পঞ্চম দফার ভোটের পর রাজ্যের ১৮০ টি বিধানসভা কেন্দ্রে নির্বাচন হয়ে গেল। এরমধ্যে প্রতিটি রাজনৈতিক দল যে যার নিজের মতো করে আসন সংখ্যার দাবি জানিয়ে আসছে। তবে বিজেপির পক্ষ থেকে অমিত শাহ প্রতিটি দফার শেষে নির্দিষ্ট একটি আসন সংখ্যার কথা জানাচ্ছেন। তৃণমূলের পক্ষ থেকে অভিষেক ব্যানার্জি আবার আড়াইশো’টি আসনে জয়লাভের দাবিতে অনড়। আবার তৃতীয় পক্ষ সংযুক্ত মোর্চার দাবি তারা তৃণমূল এবং বিজেপিকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসবে। তবে মোর্চার পক্ষ থেকে ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হওয়ার সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না।

সব মিলিয়ে বলা যায় পঞ্চম দফার নির্বাচন রাজ্য রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই দফার ভোটের পর রাজ্যের অর্ধেক আসনে নির্বাচন হয়ে গেল। আবার এই দফাতেই সারাদিন নানা জায়গায় বিক্ষিপ্ত অশান্তি ঘটলেও বড়োসড়ো কোন‌ও গন্ডগোলের খবর আসেনি। সব মিলিয়ে বলা যায় পঞ্চম দফার ভোট আক্ষরিক অর্থেই বাংলার নির্বাচনী লড়াইকে সমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই পঞ্চম দফার ভোটে বেশ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে। এক এক করে আমরা সেগুলোতে চোখ রাখব।


১) পুরোটাই ছিল বিজেপির আওতাধীন-

পঞ্চম দফায় নদীয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, পূর্ব বর্ধমান, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং কালিম্পং জেলার যে সমস্ত কেন্দ্রে ভোট হয়েছে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের পর সেগুলি সবই বিজেপির পক্ষে ‘পজেটিভ’ কেন্দ্রে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবেই পঞ্চম দফার ভোট বিজেপির নিজের মাঠে খেলা ছিল বলা যায়।


২) খামতি মিটিয়ে তুল্যমূল্য লড়াই তৃণমূলের-

২০১৬ এর বিধানসভা ভোটের ফলাফল দেখলে মনে হবে পঞ্চম দফার ভোট যে সমস্ত কেন্দ্রে হয়েছে সেগুলি তৃণমূলের একচেটিয়া আসন। আবার ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন প্রমাণ করে দেয় জোড়া ফুল শিবিরের আধিপত্য তলানিতে এসে ঠেকেছে এই সমস্ত জায়গায়। কিন্তু গত দু’বছরে যাবতীয় ক্ষত মেরামত করে সারাদিন তৃণমূল কড়া টক্কর দিল বিজেপিকে বলা যেতেই পারে। ময়দানি লড়াইয়ে তারা বিজেপির চোখে চোখ রেখে ভোট করিয়েছে পঞ্চম দফায়।


৩) দ্রাবিড়ের টেস্ট ব্যাটিং নীতিই মোর্চার আশ্রয়-

পঞ্চম দফার ভোট যে সমস্ত কেন্দ্রে হয়েছে তার বেশ কিছু জায়গায় তৃণমূল এবং বিজেপির দ্বিমুখী লড়াইয়ের মধ্যেও ভালোভাবেই উপস্থিতি জানান দিয়েছে সংযুক্ত মোর্চা। বিশেষ করে বামেরা পঞ্চম দফার ভোটে সারাদিন ‘শ্লো বাট স্টেডি’ নীতি নিয়ে এগিয়েছে। তারা খুব বড়োসড়ো কোন‌ও গন্ডগোলের রাস্তায় না গিয়ে গোটা দিন ভোট পর্ব পরিচালনা করে। যাতে কোথাও কোনও অনিয়ম না হয় বা সাধারণ মানুষ ঠিকঠাকভাবে নিজেদের মতামত প্রদান করতে পারে। সেটাই লক্ষ্য ছিল তাদের। মনে করা হচ্ছে বাকি দুই পক্ষের সঙ্গে পেশী শক্তিতে পেরে উঠবে না বুঝতে পেরেই সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে বিকল্প নীতি নেওয়া হয়।


৪) ফ্যাক্টর মতুয়া ভোট-

পঞ্চম দফায় নদীয়া জেলার যে কেন্দ্রগুলোতে ভোট হয়েছে সেখানে মতুয়া ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। সারাদিন নির্বাচনী লড়াইয়ে বিজেপি এবং তৃণমূলের তৎপরতা একটা বিষয় প্রমাণ করে দিয়েছে মতুয়া ভোট যাদের দিকে থাকবে নদীয়ার কেন্দ্রগুলি তাদের দখলে যাবে। মতুয়া সম্প্রদায়ের ওপর ভর করেই এই সমস্ত অঞ্চলে নিজেদের সংগঠনের বিস্তার ঘটিয়েছে গেরুয়া শিবির। ময়দানি লড়াইয়ে তার পরিচয় স্পষ্ট পাওয়া গিয়েছে শনিবার।


