফা-

চতুর্থ দফার ভোট অনুষ্ঠিত হয় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার মিলিয়ে রাজ্যের মোট ৪৫ টি কেন্দ্রে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বিচার করলে তৃণমূলের সবচেয়ে নিশ্চিন্ত ঘাঁটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ভোট এই চতুর্থ দফাতেই সম্পূর্ণ হয়ে গেল। আবার গত লোকসভা নির্বাচনের পর তাদের বদ্ধভূমি হিসেবে উঠে এসেছে যে কোচবিহার জেলা সেখানেও ভোট ছিল এই চতুর্থ দফাতেই। সবমিলিয়ে বলা যেতে পারে তৃণমূলের কাছে চতুর্থ দফার ভোট আসলে ছিল নবান্ন দখলের ক্ষেত্রে হিসেব মেলানোর ধাপ।

উত্তরবঙ্গের ক্ষতি সামাল দিতে হলে দক্ষিণবঙ্গের নিশ্চিন্ত ঘাঁটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় তৃণমূলকে বরাবরের মতো একচেটিয়া সাফল্য পেতে হবে। গত লোকসভা নির্বাচনের ফলেও এই জেলায় বিরোধীদের সম্পূর্ণ ধরাশায়ী করেছিল তৃণমূল। এখানকার ৩১ টি বিধানসভা কেন্দ্রের একটিতেও এগিয়ে ছিল না বিরোধীরা। কিন্তু ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকর উত্থান এবং তার দলের সঙ্গে বামেদের হাত মেলানোর ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রভাবিত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ভোটচিত্র অনেকটাই বদলে গিয়েছে। তৃণমূলের এই ঘাঁটিতে একেবারে সমানতালে ভোটের দিন তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে সংযুক্ত মোর্চা।

আগাম হিসেবে মনে করা হয়েছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় বিজেপির অস্তিত্ব সেভাবে টের পাওয়া যাবে না। কিন্তু ভোটের দিন দেখা গেল সংযুক্ত মোর্চা এবং তৃণমূলের পাশাপাশি ভোট ময়দানে যথেষ্ট লড়াই দিয়েছে বিজেপি। সব মিলিয়ে তৃণমূলের হিসেব ওলট-পালট হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আবার গত লোকসভা নির্বাচনে যে হুগলি জেলায় ভালোমতো প্রভাব বিস্তার করেছিল বিজেপি সেখানে অনেকটাই নিজেদের জমি ফিরে পেয়েছে তৃণমূল। একই কথা খাটে উত্তরবঙ্গের কোচবিহারের ক্ষেত্রে। গত লোকসভা নির্বাচনে এই জেলায় একচেটিয়া সাফল্য পেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু ভোটের দিন দেখা গেল তাদের সঙ্গে কড়ায়-গণ্ডায় পাল্লা দিয়ে দৌড়াচ্ছে তৃণমূল।

সব মিলিয়ে এটুকু বোঝা গিয়েছে চতুর্থ দফার ভোটে যাবতীয় হিসেব নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মরিয়া লড়াই লড়ে গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। কারণ পরবর্তী ধাপে যে জেলাগুলিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা সেগুলিতে তৃণমূলের অবস্থান ততটাও আর শক্তিশালী নয়। তাই যাবতীয় হিসেব-নিকেশ মিটিয়ে নেওয়ার জন্য এই চতুর্থ দফা ছিল তাদের কাছে আদর্শ ক্ষেত্র।


[  ]  সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও ভোটে হিসেব যেন ঠিক মিলল না বিজেপির-

২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের পর বাংলা জয়কে টার্গেট করে বিজেপি। সেইজন্য তারা দ্রুত খুঁজে বার করেছিল পশ্চিমবঙ্গের কোন কোন জায়গায় তাদের দুর্বলতা এবং শক্তি আছে। সেই হিসেবে চতুর্থ দফার নির্বাচন তাদের কাছে ছিল একরকম অগ্নিপরীক্ষা। কারণ কোচবিহারের মত হাতে থাকা জায়গায় যেমন ভোট ছিল, তেমনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মত বধ্যভূমিতে গিয়ে হাজির হতে হয়েছিল বিজেপিকে। যদিও ভোটের দিন সার্বিক যে ছবি উঠে আসলো তাতে এটুকু বলা যায় আগের যাবতীয় হিসেব-নিকেশ কোথাও গিয়ে যেন ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে গেরুয়া শিবিরের কাছে।

