নোবিতা ডোরেমনের নাম শোনে নি এমন বাচ্চা সারা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। নোবিতা আর তার বন্ধুদের নানা খুনসুটি, সেই সঙ্গে ডোরেমনের ম্যাজিক গ্যাজেটের অত্যাশ্চর্য কারসাজি আমাদের ছোটোবেলাকার সঙ্গী। আর অদ্ভুত সুরের সেই ‘জিন্দেগী সফর হো’ গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছেলেবেলার নস্টালজিয়া। সকালে স্কুল থেকে ফিরেই হোক বা দুপুরে খাওয়ার সময়, ডিজনি চ্যানেল আর ডোরেমন নোবিতা ছিল বরাবরের নিত্যসঙ্গী।

doraemon nobita shizuka 1

এহেন নোবিতা, যে আমাদের স্মার্টফোন বিহীন ছোটোবেলাকে মাতিয়ে রেখেছিল, আমরা অনেকেই হয় তো জানি না তার পিছনে লুকিয়ে আছে একটা করুণ ইতিহাস। কাল্পনিক কার্টুন নয়, নোবিতা ডোরেমনের গল্পে রয়েছে এক বাস্তব ঘটনার অনুসঙ্গ। বিষাদের করুণ সুর সেই ঘোর বাস্তবের পরতে পরতে মিশে রয়েছে। ছোটোবেলার নস্টালজিয়ার আলোকে এক নিমেষেই নিভিয়ে দেয় সেই বাস্তব কাহিনী। কী সেই গল্প? তা জানার আগে একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক ডোরেমন কার্টুনের মূল গল্প।

নোবিতা ডোরেমনের মূল গল্প:

5bd2b866832bf wallpaper preview 1

একসময় কার্টুন নেটওয়ার্ক, ডিজনি, পোগো, হাঙ্গামা কিংবা নিক প্রভৃতি চ্যানেল গুলির যে কটি প্রোগ্রামের চাহিদা ছিল আকাশছোঁয়া তার মধ্যে ডোরেমন অন্যতম। নোবিতা নোবি, নীল জামা পড়া জাপানের সেই ছোটো ছেলেটার সঙ্গে আমরা অনেকেই নিজেদের মিল খুঁজে পেতাম। কারণ দুনিয়ার আর সমস্ত কিছুতে মন থাকলেও পড়াশোনার নাম শুনলেই গায়ে জ্বর আসে নোবিতার। মা বাবা বন্ধু বান্ধবী স্কুল – নোবিতার সবই আছে, কিন্তু সেই সঙ্গে আছে এক অমূল্য রত্ন। না, রত্ন অর্থে কোনো মূল্যবান পাথর নয়, নোবিতার আছে এক রোবট বন্ধু, ডোরেমন। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ থেকে বেরিয়ে আসা জিনের মতোই ডোরেমন নোবিতার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।

বাইশ শতাব্দীর অত্যুন্নত সভ্যতা থেকে রোবট ডোরেমন একুশ শতকের অতীতে এসেছে, রোজকার জীবনে নোবিতাকে সাহায্য করার জন্য। নোবিতার বন্ধু হওয়ার জন্য। তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য।

নোবিতা ডোরেমন1

কিন্তু কেন? স্কুল ভরতি বন্ধু থাকতে কেন রোবটের দরকার পড়ল নোবিতার? আসলে পড়াশোনা বা অন্য কোনো কাজেই বিশেষ পারদর্শী না হওয়ায় নোবিতার কপালে সারাক্ষণই জুটত গঞ্জনা। মা বাবা, স্কুলের শিক্ষক যেমন নোবিতাকে সারাক্ষণ বকাঝকা করতেন, তেমনি সহপাঠীরাও তাকে নিয়ে ঠাট্টা করত। অলস নোবিতার অন্ধকার ভবিষ্যতে আলো আনতে ডোরেমনের আবির্ভাব। ডোরেমন, যে নোবিতার সত্যিকারের বন্ধু। তার নিত্যনতুন গ্যাজেটের মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করতে পারত নোবিতা। আর তাই নিয়েই মজাদার এই কার্টুন ছিল ৯০-এর দশকের বাচ্চাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী।

নোবিতা ডোরেমন কার্টুনের উদ্ভব:

জাপানের জনপ্রিয় দুই কার্টুনিস্ট হলেন হিরোশি ফুজিমোতো এবং মোতু আবিকো। এই কার্টুনিস্ট যুগল একত্রে নিজেদের ফুজিকো ফুজিও বলেও পরিচিত করে থাকেন। এঁরাই হলেন ডোরেমন কার্টুনের স্রষ্টা। ১৯৬৯ সালের ৮ আগস্ট এই কার্টুন প্রোগ্রামের বিজ্ঞাপন সর্বপ্রথম টিভির পর্দায় দেখা যায়। তারপর ১৯৭০ সাল থেকে এটি সম্প্রচারিত হতে থাকে। মোটামুটি ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত টিভির পর্দায় ডোরেমনের মোট ৪৩টি ভল্যুম সম্প্রচারিত হয়। শুরু থেকেই এই কার্টুনের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে।

