বাচ্চাদের মনেও covid এর কুপ্রভাব – মৌমিতা ব্যানার্জী

– কেউ আমার সাথে খেলেনা

– বাবা মা সবসময় কাজে busy, আমি কোথায় যাবো?

– আমি আমার স্কুল আর ফ্রেন্ডদের মিস করি

– ক্লাসে বসে পেন্সিলে লেখাটাই বেস্ট ছিল

– টিভি দেখতে আর ভালো লাগেনা

– অনলাইন ক্লাসে doubts ক্লিয়ার হয়না

– আমার কোনো খেলার সাথী নেই

উপরের কথাগুলি 3 থেকে 10 বছরের বাচ্চাদের মধ্যে করা সার্ভে অনুযায়ী, 20-2021শে সব থেকে বেশি বলা কথা। কোরোনার কড়ালো গ্রাসের থেকে জনসাধারণকে সুরক্ষিত রাখতে সারা পৃথিবীতে lockdown হল, যা কিনা ছোট বড় প্রত্যেকটি মানুষের ওপরেই সবরকম ভাবে প্রভাব ফেলেছে। শুধুমাত্র আর্থিক দিক দিয়ে মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি, মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছে। Pandemic effect- এর জেরে বহু মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগছে, anxiety, frustration, suicidal tendency মানুষের নিত্য দিনের সঙ্গী। এর প্রধান কারণ নিঃসঙ্গতা, সামাজিক একাকিত্ব, মৃত্যুভয়, অনিশ্চয়তা, কাজ হারানো ইত্যাদি। 2019-এর প্রথম ভাগে, প্রত্যেক 10জন প্রাপ্তবয়স্কের (18-24 বছর বয়সী) মধ্যে 1জনের (11%) ঘুমের সমস্যা বা ডিপ্রেশনের শিকার ছিল, 2020-এর জুলাই মাসে একবছরেরও কম সময়ে সেই সংখ্যাটা উর্দ্ধগতিতে বৃদ্ধি পেয়ে 40% হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

বাচ্চাদের মনের ওপর পড়েছে পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপ :

আমরা বড়োরা তাও এই মানসিক চাপ ও মনের ব্যাধিগুলির সাথে লড়াই করার ক্ষমতা রাখি। আমরা প্রয়োজন বুঝলে কাউন্সেলর বা সাইকিয়াট্রিস্ট-এর সাহায্য নিতে পারি। ছোটরা কিন্তু নিজেদের মনের ভাব সহজে বুঝতে ও প্রকাশ করতে পারেনা। Pandemic-এর সবচেয়ে বেশি কুপ্রভাব পড়েছে বাচ্চাদের ওপরেই, তাদের অমূল্য শৈশব নষ্ট করে তারা গৃহে বন্দী জীবন কাটাচ্ছে। না পারছে তারা স্কুলে যেতে, না খেলতে যেতে, না বন্ধুদের সাথে দেখা হচ্ছে, না তো কেউ বাড়িতে আসতে পারছে। তাদের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দটাই নষ্ট হয়ে গেছে। শিশুরা অবাধ্য হয়ে উঠছে, কথা শুনছেনা, বায়না করছে… সবটাই তাদের মনের ওপর পড়া চাপের দরুন হচ্ছে।

শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের শৈশব থেকে :

সব ভুলে মাঠে খেলা, বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফেরা, প্রজাপতি ধরা বা টিফিন ভাগ করে খাওয়ার আনন্দ তারা পাচ্ছেনা… বাচ্চারা তাদের শৈশব আর ফেরত পাবেনা। স্কুলে বা বন্ধুদের সাথে কোনো স্মৃতি তৈরী হচ্ছেনা, তাই বড়ো হয়ে তারা ছোটবেলার স্মৃতি মনে করে শৈশবে ফিরে আসতে পারবেনা। ছোটবেলার বন্ধুত্বের কোনো বিকল্প হয়না, সেই বন্ধুত্বের স্বাদ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে ।

Covid
unicef.org

স্কুলের ভূমিকা অনস্বীকার্য :

