বঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের তৃতীয় ও চতুর্থ দফার ভোট অনুষ্ঠিত হবে ৬ এবং ১০ এপ্রিল। এই দুই দফার ভোট আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে একরকমের অগ্নিপরীক্ষা। ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের পর তৃণমূলের গড় হিসেবে যে জায়গাগুলি এখনও পরিচিত হয়ে আছে সেখানে এই দু’দফাতেই ভোট হতে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই দুটি দফায় যত বেশি সম্ভব স্ট্রাইকরেট রাখার চেষ্টা করবে তৃণমূল, যাতে নবান্ন দখলে রাখা সম্ভব হয়।

ভোটের রাজনীতির হিসেব-নিকেশ বলছে এই দুটি দফায় রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল যদি ঝড়ো ব্যাটিং না করতে পারে তাহলে ১০ বছর পর নবান্নের গদি ছাড়তে হতে পারে তাদেরকে। কেবলমাত্র গড় ধরে রাখাই নয়, এই দুটি দফার ভোট যে সমস্ত জায়গায় হচ্ছে তার কিছু কিছু জায়গায় তৃণমূলের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ‌ও জড়িয়ে আছে। তাই আমরা দেখে নেব কোন পাঁচটি মূল কারণের জন্য তৃতীয় ও চতুর্থ দফার বিধানসভা নির্বাচন রাজ্যের শাসকদলের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।


[  ] গড় রক্ষা করা-

একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পর বাংলায় কারা সরকার গঠন করবে তা ২ মে ভোটের ফল প্রকাশের আগে জানা কোনও মতেই সম্ভব নয়। কিন্তু কোন‌ও একটি রাজনৈতিক দলের কাছে নির্দিষ্ট গড় বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তা সেই রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকুক, বা না থাকুক। নিজের গড় বলে যদি কিছু না থাকে তবে সেই রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ সঙ্কটপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ঠিক যেরকম অবস্থা দেখা গিয়েছিল বামফ্রন্টের। ২০১১ এর বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতা হারানোর পর বামেদের গড় বলে কিছু ছিল না। গোটা রাজ্যে যথেষ্ট প্রভাব ছিল তাদের, কিন্তু তা সবই বিক্ষিপ্ত আকারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। অথচ মুর্শিদাবাদ, মালদার মত জেলাগুলি কংগ্রেসের গড় হিসেবে পরিচিত হওয়ায় তারা দীর্ঘদিন রাজ্যে ক্ষমতায় না থাকলেও আজও বাংলার রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে।

সেই জন্য এই দুই দফায় যে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় ভোট হবে তা তৃণমূলের গড় হিসেবে বহুল প্রচলিত। ক্ষমতা ধরে রাখতে গেলে এই গড়েতে যেমন অত্যন্ত ভালো রেজাল্ট করতে হবে জোড়া ফুল শিবিরকে, তেমনি ক্ষমতা থেকে চলে যাবার পর নিজেদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে গেলেও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ঘাঁটি ধরে রাখাটা তাদের কাছে অত্যন্ত জরুরী।


[  ] উত্তরের জমি উদ্ধার-

২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জিতে দ্বিতীয়বার রাজ্যে সরকার গড়ে তৃণমূল। ওই নির্বাচনে দেখা গিয়েছিল মালদা বাদে উত্তরবঙ্গের বাকি সমস্ত জায়গায় প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেছে তারা। বিক্ষিপ্ত অল্প কিছু কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস এবং বামেরা। কিন্তু ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের পর দেখা গেল উত্তরবঙ্গে প্রায় ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে জোড়া ফুল শিবির। বাংলায় তৃতীয়বারের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যদি সরকার গড়তে হয় তবে উত্তরবঙ্গের এই হারানো জমি তাকে পুনরুদ্ধার করতেই হবে। চতুর্থ দফার নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার জেলায় নির্বাচন। এই দুই জেলাতেই বিজেপির একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই চতুর্থ দফার ভোটে বিজেপির আধিপত্যকে কাটিয়ে উঠে এই যায়গায় তৃণমূল কতটা ভালো ফল করতে পারে সেদিকেই মূল লক্ষ্য থাকবে সবার।