নোবিতার বাস্তব অনুসঙ্গ:

images 1 1 1

নোবিতা এবং ডোরেমনের এই গল্পের পিছনে একটি বাস্তব ঘটনার যোগসাজশ আছে বলে মনে করেন অনেকে। জানা যায়, জাপানের এক ৯ বছরের বালক নোবিতা হিরোশি। আর পাঁচ জনের মতোই সুস্থ স্বাভাবিক হাসিখুশি ছিল নোবিতা। কিন্তু সকলের কাছ থেকে সে একটা গোপন কথা লুকিয়ে রেখেছিল। এক জটিল রোগের কবলে পড়েছিল সে। রোগের নাম স্কিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia)। এই বিরল রোগের প্রভাবে মানুষ দৈনন্দিন জীবনেই এমন এমন জিনিস দেখতে পেতে শুরু করে, যার আসলে কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।

অবাস্তব সেই বস্তু আসলে রোগীর কল্পনা, রোগের জন্যই তেমন জিনিস চোখের সামনে ভেসে ওঠে মানুষের। এই রোগের শিকার হন যাঁরা, তাঁদের কাছে ওই বাস্তব ভিত্তিহীন বস্তু এতটাই সত্যি হয়ে ধরা দেয়, যে তার অস্তিত্বহীনতা বিশ্বাসই করতে চান না তাঁরা। আর এই রোগেরই শিকার হয়েছিল জাপানের ছোট্ট নোবিতা হিরোশি।

নোবিতা হিরোশির চারপাশ:

বাস্তবে জাপানের নোবিতা ছিল ভয়ানক একাকীত্বের শিকার। পড়াশোনায় মন বসত না তার। কখনো চেষ্টা করেও ভালো ফল করতে পারত না সে। পাশাপাশি ছবি আঁকা, হাতের কাজ বা অন্য কোনো গুণই ছিল না নোবিতার। ফলে প্রতি পদে কখনো বাবা মার কাছে, কখনো বন্ধুদের কাছে, কখনো বা স্কুলের শিক্ষকের কাছে ছোটো হতে হত তাকে। দিনের পর দিন একই ভাবে চলতে থাকলে ঘোর মানসিক অবসাদ চেপে বসে ৯ বছরের নোবিতা হিরোশির উপর।

নোবিতা এবং ডোরেমন:

14 18 17 images 1 1

না, ডোরেমন কোনো বাস্তব চরিত্র নয়। স্কিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত নোবিতা নিজের অজান্তেই নিজের চারপাশে তৈরি করে নিয়েছিল এক আলাদা জগত। সে ডোরেমন নামক এক রোবট বিড়ালকে সর্বক্ষণই নিজের চারপাশে দেখতে শুরু করে। রোজকার জীবনের সমস্ত গ্লানি ভুলিয়ে যে ডোরেমন নোবিতার হাতে তুলে দেয় বাইশ শতকের অভিনব সব গ্যাজেট।

তাঁর সময়ের মানুষ যা কখনো চোখেই দেখেনি, কল্পনায় সে সমস্ত গ্যাজেট ব্যবহার করে যেন নিজের উপর হওয়া সমস্ত অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে চায় নোবিতা। ডোরেমনের কাছে সবসময় থাকে তার যে কোনো সমস্যার সমাধান। আর এভাবেই কল্পনার জগতকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে বাস্তব থেকে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে নোবিতা হিরোশি।

নোবিতা হিরোশির মর্মান্তিক ট্রাজেডি:

নোবিতা যখন ১৬ বছর বয়সে পা দেয়, তার বাবা মা তাকে নিয়ে যান ডাক্তারের কাছে। কল্পনার জগত থেকে চিকিৎসকরাই বাস্তবে টেনে নামান নোবিতাকে। জানান, ডোরেমন নেই। সে কেবল কল্পনা মাত্র।

ডোরেমনের অস্তিত্বহীনতার বাস্তব নোবিতার পায়ের তলার মাটি সরিয়ে দেয়। কঠিন নিষ্ঠুর জগত থেকে বিদায় নিতে চায় সে। বাবার বন্দুক দিয়ে নিজের প্রাণ নিয়ে নেয় ১৬ বছরের নোবিতা হিরোশি। আসলে যে পৃথিবীতে ডোরেমন নেই সে পৃথিবীতে নোবিতার অস্তিত্বও মেনে নিতে পারে নি সে।

নোবিতা ডোরেমন কাহিনী কি সত্যি?

14 19 29 images 1

অনেকেই মনে করেন নোবিতা ডোরেমনকে কেন্দ্র করে এই বাস্তব কাহিনীর অনুষঙ্গ আদ্যোপান্ত কাল্পনিক। কার্টুন প্রোগ্রামটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্যেই এই কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে। কিন্তু অনেকেরই বিশ্বাস নোবিতা হিরোশি নামের সেই অবসাদগ্রস্ত বালকের বাস্তব অস্তিত্ব ছিল। যদিও এই কার্টুনের স্রষ্টারা এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেন নি।