স্কুলের পরিবেশের অবদান বাচ্চার সার্বিক গঠনের জন্য অপরিমেয়, একটা বাচ্চার কাছে কখনোই স্কুলের ক্লাসের বিকল্প ঘরে বসে অনলাইন ক্লাস করা হতে পারেনা। অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে একই সাথে বড় হওয়ার মধ্যে বহু ভালো দিক আছে, যেমন- একতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, নিয়মানুবর্তিতা, বাচ্চার মধ্যে ভাগ করে নেয়ার মানসিকতা গঠিত হয়; যেগুলি একটা বাচ্চাকে বড়ো হবার পর জীবনের কঠোরতম সময়ের মুখোমুখি হতে বা প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে কঠিন লড়াই করতে শেখায়। বিভিন্ন কম্পিটিশনের মাধ্যমে বাচ্চার মধ্যে আরো ভালো করার ইচ্ছে জন্মায়, নানা শিক্ষামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে বাচ্চার ভেতরের প্রতিভা প্রকাশ পায়। এই পরিবেশ একমাত্র স্কুলেই উপলবদ্ধ যা বাচ্চাকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরী করে দেয়। স্কুলে গেলে, ৫টা বন্ধুর সঙ্গে মিশলে তাদের স্ট্রেস লেভেল কম থাকে। বাড়িতে মা বাবা যতই বাচ্চাকে কেয়ার করুক, ভালোবাসা দিক, বাচ্চার প্রতিপালনে ও চরিত্র গঠনে  স্কুলের ভূমিকা অতুলনীয়। 

বাচ্চাদের মধ্যে বাড়ছে ডিপ্রেশন :

এখন ২৪ ঘন্টা বাড়ির মধ্যে থেকে, বাচ্চাদের ইমোশনাল ব্রেকডাউন হচ্ছে, বাচ্চারা বুঝতে পারছেনা তাদের কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয়। তারা একঘেয়েমি থেকে বেরোতে চাইছে, কনফিউস হয়ে যাচ্ছে তারা। বিনাকারণে কাঁদছে, বায়না বা জেদ করছে, বিরক্ত করছে। বিশেষ করে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির সিঙ্গেল চাইল্ডরা এই অবস্থার শিকার। দুঃখজনক ভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মা বাবাও বুঝতে পারেননা, বাচ্চা কি চাইছে। অনেকে কাজের চাপে বাচ্চাকে সময়ে দিতে পারেননা, বিশেষ করে খাবার সময় অনেক মায়েরাই ছোট্ট বাচ্চাকে মোবাইলে দেখতে দেন। বাচ্চা এইরকম অবস্থায় পড়ে হয় টিভি বা মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে কিংবা ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। বাচ্চাদের মধ্যে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে আচরণগত ও আবেগসংক্রান্ত ব্যাধি। 

বাচ্চার মনের অবস্থা বোঝা জরুরি :

আপনার বাচ্চাকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করুন। যদি দেখেন, বাচ্চার মধ্যে হঠাৎ কোনো চেঞ্জ এসেছে, সেটাকে গুরুত্ব দিন। বাচ্চার মধ্যে চিন্তা, ভয়, টেনশন করা বাড়তে পারে, সে হয়তো পড়াশুনোয় অ্যাভারেজ কিন্তু হঠাৎ বিস্ময়কর ভাল রেজাল্ট করলো, বা উল্টোটা। চুপ করে থাকা, অত্যাধিক ঘুম, ক্লান্তি বা নির্জীবতা, হঠাৎ করে কান্না, চিৎকার বা রাগ প্রকাশ, প্রচন্ড জেদ করা, কারোর সামনে না আসা, দূরে দূরে থাকা সব গুলোই বাচ্চার মধ্যে ইমোশনাল ইমব্যালেন্স বা ডিপ্রেশনের এর কারণ হতে পারে। বাচ্চাকে বুঝতে চেষ্টা করুন, যত্ন নিন, দরকারে প্রফেশনাল হেল্প নিন। বাচ্চারা শুধু মা-বাবার নয়, সমাজের এগিয়ে যাওয়ার চাকা, দেশের ভবিষ্যৎ, তাই তাদের ভবিষ্যৎ সিকিউর করা সবচেয়ে জরুরি, আমাদের প্রধান দায়িত্বগুলির মধ্যে একটি।