বলিউডের ‘প্রথম খান’-এর প্রায় শতবর্ষীয় রাজত্বের পরিসমাপ্তি – কলমে শিরিন শবনম পারভীন

“মহাব্বত হামনে মানা জিন্দেগি বরবাদ কর দেতি হ্যায়
ইয়ে ক্যায়া কম কি মর জানে পে দুনিয়া ইয়াদ কারতি হ্যায়”

– মুঘলে আযম,দিলীপ কুমার(অভিনীত)
images 2021 07 08T141512.098
gulfnews.com

তিনি ছিলেন কিংবদন্তি।তিনি পরিচিতি পেয়েছেন দিলীপ কুমার নামে।তাঁর আসল নাম মোহাম্মদ ইউসুফ খান।ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার পূর্বে(১৯৪৪) শুরু হয়েছিল তাঁর ক্যারিয়ার।পাঁচ দশকের বেশি সময় কাটিয়েছেন ফিল্মজগতে।।আজও সমান প্রাসঙ্গিক তিনি।কারণ,তার অতুলনীয় শিল্পীসত্তা।১৯২২ সালে পেশাওয়ারে (তৎকালীন ভারতে,বর্তমানে পাকিস্তান) জন্মগ্রহণ করেন এই খ্যাতনামা অভিনেতা।বারোজন ভাই-বোনের মধ্যে আর পাঁচটা শিশুর মত বেড়ে ওঠেন স্বপ্ন নিয়ে।বাবা ছিলেন ফল ব্যবসায়ী। নাসিকের একটি স্কুলে শিক্ষালাভ করেন।বলিউডের আরেক কিংবদন্তি রাজ কাপুর ছিলেন তাঁর প্রতিবেশী। সেই সূত্রে তাঁদের ছোটবেলার বন্ধুত্ব।


ক্যারিয়ার শুরু করেন ১৯৪৪-এ বোম্বে টকিজ নির্মিত ‘জোয়ার ভাঁটা’ সিনেমা দিয়ে।এই সিনেমা সফল না হলেও স্বাধীনতার সালে মুক্তি পাওয়া ‘জুগ্নু’ ফিল্মটি জনগণের মন কেড়ে নেয়।পরের বছরেই হিট হয় তাঁর অভিনীত শহীদ ও মেলা।এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।একের পর এক হিট সিনেমা উপহার দিয়ে গেছেন দর্শকদের।তাঁর অভিনীত অন্যতম সেরা চলচ্চিত্রগুলি হল -আন্দাজ,আন,দাগ,দেবদাস,আজাদ,মুঘলে আযম,গঙ্গা যমুনা, রাম আউর শ্যাম।


ষাটের দশক অব্দি তাঁর অভিনীত বেশিরভাগ সিনেমাই ছিল ট্রাজেডি।অনেকে সেইজন্য তাঁকে ‘ট্র্যাজিক কিং’ও বলে থাকেন।তিনি নিজেও সামান্য ডিপ্রেশনে চলে যান এই সিনেমাগুলোতে অভিনয় করতে করতে।ডাক্তারের পরামর্শে তিনি এবার হালকা হাসির মুভি করতে চেষ্টা করেন।দেখা যায়,হাসির অভিনয়েও তিনি সমান পারদর্শী।আন মুভি তাঁর অভিনীত প্রথম আলগা কমেডি।১৯৫০ এ তিনিই ছিলেন প্রথম অভিনেতা যাঁর মুভি পিছু এক লাখ টাকা আয় হত।১৯৬১ থেকে মুভির স্ক্রিপ্ট লেখাও শুরু করে দেন।তাঁর লেখা,প্রযোজিত এবং অভিনীত অন্যতম সিনেমা গঙ্গা যমুনা।এতে তাঁর ভাই নাসির খানও অভিনয় করেছেন। তিনি এই একটি সিনেমাই প্রযোজনা করেছেন।১৯৬২তে ব্রিটিশ ডিরেক্টর ডেভিড লিন তাঁর লরেন্স অফ আরাবিয়া সিনেমার শেরিফ আলীর চরিত্রে দিলীপ কুমারকে মনোনীত করলে তিনি তা মানা করে দেন। পরে ওই ডিরেক্টর অমর শেরিফ নামে এক ইজিপশীয় অভিনেতাকে ওই রোলটি দেন।পরবর্তীতে দিলীপ কুমার বলেছিলেন “তাঁর মনে হয়েছে ওমর শেরিফ ওই রোলটিতে তাঁর থেকে ভালো অভিনয় করেছেন”।

