ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ফুটবল খেলার সূত্রপাত হয়েছিল বলে ধরা হয়। সেই সময় এটি মূলত ইংরেজ কৃষকদের বিনোদনের মাধ্যম ছিল। সারাদিন মাঠে কাজকর্ম করার পর ইংরেজ কৃষকরা নিজেদের মধ্যে ফুটবল খেলত। আবার মাঠ থেকে ফসল উঠে যাবার পর ফাঁকা মাঠে সময় কাটাতে তারা ফুটবল নিয়ে নেমে পড়ত। বর্তমানে ফুটবল খেলা বলতে ঠিক যা বোঝায় সেই সময়ে অবশ্য পুরোটা তা হতো না। অনেক সময় এখনকার রাগবি, ধাপাস বলের মতো খেলাও খেলতে দেখা যেত কৃষকদের।

১৮৮৮ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম ফুটবল লীগ শুরু হয়। এটিকেই পৃথিবীর প্রথম পেশাদার ফুটবল লিগ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ফুটবল খেলার সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৪ সালে এবং ১৯৩০ সালে প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করে ফিফা।

ফুটবল দুনিয়ায় বিশ্বকাপের মাহাত্ম্য সর্বোচ্চ। কিন্তু এই খেলাটি মূলত দাঁড়িয়ে আছে ক্লাব ফুটবলের ওপর নির্ভর করে। ফিফা স্বীকৃত প্রতিটি সদস্য দেশে প্রিমিয়ার লিগ বা জাতীয় ফুটবল লিগ অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশের প্রথম সারির ফুটবল দলগুলি অংশগ্রহণ করে। যতদূর জানা যায় প্রতিটা দেশের ফুটবল লীগে একটি অন্তত ডার্বি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়, যা সেই ফুটবল লীগের মূল আকর্ষণ। আবার ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ, ইতালিয়ান সিরি’আ, স্পেনের লা লিগার মতো ফুটবল লীগগুলিতে একাধিক ডার্বি ম্যাচ হয়। বলতে গেলে এই ডার্বি ম্যাচ গুলির ওপর নির্ভর করেই বিশ্ব ফুটবলের জনপ্রিয়তা তরতর করে বেড়ে চলেছে।

• ফুটবলে ডার্বি কি?

সাধারণত একই শহরের দুটি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফুটবল ক্লাবের মধ্যে হাওয়া ম্যাচকে ফুটবলের ক্ষেত্রে ডার্বি বলা হয়ে থাকে। যেকোনো দেশের বা ফুটবল লীগের ডার্বি ম্যাচকে কেন্দ্র করে সর্মথকরা বিপুল উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে স্টেডিয়ামগুলো পুরো ভরে যায় সমর্থকদের ভিড়ে। এই ম্যাচটিকে সর্মথকরা তাদের আত্মসম্মানের প্রতীক হিসাবে মনে করে। অবশ্য লা লিগা, ইপিএলের মতো ফুটবল লীগগুলি সহ একাধিক দেশের ফুটবল লীগে ভিন্ন শহরের দুটি ক্লাবের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এমন উত্তেজক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে সেই ম্যাচগুলিও ডার্বি নামে পরিচিত হয়ে গিয়েছে।

ডার্বি ম্যাচকে কেন্দ্র করে উত্তেজিত সমর্থকদের মধ্যে গন্ডগোল, হাতাহাতি সহ অশান্তির ঘটনা বিশ্ব ফুটবলের খুবই পরিচিত ছবি। এই ম্যাচের জন্য সর্মথকরা যেমন সারাবছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে তেমনি স্থানীয় প্রশাসনের রক্তচাপ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় ডার্বি ম্যাচগুলি।

আমরা বরং পৃথিবীর সেরা 5 টি ফুটবল ডার্বির দিকে একটু নজর দিই-

ফুটবল,
Pinterest

১) ইন্টার মিলান-এসি মিলান :

বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে মিলন ডার্বি অতি পরিচিত। ইতালির প্রধান ফুটবল লিগ সিরি’আ এর অন্যতম প্রধান দুই ফুটবল দল হল এসি মিলান এবং ইন্টার মিলান। এই দুই দল শহরের দুই প্রান্তে অবস্থিত। মজার ব্যাপার হলো বিশ্ব বিখ্যাত এই দুই ক্লাবের খেলার মাঠ একটিই, সান-সিরো স্টেডিয়াম। এই দুই দলের মধ্যে যেদিন খেলা হয় সেদিন গোটা শহর জুড়ে অঘোষিত কারফিউ জারি হয়ে যায়। দুই মিলানের সমর্থকদের সামলাতে দাঙ্গা পুলিশকে পর্যন্ত মাঠে নামতে হয়। এই দুই দলের ফুটবল ম্যাচকে কেন্দ্র করে একাধিক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে মিলান শহরে। বর্তমান ইতালির ফুটবলে এই দুই ক্লাবের খেলার মান একটু হলেও পড়ে গিয়েছে। বিশ্ব ফুটবলে মিলান ডার্বি জনপ্রিয়তা এবং উত্তেজনার নিরিখে পঞ্চম স্থানে অবস্থিত।

ফুটবল,
Four Four Two

২) অলিম্পিয়াকোস-পানাথিয়াকোস :

গ্রিসের দুই অতি প্রাচীন ফুটবল ক্লাব হল অলিম্পিয়াকোস এবং পানাথিয়াকোস। এই দেশের রাজধানী এথেন্সের দুই প্রান্তে এই দুই ক্লাব অবস্থিত। ভগবান জিউসের দেশের এই দুই ক্লাবের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতা ইউরোপের আচ্ছা আচ্ছা বড় বড় ক্লাবগুলোকেও বলে বলে হারিয়ে দেবে। ঘটনাচক্রে এই দুটি ক্লাবই প্রধানত গ্রিসের ফুটবলকে নিয়ন্ত্রণ করে। অলিম্পিয়াকোস এবং পানাথিয়াকোসের মধ্যে হওয়া ডার্বি ফুটবল বিশ্বে চতুর্থ স্থানে অবস্থিত।