[  ] জমি আন্দোলনের ঐতিহ্য ধরে রাখার লড়াই-

২০০৬ সালের সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পর সিঙ্গুরে টাটা মোটরসের কারখানা গড়ে তোলাকে কেন্দ্র করে এ রাজ্যে নতুন করে জমিয়ে আন্দোলনের সূচনা ঘটে। সিঙ্গুর আন্দোলন পরবর্তীকালে নন্দীগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। এই জমি আন্দোলনের ওপর ভর করেই দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিঙ্গুরে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে প্রায় দশ হাজার ভোটে পিছিয়ে পড়ে তৃণমূল। ১০ এপ্রিল চতুর্থ দফার ভোটের দিন সিঙ্গুর বাসীরা আগামী পাঁচ বছরের জন্য তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার জন্য ভোট দেবেন। এই দুটি দফার নির্বাচন তাই তৃণমূলের কাছে জমি আন্দোলনের ঐতিহ্য ধরে রাখার লড়াই‌ও বটে। ইতিমধ্যেই নন্দীগ্রামের ভোট হয়ে গিয়েছে, এবার সিঙ্গুর। এই জমি আন্দোলনের ঐতিহ্য যদি কোনভাবে তৃণমূলের হাতছাড়া হয়ে যায় তবে তাদের কাছে এটা অত্যন্ত বড়ো ধাক্কা হবে।


[  ] আব্বাস নয় তারাই যে সংখ্যালঘু ভোটের মূল নিয়ন্ত্রক তা প্রমাণ করার তাগিদ-

২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচন থেকে এ রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের দিকে ঘুরতে শুরু করে। ২০১১ এর বিধানসভা ভোটে দেখা যায় দীর্ঘদিনের সংখ্যালঘু ভোট হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে বামেদের। এই সংখ্যালঘু ভোটের ওপর নির্ভর করেই গত ১০ বছর পশ্চিমবঙ্গে অপ্রতিরোধ্য ছিল তৃণমূল। কিন্তু এবারে বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন।

আব্বাস সিদ্দিকীর দল এবারের বিধানসভা ভোটে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গঠন করে সংযুক্ত মোর্চা গড়ে তুলেছে। তাই এবারের ভোটে তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটারদের ওপর আব্বাস ভাগ বসাবে বলে অনেকের ধারণা। এই দুটি দফায় নির্বাচন যেখানে হবে তার মধ্যে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় মুর্শিদাবাদের পর সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে। এছাড়াও হাওড়া, হুগলি এবং কোচবিহার জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের যথেষ্ট পরিমাণ উপস্থিতি আছে। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই দফায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সমর্থন তৃণমূল কতটা পাবে তার ওপর ভোটের সার্বিক ফল অনেকটাই নির্ভর করছে। উল্লেখ্য আব্বাস সিদ্দিকীর নিজের জেলা হল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। এই জেলা যেমন তৃণমূলের, তেমনি আব্বাস সিদ্দিকীর‌ আঁতুড়ঘর। বলা যায় এবারের নির্বাচনে এই জেলাটি তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের কাছে এটা বড়ো চ্যালেঞ্জ।


[  ] সংযুক্ত মোর্চার প্রবল উপস্থিতি-

তৃতীয় এবং চতুর্থ দফায় যে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলিতে ভোট হবে সেখানে বিজেপি বিরোধী হিসেবে প্রবল উপস্থিতি আছে সংযুক্ত মোর্চির। স্বাভাবিকভাবেই বিজেপির ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সেক্ষেত্রে তৃণমূল যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা আগাম বলাই যায়। তাই রাজ্যের ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে বিজেপির পাশাপাশি এই অঞ্চলে সংযুক্ত মোর্চার চ্যালেঞ্জ‌ও সামলাতে হবে তৃণমূলকে।