১৯৭০ এর পর তাঁর অভিনীত দাস্তানের মত কিছু সিনেমা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে।১৯৭৪ এ তিনি তাঁর স্ত্রী সায়রা বানুর সঙ্গে প্রথম এবং একমাত্র বাংলা সিনেমা সাগিনাতে অভিনয় করেন।যদিও এই সময়টা তাঁর জন্য সেরকম লাভদায়ী না হওয়ায় তিনি ইন্ডাস্ট্রি থেকে পাঁচ বছরের ছুটি নেন।১৯৭৬ সালের পর পাঁচ বছরের জন্য ফিল্মজগত থেকে সরে যান তিনি। ‘ক্রান্তি’ নিয়ে ফিরে আসেন ১৯৮১ সালে।ফের শুরু তাঁর জয়যাত্রা।একে একে দর্শকদের উপহার দেন- শক্তি,মশাল, কর্মা,সওদাগরের মত উৎকৃষ্ট চলচ্চিত্র।।

তিনি পদ্ম ভূষণ পেয়েছেন ১৯৯১ সালে।পেয়েছেন পাকিস্তানের সব চেয়ে বড় খেতাব নিশান–এ–ইমতিয়াজ(১৯৯৮)।২০১৫ সালে তিনি পদ্ম বিভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন।তিনি ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড বিজেতা হয়েছেন ৮ বার।১৯৯৪ এ পান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার।
ব্যক্তিজীবনে তিনি দুইবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তারানা মুভির সেটে মধুবালার প্রেমে পড়েন।কিন্তু পরে সেই সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়।১৯৬৬তে নিজের থেকে ২২ বছরের ছোটো অভিনেত্রী সায়রা বানুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।১৯৮১তে আসমা সাহিবার সঙ্গে বিবাহ করে তাঁকে দ্বিতীয় পত্নী হিসাবে গ্রহণ করলেও ১৯৮৩ তেই সেই বিয়ে ভেঙ্গে যায়।সায়রা বানু এবং তাঁর কোনো সন্তান নেই।সায়রা বানু গর্ভবতী হলে তাঁর জটিল সমস্যার কারণে সন্তানলাভের সৌভাগ্য তাঁদের হয়নি।যদিও এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ ছিলনা তাঁদের।একে অপরকে নিয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন তাঁরা।
কুমার ২০০০ থেকে ২০০৬ অব্দি রাজ্যসভার সদস্যও ছিলেন।তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দ্বারা মনোনীত সদস্য ছিলেন।তাঁর এমপি ফান্ডের টাকা খরচ করে তিনি বান্দ্রা এলাকার উন্নতি সাধন করেছেন বলেও জানা যায়।


প্রস্টেট ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি।গতকাল মুম্বাইয়ের হিন্দুজা হাসপাতালে সকাল ৭:৩০ মিনিটে এই মহান মানুষটি চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হন।মহারাষ্ট্র সরকার প্রদত্ত সরকারি সম্মানের সঙ্গে জুহু কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাঁকে।পিছনে রেখে যান তাঁর মর্মাহত জীবনসঙ্গী সায়রা বানুকে এবং অভিভাবকহীন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি।প্রসঙ্গত, গত বছর করোনায় তাঁর দুই ভাইয়ের মৃত্যু ঘটে।
বাংলা,হিন্দি,উর্দু,ইংরেজি মিলিয়ে মোট দশটি ভাষা জানতেন এই কিংবদন্তি।তাঁর রঙিন জীবনে উপস্থিত ছিল – অভিনয়,প্রযোজনা,লেখকসত্তা,রাজনীতি।এক কথায় ভার্সেটাইল জিনিয়াস ছিলেন তিনি।তাঁর মৃত্যুতে স্তব্ধ হল সব কিছু।প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সকলেই তাঁর মৃত্যুতে মর্মাহত।চলচ্চিত্র জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হল তাঁর চলে যাওয়ায়।