ফুটবল,
BBC

৩) ফেনারবাচ-গালতাসার :

তুরস্কের অন্যতম প্রধান দুই ফুটবল ক্লাব হল ফেনারবাচ ও গালতাসার।এই দুই ক্লাব তুরস্কের রাজধানী ইস্তানবুলে অবস্থিত। এই ক্লাবের মধ্যে হওয়া ফুটবল ম্যাচ বিশ্বে ইস্তানবুল ডার্বি নামে প্রসিদ্ধ। এই ম্যাচকে কেন্দ্র করে ইস্তানবুলে শুধু হাঙ্গামা বা অশান্তি হয় না, রীতিমত দাঙ্গা বেঁধে যায়। একাধিকবার সমর্থকদের হাঙ্গামায় ইস্তানবুল ডার্বি ভেস্তে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অনেক সময়ই দর্শকর আসন সম্পূর্ণ ফাঁকা রেখে এই দুই দলের মধ্যে ম্যাচ আয়োজন করে তুরস্ক প্রশাসন। ইস্তানবুল ডার্বি ফুটবল বিশ্বে জনপ্রিয়তার নিরিখে তৃতীয় স্থানে আছে।

ফুটবল,
Barcelona vs Real live streaming

২) রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা :

পৃথিবী বিখ্যাত দুই ক্লাব হল স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা। এই দুই ক্লাবের সমর্থকরা কেবলমাত্র স্পেনে নয়, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। তবে রিয়াল-বার্সা এক দিক থেকে ব্যতিক্রম। ফুটবল বিশ্বের সেরা ডার্বিগুলি মূলত একই শহরের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের মধ্যে অনুষ্ঠিত হলেও রিয়াল ও বার্সা সম্পূর্ণ ভিন্ন শহরের দুই ফুটবল ক্লাব।

স্প্যানিশ ডার্বি আরও একটা ইস্যুতে সমগ্র স্পেনের জনগণকে দু’ভাগে ভাগ করে দেয়। স্পেন থেকে স্বাধীন হতে চাওয়া কাতালুনিয়ার রাজধানী শহর বার্সেলোনার প্রধান ফুটবল দল হল এই বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাব। অন্যদিকে স্পেনের রাজধানী শহর মাদ্রিদের প্রধান ফুটবল দল রিয়াল মাদ্রিদ। তাই এই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের মধ্যে হওয়া স্প্যানিশ ডার্বিকে কেন্দ্র করে গোটা স্পেন স্বাধীন কাতালুনিয়ার পক্ষ এবং বিপক্ষ শিবিরে বিভাজিত হয়ে যায়।

স্পেনের প্রধান ফুটবল লিগ লা লিগার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ম্যাচ হল এটি। স্প্যানিশ ডার্বি ফুটবল ডার্বির ক্রমতালিকায় দুই নম্বরে অবস্থান করছে।

ফুটবল,
Manchester evening News

৫) বোকা জুনিয়ার্স-রিভার প্লেট :

ফুটবল বিশ্বে এক নম্বর ডার্বি হিসাবে পরিচিত বোকা জুনিয়ার্স ও রিভার প্লেট ডার্বি। আর্জেন্টিনার প্রধান দুই ফুটবল ক্লাব হল বোকা জুনিয়ার্স ও রিভার প্লেট। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসের দুই প্রান্তে অবস্থিত এই দুটি ক্লাব। এই দুই দলের মধ্যে ম্যাচকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গোটা আর্জেন্টিনা। এই দুই দলের সমর্থকরা আজও পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক রাখেনা। আর্জেন্টিনার এই ম্যাচকে কেন্দ্র করে কেবলমাত্র দাঙ্গা বা অশান্তি নয়, সরকারের গদি চলে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। সদ্যপ্রয়াত বিশ্ব ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো মারাদোনা বোকা জুনিয়র্সে খেলেই ফুটবল বিশ্বে উঠে এসেছিলেন।

পৃথিবীর সেরা ডার্বি ম্যাচ গুলোর কথা শুনে আমরা হয়তো হতাশায় ডুবে যেতে পারি। ভাবতে পারি আমাদের দেশ যেখানে ফিফা ক্রমতালিকায় ১০০ এর নিচে, সেখানে বিশ্ব সেরা ফুটবল ডার্বির তালিকায় আমরা সুযোগ পাবো কি করে? কিন্তু না, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কলকাতার দুই শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাব মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে হওয়া ম্যাচ কলকাতা ডার্বি নামে বিশ্ব ফুটবলে সুপরিচিত। তা বিশ্ব ফুটবলের ডার্বি ক্রমতালিকায় ১০ নম্বর স্থানে অবস্থান করছে।

ডার্বিকে কেন্দ্র করে সর্মথকরা কি পরিমান আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতে পারে তা আমরা মোহন-ইস্ট সমর্থকদের দেখলেই বুঝতে পারব। কলকাতা ডার্বিকে কেন্দ্র করে গোটা বাংলার মানুষ ঘটি-বাঙাল দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। মোহনবাগান সমর্থকরা চিংড়ি মাছ এবং ইস্টবেঙ্গল সমর্থক ইলিশ মাছকে তাদের সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করে। এই দিন ইলিশ-চিংড়ী নিয়ে মেতে ওঠে বাঙালি। সত্যি বলতে কি কলকাতা ডার্বিই ভারতীয় ফুটবলকে বাঁচিয়ে রেখেছে!