টক্সিক প্যারেন্টিং – জেনে নিন বিষাক্ত অভিভাবকত্বের 15 টি লক্ষণ – লিখেছেন মৌমিতা ব্যানার্জী

বাবা মা মানেই ভগবান, তাদের স্থান সবার উপরে। বাবা মা মানেই তাদের সব রকম অধিকার আছে বাচ্চার উপর। কথাগুলো ঠিকই, কিন্তু এর নেগেটিভ দিকটা আমরা ভেবে দেখিনা। বাচ্চাকে প্রতিপালন করতে গিয়ে যত্ন করাও দরকার যেমন, তেমনি প্রয়োজনে শাসন বা বকাঝকা করা অবশ্যই দরকার, কিন্তু সেটার একটা সীমা আছে। সীমা পেরোলে অতিরিক্ত শাসন হোক বা অতিরিক্ত কেয়ারিং, তা রীতিমতো অত্যাচারে পরিণত হয়। বাবা-মা মানেই বাচ্চার সাথে যা খুশি করার অধিকার নেই। না বুঝে বহু বাবা-মা এই ভুল করে থাকে, একে বলে টক্সিক প্যারেন্টিং। এর দ্বারা বাচ্চার মধ্যে ইমোশনাল ও সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম দেখা দিতে পারে, অ্যাডাল্ট বয়েসে ক্লিনিকাল হেল্প দরকার হতে পারে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ বাবা-মা এখনো Toxic Parenting টার্মটার সাথে পরিচিতই নন, অনেকেই জানেন না প্যারেন্টিং-এর guidelines. আসুন দেখে নেই কোন কোন ব্যবহারগুলি টক্সিক প্যারেন্টরা করে থাকেন:

1. অতিরিক্ত ভালোবাসা

হ্যাঁ, মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা, সাবধানতা, যত্ন, protection- এর কোনোটাই বাচ্চার নিজস্ব ব্যক্তিত্বের বিকাশের পক্ষে ভালো নয়। মা-বাবাকে মনে রাখতে হবে বাচ্চা একটি সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ, সেভাবেই তাদের সাথে মিশতে হবে। তারা মনে করে মা-বাবার কাছে বাচ্চা চিরকালই ছোট থাকে, আসলে তারা বাচ্চাকে সাবধানে রাখতে গিয়ে তাকে সাধারণ স্বাভাবিক ছন্দে বেড়ে ওঠার থেকে আটকে দেন। সাবধান থাকা দরকার, যত্ন ভালোবাসাও দরকার, কিন্তু কোনোটাই অধিক নয় যাতে সেটা বাচ্চার জন্য ক্ষতিকারক হয়। 

 2. নিশ্চয়তা ও সুরক্ষা দিতে অপারগ

কিছু বাবা মা আছেন যারা বাচ্চাকে টাফ তৈরী করতে চান, যাতে বাচ্চা ভবিষ্যতে জীবনের কঠিন চ্যালেঞ্জগুলির মুখে পড়েও সোজাভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। তারা ভুলে যান একটা বাচ্চার একটা নির্দিষ্ট বয়েস পর্যন্ত কোমল আচরণ, যত্ন, ভালোবাসার দরকার আছে। তারা বাচ্চাকে ছোট বয়েসেই কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দেন, strict behave করেন। তারা বিশ্বাস করেন এর দ্বারা বাচ্চার ভবিষ্যতে ভালো হবে। কিন্তু না, পরবর্তীকালে বাচ্চাটি যখন ব্যর্থ হয় বা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, তার দায় কিন্তু অবশ্যই বাবা মায়ের উপেক্ষার। তারা বাচ্চাকে সঠিক নিশ্চয়তা ও সুরক্ষা দিতে পারেনি যা সেই সময়ে তার দরকার ছিল। 

3. চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাব

বাবা মায়েরা প্রায়শঃই বাচ্চার উপর তাদের ইচ্ছে, মতামত চাপিয়ে দেন। রাতের খাওয়া থেকে ঘুরতে যাওয়ার সময় কি জামা পরবে, কতক্ষন খেলবে, কতক্ষন পড়াশুনো করবে, কাদের সাথে বন্ধুত্ত্ব করবে, কি সাবজেক্ট নিয়ে higher studies করতে হবে… সবটা মা-বাবাই ঠিক করে দেন। এতে করে বাচ্চার ডিসিশন নেবার সাহস, নির্বাচন ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস হ্রাস পায়। বাচ্চা নির্ভরশীল হয়ে ওঠে।  ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিজের অপছন্দের জিনিসটা করতে গিয়ে বাচ্চার নিজের ও মা-বাবার প্রতি বিরক্তি ও ঘৃণা চলে আসে। তাই এই নিজেদের ইচ্ছে চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাব থেকে বেরোতে হবে অবিলম্বে, বাচ্চাকে স্বাধীনতা দিতে হবে নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করার।

4. অতিরিক্ত নিন্দা ও সমালোচনা

বাচ্চাকে অবশ্যই তার ভুল ধরিয়ে দেওয়া উচিত, বা তার ভুল বা অন্যায় ঢাকাও ঠিক নয় যাতে সে ভবিষ্যতে অনুচিত কাজ করতে উৎসাহ না পায়। কিন্তু তাকে সর্বদা পান থেকে চুন খসার জন্য দোষারোপ করা ভুল। বাইরের লোকের সামনে বাচ্ছাকে বকা, বাচ্চার ভুলের নিন্দা করা, সমালোচনা করা ও তাকে সরাসরি দোষারোপ করা মোটেই উচিত নয়। বাচ্চার ভুল হলেও সেই ভুলগুলি সহানুভূতির সাথে সংশোধন করে তাকে উৎসাহ ও প্রেরণা দেওয়া উচিত যাতে আবার কাজটি সে ত্রুটিহীনভাবে করতে পারে। 

5. উশৃঙ্খল জীবনযাপন

বাবা-মায়ের উশৃঙ্খল জীবনযাপনের প্রভাব বাচ্চাদের ওপরে সরাসরি পড়াটাই স্বাভাবিক।  বাবা মা অনিয়মিত অভ্যাসে অভ্যস্থ হলে, বাচ্চা ছোট থেকে সেটাই রপ্ত করে। বাচ্চাকে সময় না দিয়ে বাবা বা মায়ের, বা দুজনেরই ঘন ঘন বেরিয়ে যাওয়া, বাড়িতে রোজ রোজ বন্ধুদের আড্ডা বসানো, নেশা করা, বাচ্চাকে দাদু-দিদার কাছে রেখে মাঝে মাঝে ৪/৫দিনের ট্যুরে যাওয়া.. এসব আচরণ বাচ্চার প্রচন্ড মানসিক ক্ষতি করে। বাচ্চা নিজেকে আলাদা করে নেয়, নিঃসঙ্গ বোধ করে।

parenting
vox.com

6. সুস্থ স্বাভাবিক গণ্ডী  না রাখা

বাচ্চাদের, বিশেষ করে টিনেজারদের, নিজেদের মতো করে বড়ো হতে দিতে গেলে কিছু লিমিট রাখা জরুরি, তাদের স্পেস দিতে হবে নিজেদের ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য। সব কিছুতে মাথা গলানো, সব ব্যাপারে মত প্রকাশের দরকার পড়েনা। যেমন পরনের জামা বা গল্পের বই ওকেই বাছতে দিন, একটা বয়েসের পর তার ঘরে নক করে ঢোকা উচিত। তাদের নিজ্বস্ব জগৎ তৈরী হতে দিতে হবে। স্বচ্ছন্দ ও স্বাধীনভাবে বাচ্চাকে বেড়ে উঠতে দিযে বাচ্চার আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

7. বাচ্চাকে অন্যায়বোধ ও টাকার জোরে কন্ট্রোল করা

সব বাচ্চারই কখনো না কখনো অপরাধবোধ কাজ করে। Result খারাপ করলে, ঘরের কোনো দামী জিনিস নষ্ট করলে, বন্ধুদের সাথে ঝগড়া হলে বা বাবা-মায়ের সাথে মতের অমিল হলেও বাচ্চা নিজেকে অপরাধী ফীল করে। কিছু বাবা-মায়েরা বাচ্চাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সেই অপরাধবোধকেই কাজে লাগায়, blackmail করে, tease করে। বাচ্চা অন্যায় করে ফেললে তাকে অতিরিক্ত গিল্টি ফীল করানো হয়। কিংবা বাচ্চাকে পকেট মানি দেওয়া নিয়ে taunt করা বা সকলের সামনে লজ্জিত করাও ভীষণভাবে অনুচিত। 

