ভারতের করোনা পরিস্থিতি বর্তমানে যে সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তা নিয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই। একসময় দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছিল দেশে। পরে সেই সংখ্যা সামান্য কমলেও বিপদ এখন‌ও কাটেনি। কোন‌ও এক দেশে দৈনিক সংক্রমনের ভিত্তিতে এটি বিশ্বরেকর্ড। যদিও এই লজ্জার বিশ্বরেকর্ড দেশবাসী চায়নি। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে শুধুমাত্র সাধারন মানুষ আক্রান্ত হয়ে ব্যাপারটা মিটে যাচ্ছে এমন নয়। বরং প্রতিদিন সারাদেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রায় তিন হাজারের মত মানুষ মারা যাচ্ছেন। এতটা মর্মান্তিক, এতটা হৃদয় বিদারক ঘটনা এই সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া যায় না। তবু ঘটে চলেছে। আজ এটাই বাস্তব।
দেশের করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করব। আমরা তুলে ধরব সেই দিকগুলি যা সহজেই বুঝিয়ে দেবে আমরা আসলে ভয়ঙ্কর এক বিপদের মধ্যে বসবাস করছি।


১) অক্সিজেন এক্সপ্রেস-

দূরপাল্লার ট্রেনের নানাবিধ নাম এই ভারতে দেওয়া হয়। কখন‌ও দেশের গরিব মানুষদের সম্মান জানিয়ে তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘গরিব রথ এক্সপ্রেস’, আবার কখনও কুম্ভ মেলা উপলক্ষে তার নাম হয়ে ওঠে ‘কুম্ভ এক্সপ্রেস’। গতবছর করোনার ঢেউ প্রথমবারের জন্য ভারতে আছড়ে পড়লে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরানোর জন্য ‘পরিযায়ী এক্সপ্রেস’ চালিয়েছিল কেন্দ্র। যার মাধ্যমে কাজের জন্য ভিন রাজ্যে গিয়ে আটকে পড়া মানুষরা ঘরে ফিরতে পেরেছিলেন। কিন্তু এবারে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলে রেলমন্ত্রক বাধ্য হয়েছে অক্সিজেন এক্সপ্রেস চালাতে।

দেশের অক্সিজেন প্লান্টগুলি থেকে অক্সিজেন বোঝাই ট্যাঙ্কার দ্রুত হাসপাতালগুলিতে পৌঁছে দে‌ওয়ার জন্য সড়কপথের পরিবর্তে রেলপথ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। এক একটা অক্সিজেন বোঝাই ট্যাঙ্কার মাল ট্রেনের উপর চাপিয়ে নিয়ে মহারাষ্ট্রের নানান দিকে ছুটে চলেছে এই করোনা এক্সপ্রেস। এই ঘটনা প্রমাণ করে দেয় দেশে ঠিক কি বিপুল পরিমাণ অক্সিজেন সঙ্কট ঘটেছে। যার জন্য ট্রেনের নাম‌ই দিয়ে দিতে হল অক্সিজেন এক্সপ্রেস। যা আসলে একবিংশ শতকে ভারতের ভয়াবহতার চিহ্ন তুলে ধরছে।


২) জামশেদপুরের ইস্পাত কারখানায় উৎপাদন বন্ধ করল টাটারা-

দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল ফেরাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন বন্ধ করার ঘটনা অত্যন্ত বিরল। কিন্তু ভারতে এই মুহূর্তে অক্সিজেন সঙ্কট এমন ভয়াবহ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত অক্সিজেন‌ও হাসপাতালে সরবরাহ করলে ভালো হয়। এই বিষয়টি মাথায় রেখে টাটা গোষ্ঠীর তাদের জামশেদপুরের ইস্পাত কারখানায় উৎপাদন অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। যাতে প্রতিদিন ৭০ টন অক্সিজেন সরবরাহ করা যায় স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে। এই ঘটনা প্রমাণ করে দিচ্ছে গোটা দেশজোড়া অক্সিজেনের হাহাকার। এক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে বিশ্ব বিখ্যাত টাটা গোষ্ঠীর এই পদক্ষেপ কিন্তু ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে। আগামী দিনে যখন এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে তখনই উঠে আসবে ভারতে অক্সিজেন সঙ্কটের ভয়াবহ ছবি।