চতুর্থ দফার ভোটে যে সমস্ত কেন্দ্রে বিজেপি জিতে যেতে পারে বলে মনে হচ্ছিল সেরকম অনেক জায়গাতেই তারা পোলিং এজেন্ট দিতে পারেনি। দক্ষিণবঙ্গের হুগলি এবং হাওড়া জেলায় বিজেপির ফলাফল অত্যন্ত ভাল হবে বলে একসময় মনে হচ্ছিল। অথচ এই দুই জেলায় তৃণমূলের পাশাপাশি তাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে সংযুক্ত মোর্চা। চতুর্থ ধাপের ভোটের দিনের একটি ভিডিও সর্বত্র ভাইরাল হয় যা প্রতীক হিসেবে প্রমাণ করে দিচ্ছে এই নির্বাচনে বিজেপি ঠিক কতটা চাপে পড়ে গিয়েছে। হুগলি জেলার চুঁচুড়ার বিজেপি প্রার্থী লকেট চ্যাটার্জি ভোটের দিন তার নির্বাচনী কেন্দ্রের অন্তর্গত একটি অঞ্চলে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময় হঠাৎই তিনি গাড়ির ভেতর থেকে নিজেই নিজের গাড়ির কাঁচ ভেঙে ফেলেন। পরে অভিযোগ করেছিলেন তৃণমূল সমর্থকরা তার গাড়ির কাচ ভেঙে দিয়েছে।

লকেট চ্যাটার্জি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর দাবি উঠেছে বিজেপি নেতৃত্ব মানুষের সহানুভূতি আদায় করতে নিজেরাই নিজেদের গাড়ির কাঁচ ভেঙে অভিযোগ জানান। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনা গেরুয়া শিবিরের যথেষ্ট মুখ পুড়িয়েছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় চতুর্থ দফার ভোটে বিজেপির পক্ষে আশার আলো কিছুই বলতে গেলে নেই।

তবে যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে চতুর্থ দফার ভোট সর্বত্র আলোচনায় উঠে এসেছে সেই কোচবিহার জেলার শীতলকুচি বিধানসভার জোড়া পাটকি অঞ্চলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে গ্রামবাসীদের মৃত্যুর ঘটনায় ব্যাপক বেকায়দায় পড়েছে বিজেপি। প্রথমদিকে তারা তৃণমূল সমর্থকদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় বাহিনীর অস্ত্র ছিনতাইয়ের অভিযোগ সামনে তুলে আনে। সেইসঙ্গে দাবি করেছিল বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার স্বার্থে কেন্দ্রীয় বাহিনী গুলি চালিয়েছে। যদিও বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ্যে আসতেই দেখা যায় গুলি চালানোর মতো পরিস্থিতি ঐদিন জোড়া পাটকিতে সম্ভবত তৈরি হয়নি। এরপরই বিজেপির বিরুদ্ধে একরাশ অভিযোগ নিয়ে আসরে নেমে পড়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে সংযুক্ত মোর্চাও বিজেপি নেতৃত্বকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। সব মিলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ চতুর্থ দফার ভোটে শুধু ব্যাকফুটে যাওয়া নয়, বাকি আরও চারটি দফার ভোটে বিজেপি রীতিমতো বেকায়দায় পড়ে গিয়েছে। সাধারণ রাজ্যবাসীর একাংশের মনে তাদের প্রতি প্রবল অসন্তোষ তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যেই।


[  ]  লড়াইয়ে ফিরে আসল সংযুক্ত মোর্চা-

তৃণমূল এবং বিজেপির সঙ্গে টক্কর দিয়ে লড়াইয়ে ফিরে আসার জন্য সংযুক্ত মোর্চার কাছে চতুর্থ দফার ভোট শেষ সুযোগ ছিল। সেই সুযোগকে ভালোমতো কাজে লাগিয়ে তারা রীতিমতো লড়াইয়ে ফিরে এসেছে। তবে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার জেলায় যে ভোট হয়েছে সেখানে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি সংযুক্ত মোর্চা। যদিও দক্ষিণবঙ্গের বাকি তিন জেলায় রীতিমত সমানে সমানে টক্কর দিয়ে গিয়েছে তারা। এই চতুর্থ দফাতেই একাধিক হেভিওয়েট মোর্চা প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যা পরিস্থিতি তাতে মোর্চার এই হেভিওয়েট প্রার্থীদের অনেকেই চতুর্থ দফার ভোটে জিতে যেতে পারেন।

সবমিলিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে বলা যায় চতুর্থ দফার ভোট সংযুক্ত মোর্চার কাছে চূড়ান্ত এক অক্সিজেন হিসেবে উঠে এসেছে। তারা যে মোমেন্টাম পেয়েছে তাতে বাকি চারটি দফার ভোটে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে তৃণমূল এবং বিজিপি দুই হেভিওয়েট প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে যথেষ্ট ভালো ফলাফল করতে পারে।


চতুর্থ দফার ভোটর দিনের অশান্তির কারণে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে রাজ্য রাজনীতিতে। বাকি চারটি দফার ভোটে ৭২ ঘন্টা অর্থাৎ তিন দিন আগে প্রচার থামিয়ে দিতে বাধ্য হবে প্রতিটি রাজনৈতিক দল। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এই নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। বলা যেতে পারে চতুর্থ দফা ভোটের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বাকি চারটি দফার জন্য নতুন বেশকিছু পদক্ষেপের সম্মুখীন হতে চলেছে বাংলা। একইসঙ্গে ১০ এপ্রিলের ভোটের দিনের হিংসার ঘটনার কথা মাথায় রেখেই বাকি চারটি দফায় ভোট দিতে যাবেন রাজ্যবাসীর একাংশ। এখানেই বোধহয় চতুর্থ দফার ভোটের মূল তাৎপর্য লুকিয়ে আছে।