8. বাচ্চার মনে ভীতি সঞ্চার করা

অনেক সময়ই অভিভাবকরা সম্মান করা আর ভয় করাকে গুলিয়ে ফেলেন। বাচ্চাকে মারধর করে, ভয় দেখিয়ে, খারাপ ব্যবহার করে কিছুর সমাধান করতে চাওয়াটা ভুল। বাচ্চার মনে অভিভাবকের প্রতি সম্মান, সম্ভ্রম থাকবে, সে তার অভিভাবকদের ইচ্ছের মর্যাদা দেবে, এটাই সুস্থ প্রতিপালনের লক্ষন। বড়ো হয়েও যদি বাচ্চার মনে মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা না থেকে ভীতি থাকে, তার একমাত্র কারণ সেই বাজে অভিভাবকত্ব।

9. নিজেদের দুঃখ সুখের দায় চাপানো

মা-বাবারা নিজেদের অজান্তেই বাচ্চাকে আমাদের সুখ বা দুঃখের কারণ বলে ভেবে থাকি। মায়ের ক্যারিয়ার স্যাক্রিফাইস, বাবার ট্রান্সফার না নেওয়ার মতো সিদ্ধান্তের ভার, তাদের জীবনের দুঃখের কারণ বাচ্চার দায়িত্ব নয়।বাচ্চাদের থেকে তাই নিজেদের সুখের জন্য কোনো ডিমান্ড করা যাবেনা। বাবামায়ের অযৌক্তিক চাহিদার দায়ভার কোনো বাচ্চার ওপরেই বর্তায় না।

10. সকলের সামনে ছোট করা

বাচ্চাদের ইমোশনাল নিড না বুঝে বাবা-মায়েরা অনেক সময়েই অন্যের সামনে বাচ্চাকে ছোট করে কথা বলে থাকে বা বকাবকি করে থাকে। বাইরের লোকের উপস্থিতিতে বাচ্চাকে নিয়ে বোকা বোকা মজা করা বা বাচ্চাকে হাসির খোরাক করা বা ছোট করে কথা বললে বাচ্চা নিজেকে গুটিয়ে নেবে এবং তার আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগবে যা চিরস্থায়ীও হতে পারে।

এছাড়াও বাচ্চার সাথে অজান্তে কম্পেটিশন করা, নিজেদের অন্যায় justify করা, কাজের ছুতোয় বাচ্চার থেকে দূরে থাকা, বাচ্চাকে দরকারমতো সাপোর্ট না করা, নিজের ইচ্ছে বা জেদ বজায় রাখা, সন্তানকে ইম্পর্টেন্স না দেওয়া – এই সব কারণ গুলোই বাচ্চার মনের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। সেই কারণে বাবা বা মায়ের মধ্যে অন্তত একজনকে বাচ্চার নির্মল নিষ্পাপ মনকে বোঝার দায়িত্ব নিতে হবে। বাচ্চার শৈশবের অকৃত্রিম আনন্দ সুরক্ষিত করতে হবে, তাকে দিতে হবে সুস্থ পরিবেশ যা ভবিষ্যতে বাচ্চার চারিত্রিক দৃঢ়তা নির্দিষ্ট করবে। সন্তানের প্রতি দায়িত্ব, ভালোবাসা সব থাকবে কিন্তু সব কিছুরই লিমিট থাকা দরকার যাতে বাচ্চা নিজেকে নিজে গড়ে তোলার অবকাশ পায়। উপরের কারণগুলোর মধ্যে ৩টি কারণও যদি আপনার প্যারেন্টিংয়ের সাথে মিলে যায়, তাহলে  আপনি নিজের কাউন্সেলিং করাবেন আপনার সন্তানের স্বার্থে।