৩) ফুটপাতে তৈরি হল গণচিতা-

উত্তর প্রদেশ, গুজরাটের মত রাজ্যগুলিতে শ্মশানে করোনায় মৃতদের দেহ পুড়িয়ে শেষ করা যাচ্ছে না। প্রতিটি রাজ্যে করোনা সংক্রমণ রোধ করতে আক্রান্তদের দেহ পড়ানোর জন্য আলাদা করে শ্মশান নির্দিষ্ট করা থাকে। সেই শ্মশানগুলিতে করোনা আক্রান্তদের মৃতদেহের স্রোত এমন আছড়ে পড়ছে সামনের ফুটপাতে গণচিতা জ্বালাতে হয়েছে। মর্মান্তিক ছবি উঠে এসেছে বারাণসীতে। সেখানে গঙ্গা নদীর তীরে দাউ দাউ করে একের পর এক চিতা জ্বলতে দেখা গিয়েছে। এই মর্মান্তিক ছবি স্বাধীন ভারতে এর আগে কখনও দেখা গিয়েছে কিনা সন্দেহ।

এখানেই শেষ নয়- দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে ইলেকট্রিক চুল্লিতে একটি নয়, একসঙ্গে চার পাঁচটি করে করোনা আক্রান্তের মৃতদেহ প্রবেশ করাতে হচ্ছে। এই ঘটনাই প্রমাণ করে দেয় কি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এ দেশে করোনা সংক্রমণ।


৪) মহামারী আইন চালু-

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তে পরিস্থিতি এতটাই বেলাগাম যে শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ আমলে তৈরি হওয়া মহামারী আইন দেশের সর্বত্র লাগু করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এই আইনে করোনা সংক্রমণ রোধ করতে যে বিধিগুলো চালু করা হয়েছে তা কেউ অমান্য করলেই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এই আইনে আইন ভঙ্গকারিকে সর্বোচ্চ দু’বছরের জন্য কারাদণ্ডের বিধান দেওয়া আছে। সরকারি তরফে পরিষ্কার জানানো হয়েছে করোনার সংক্রমণ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে এর বাইরে তাদের আর কোনও উপায় ছিল না।


৫) সর্বসাধারণের জন্য খুলে যাচ্ছে সেনা হাসপাতাল-

দেশের করোনা পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে যে এই প্রথম সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে সেনা হাসপাতালগুলি। এই হাসপাতালগুলিতে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য পৃথক পরিকাঠামো গড়ে তোলা হবে। দেশে একের পর এক করোনা আক্রান্তের মোকাবিলা করার জন্য এই পদক্ষেপ অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কারণ এদেশে সেনাবাহিনীর হাতে যথেষ্ট উন্নত মানের চিকিৎসা পরিকাঠামো আছে। তাই এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুহূর্তে সেগুলো যদি কাজে লাগানো যায় তবে এই মরণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইটা কিছুটা হলেও সম্ভবপর হয়ে উঠতে পারে।


এছাড়াও করোনার থাবা যে কতটা ভয়ঙ্কর তা প্রমাণ করে দেয় ভিন দেশ থেকে একের পর এক অক্সিজেন বোঝাই প্লেনের দিল্লিতে অবতরণের ঘটনা। ভারত পৃথিবীতে সর্বোচ্চ অক্সিজেন উৎপাদনকারী দেশ হলেও বর্তমানে এখানের অক্সিজেনের চাহিদা যোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সেইজন্য একের পর এক বিদেশি রাষ্ট্র অক্সিজেন পাঠিয়ে করোনার বিরুদ্ধে ভারতের লড়াইকে মজবুত করার চেষ্টা করছে।