৫) কেন্দ্রীয় বাহিনীর অতি তৎপরতা-

চতুর্থ দফার ভোটে কোচবিহারের শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলি চালনো এবং তাতে চারজন তৃণমূল সমর্থকের মৃত্যুর পর প্রবল বিতর্ক তৈরি হয় বাংলায়। তবে নির্বাচন কমিশনকে পাশে পাওয়ার ফলে কেন্দ্রীয় বাহিনী খুব একটা হতোদ্যম হয়ে পড়েনি। বরং বিতর্ককে পাশে রেখে পঞ্চম দফার নির্বাচনে বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে অতি তৎপর হয়ে উঠতে দেখা গেল। বর্ধমানে কেন্দ্রীয় বাহিনী বিরুদ্ধে বিনা কারণে মহিলাদের লাঠিচার্জের অভিযোগ উঠেছে, আবার দেগঙ্গায় অভিযোগ উঠেছে তারা শূন্যে গুলি চালিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে। সব মিলিয়ে পঞ্চম দফার ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী যেন আরও বেশি সক্রিয়।


৬) কেন্দ্রীয় বাহিনীর ওপর ক্ষোভ-

চতুর্থ দফায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে চারজনের মৃত্যুর পর তাদের বিরুদ্ধে রাজ্যবাসীর একাংশের মনে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। পঞ্চম দফার ভোটের দিন বেশ কিছু জায়গায় সেই ক্ষোভের পরিচয় পাওয়া গেল। সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে ঢোকার আগে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের সামনে দেখলেই কটাক্ষ করেছেন। আবার কখনও সামান্য তর্কাতর্কিতেই অনেকেই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে লক্ষ্য করে বলেছেন, “দরকারে বুকে গুলি চালিয়ে দিন। আপনারা তো এটাই পারেন।” সব মিলিয়ে এটা পরিষ্কার কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।


৭) একদা দুই সহকর্মীর দ্বন্দ্ব শিবির পাল্টানোর পর আরও তীব্র-

তৃণমূলে থাকাকালীন সুজিত বসু এবং সব্যসাচী দত্তের ‘সুসম্পর্ক’ এর কথা সবাই জানত। সেই সময় এই দুই নেতার সমর্থকদের মধ্যে হামেশাই লড়াই লাগত। শিবির বদলে সব্যসাচী বিজেপিতে আসার পর এবারের নির্বাচনে বিধাননগর কেন্দ্রে সুজিতের সঙ্গে তিনি মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। পঞ্চম দফার ভোটে বিধাননগর কেন্দ্রে নির্বাচন হয়েছে। সুজিত ও সব্যসাচীর সমর্থকদের লড়াইয়ে সারাদিন উত্তপ্ত থাকল সল্টলেকের বিভিন্ন অঞ্চল। একসময় বিশাল বাহিনী ময়দানে নেমে পরিস্থিতি সামাল দেয়। তবে শুধুমাত্র সমর্থকদের মারামারি নয়, সারা দিন ধরেই কথার লড়াইয়েও জড়িয়েছেন এই দুই প্রাক্তন সহকর্মী।


৮) পায়ের তলার জমি খুঁজে পাওয়ার আশায় বামেরা-

দমদম এবং রাজারহাট অঞ্চলে পুরনো জমি পুনরুদ্ধারের লড়াই চালালেন পলাশ দাস এবং সপ্তর্ষি দেব। এই দুই সিপিআই(এম) প্রার্থী উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার রাজনীতিতে অত্যন্ত পরিচিত মুখ। সপ্তর্ষি তো আবার প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেবের ছেলে। তারা দুজনেই সারাদিন জুড়ে বিভিন্ন বুথে ঘুরে ভোট করিয়েছেন। পলাশ দাস মোটেরর উপর সন্তুষ্ট। তবে সপ্তর্ষি দেবের মতে আরেকটু ভালো ভোট হতে পারত।


৯) তৃণমূলের মহিলা বাহিনী-

বিজেপির মোকাবিলা করতে স্বয়ং তৃণমূল নেত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন দলের মহিলা কর্মীদের সামনের সারিতে এগিয়ে দিতে। পঞ্চম দফার ভোটে দলনেত্রীর এই নির্দেশের রূপায়ণ দেখা গেল। একাধিক জায়গায় গন্ডগোল লাগলে মহিলাদের সামনে এগিয়ে দিয়েছিল তৃণমূল। তার ফলে পরিস্থিতি কখনোই জোড়া ফুল শিবিরের হাতছাড়া হয়ে যায়নি। মহিলাদের সামনের সারিতে দেখে পুলিশও গোটা ঘটনায় দ্রুত হস্তক্ষেপ করে।


১০) আশঙ্কা উড়িয়ে পাহাড়ের ভোট শান্ত-

বিমল গুরুং ফিরে আসার পর আশঙ্কা করা হয়েছিল দার্জিলিং পাহাড়ের নির্বাচন খুবই অশান্ত হয়ে উঠবে‌। কিন্তু দেখা গেল নির্বাচনের দিন চাপা উত্তেজনা থাকলেও তা কখনও লাগামছাড়া হয়নি। বলা যেতে পারে বাকি সমস্ত জায়গার থেকে দার্জিলিং পাহাড়ের ভোট সবচেয়ে শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। এর ফলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে ভোটের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা।