গত কয়েকবছর ধরে শীতকালে আর সার্কাসের তাঁবু পড়তে দেখা যায়না। অতিমারির বছরটা হিসেবে না রাখলেও বহুদিন যাবত জনপ্রিয়তা হারাতে বসেছে বাঙালির সার্কাস। এখনকার প্রজন্মে চটজলদি কেউই সার্কাস দেখার কথা মনেই আনতে পারবেন না। বারুইপুর, পার্কসার্কাস অঞ্চলের বিপুল জনপ্রিয় সার্কাস শো দেখার জন্য সারাবছর অপেক্ষা করে থাকা যুবক-যুবতীর দল আজ বৃদ্ধ হয়েছেন। বন্য পশুপাখি নিয়ে খেলা দেখানো এখন দণ্ডনীয় অপরাধ। ত্রয়োদশ শতাব্দীর গ্রীস রোমে পশুর সঙ্গে মানুষের লড়াই দেখার উল্লাসের সেই বর্বরতার দিনও আর নেই। শুধু কি সেইকারণে ফিকে হয়ে গেল সার্কাসের আকর্ষণ? না। এতদিনে বদলেছে সভ্যতার বিবেক, পালটেছে মূল্যবোধ। সার্কাস শব্দের মজার মধ্যে কোন ফাঁকে ঢুকে পড়েছে নিসিদ্ধ বর্বরতার সংকেত। তবুও কতটা গৌরবময় ছিল বাংলায় সার্কাসের সূচনা, ফিরে দেখা আবশ্যক আজ। বর্তমানে জাতীয় মর্যাদায় অনেকখানি পিছিয়ে পড়া বাঙালির মধ্যে জাতীয়তাবোধের পুনরুন্মেশ অপ্রাসঙ্গিক নয়। মূল্যবোধের সেই মাপকাঠিও পুনরায় বিচার্য। আজ ফিরে দেখা যাক বাংলা তথা ভারতীয় গৌরবের এক বিশিষ্ট অধ্যায়-সার্কাস।

সার্কাস

একটা সময় ছিল যখন মানুষ গর্ব করে বলতো, বাংলায় যা নেই তা ভূ-ভারতে নেই। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। তখন ব্রিটিশ শাসিত ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। নবজাগরণের আলোক যে কলকাতাতেই প্রথম শিল্প-সাহিত্য ও বিজ্ঞানের জোয়ার আনবে সে বিষয়ে আর আশ্চর্য কী। ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জনের জন্য কলকাতার বুকেই একের পর এক ইউরোপীয় সার্কাস শো অনুষ্ঠিত হত। তাতে থাকত জোকারের কারসাজী, ট্রাপিজের দুঃসাহসী খেলা, দড়ির ওপর হাঁটা এবং পশুপাখি নিয়ে নানান রোমহর্ষক বাহাদুরির খেলা যা অনায়াসে তিন থেকে চারঘন্টা সময় ধরে টানটান উত্তেজনায় দর্শক ধরে রাখতে পারতো। সেসব আসরে সরাসরি বাঙালি নেটিভরা প্রবেশ করতে পারতো না। দুএকজন বাঙালীবাবু কদাচিৎ পরের দিকে আমন্ত্রণ পেতেন। সেভাবেই বাঙালির সার্কাসের সঙ্গে পরিচিতি ও লোকমুখে গল্প শুনে কৌতূহলের সম্প্রসারণ।

উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই বাঙালির বিনোদন জগতের অংশ হয়ে উঠেছিল সার্কাস। সত্যজিৎ রায় ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ ‘-এ বাঙালির সার্কাসপ্রীতি ও এদেশে সার্কাসের ইতিহাস নিয়ে গল্পচ্ছলে অনেক কথাই বসিয়েছেন কথক তোপসের বয়ানে। সেরকম একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরা যাক- ”কে জানত আজ থেকে একশো বছর আগে বাঙালীর সার্কাস ভারতবর্ষে এত নাম কিনেছিল? সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল প্রোফেসর বোসের গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস। এই সার্কাসে নাকি বাঙালী মেয়েরাও খেলা দেখাত, এমনকি বাঘের খেলাও। আর সেই সঙ্গে রাশিয়ান, আমেরিকান, জার্মান আর ফরাসী খেলোয়াড়ও ছিল।… ১৯২০-এ প্রিয়নাথ বোস মারা যান। আর তার পর থেকেই বাঙালী সার্কাসের দিন ফুরিয়ে আসে।”

বাঙালির সার্কাস প্রসঙ্গে বারবার আসে প্রিয়নাথ বোসের নাম। কে ছিলেন প্রিয়নাথ? তাঁর পরিচয় প্রসঙ্গক্রমেই আমরা পাবো। তবে বলা বাহুল্য, বাঙালির সার্কাস গঠনের নিজস্ব পথ কিন্তু একেবারেই মসৃণ ছিলনা। নাটক, সিনেমা প্রভৃতি শিল্পের ক্ষেত্রেও যেমন সদয় কিছু শেতাঙ্গ বাঙালির সঙ্গে বন্ধুর মতো যোগ দিয়েছিলেন সার্কাসের দল গঠন ও তালিমের ক্ষেত্রেও তেমনই কারও কারও সাহচর্য পেয়েছেন আমাদের সার্কাসের পূর্বসূরিরা। আজ আলোচনা করবো সেইসব ইতিহাস।

IMG 20210201 WA0020

কলকাতায় সর্বপ্রথম উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি উইলসন্স গ্রেট ওয়ার্ল্ড সার্কাস খেলা দেখাতে আসে । এরপর আরো দুচারটে ইউরোপীয় দল খেলা দেখিয়ে যায় । বাঙালীর সার্কাসে প্রথম পদক্ষেপ ঘটে হিন্দুমেলার প্রতিষ্ঠাতা নবগোপাল মিত্রের হাত ধরে । ন্যাশনাল সার্কাস নামের সে সার্কাস প্রথমে খেলা দেখাতো ঠনঠনিয়ায়,পরে নবগোপাল বাবুর বাড়িতে উঠে যায় । জন্তু জানোয়ার বলতে ছিলো মাত্র একটি টাট্টু ঘোড়া, মুলতঃ নানা প্রকার জিমন্যাস্টিকসের খেলাই দেখানো হত ।

IMG 20210201 WA0019


আনুমানিক 1883 সালে, আবেল নামে উইলসন্স সার্কাসের একজন প্রাক্তন খেলোয়াড় ও আরও দু-চারজন ইউরোপীয়কে সঙ্গে করে নবগোপাল মিত্রের জামাই রাজেন্দ্রলাল সিংহ ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস’ খোলেন্, মির্জাপুরে শামিয়ানা টাঙিয়ে সার্কাস দেখানো হতো ।

তবে বাঙালীর সার্কাস রূপ পায় প্রিয়নাথ বসুর হাতে । প্রিয়নাথ বসু চব্বিশ পরগনার ছোট জাগুলিয়া গ্রামে জন্মান , তাঁর পিতা মনমোহন বসু হিন্দুমেলার অন্যতম সংগঠক ছিলেন্ । কবি এবং নাট্যকার মনমোহন বসুর নাটক ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত হতো, বহু গানও তিনি রচনা করেন ।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আহিরীটোলা অঞ্চলের গৌরহরি মুখোপাধ্যায় নামে এক ব্যায়ামশিক্ষক কলকাতার বহু জায়গায় জিমনাস্টিকসের আখড়া স্থাপন করেন। সবকটি তাঁর একার পক্ষে দেখাশোনা করা সম্ভব হতো না বলে তিনি এর মধ্যে কয়েকটার ভার নিজের ছাত্রদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন । এঁদের মধ্যে একজন হলেন প্রিয়নাথ বসু ।

প্রিয়নাথ বসু পরে নিজের স্বতন্ত্র আখড়া স্থাপন করেন , যার প্রথমটি ছিলো নিজের বাড়ির কাছে, কর্ণওয়লিস স্ট্রীটে । এ‌ই একটি থেকে সিমলে (বর্তমানের বিবেকানন্দ রোড) থেকে নেবুতলা (সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার্) পর্যন্ত গোটা পঞ্চাশেক আখড়া সৃষ্টি হয় – এর প্র্ত্যেকটিতে প্রিয়নাথ ব্যয়াম শেখাতেন ।

পড়াশোনায় মন নে‌ই দেখে মনমোহন বসু ছেলেকে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি করে দেন্, কিন্তু সেখানেও প্রিয়নাথের মন বসে না । তিনি কলকাতায় সার্কাস এলে‌ই দেখতে যেতেন আর মনে মনে নিজের সার্কাস দল খোলার স্বপ্ন দেখতেন।

কিন্তু দল বানাবো বললে‌ই হয় না, তার জন্যে মূলধন চা‌ই । জিমনাস্টিকসকে পেশা করাকে মনমোহনের সায় ছিলো না , তিনি সাহায্য করতে রাজী হলেন না, সুতরাং বাড়ির মেয়েদের থেকে আর এপাশ ওপাশ থেকে কিছু টাকা যোগাড় করে জিমনাস্টিকসের দল নিয়ে প্রিয়নাথ বাড়ি ছাড়লেন ।

সার্কাস বলা চলে না, কারণ তাঁবু নে‌ই, গ্যালারী নে‌ই , জন্তু-জানোয়ার নে‌ই । বসার ব্যবস্থা বলতে বাঁশের মাচা অথবা মাটিতে পাতা চাটাই । আলোর বন্দোবস্ত হতো বাঁশের মাথায় সরা বসিয়ে, তার মধ্যে কাঁকর , ছাই ইত্যাদির সঙ্গে কেরোসিন মিশিয়ে তাতে আগুন জ্বালিয়ে। খেলা বলতে শুধু‌ই জিমনাস্টিকস । কিন্তু তাই নিয়ে‌ই প্রিয়নাথ মেদিনীপুর,ঝাড়গ্রাম্, বীরভূম্, বাঁকুড়া , নানা জেলায় জমিদার বাড়িতে খেলা দেখিয়ে কিছু রোজগার করলেন ।

কলকাতায় ফিরে প্রিয়নাথ ফিরে রোজগারের পয়সা দিয়ে তাঁবু ইত্যাদি কিছু সরঞ্জাম কিনলেন, দু-একজন আরো খেলোয়াড় যোগাড় করলেন, একজন হিসেবরক্ষক নিযুক্ত করলেন্, আর দলের নাম দিলেন Professor Bose’s Great Bengal Circus । সেটা 1887 সালের কোন একটি সময় ।

প্রিয়নাথ বসু কোনদিন অধ্যাপনা করেন নি, তবে এ‌ই ‘প্রফেসর’ কোথা থেকে এলো ? জনশ্রুতি, কোন এক উৎসবে বড়লাট ডাফেরিন প্রিয়নাথের আখাড়ার ছেলেদের খেলা দেখে,আনন্দিত হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন্, ‘Who is the Proffessor ?‘ । প্রফেসর নামের উৎপত্তি নাকি সেখান থেকে‌ই।

গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস নানা লড়ায়ের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করে । প্রথমে বাংলার নানা জায়গায খেলা দেখিয়ে ,ধীরে ধীরে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে খেলা দেখতে শুরু করে । 1896 সালে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস গোয়ালিয়রের মহারাজার জয়বিলাস প্যালেসে খেলা দেখায় । সে‌ই বছরই নভেম্বর মাসে রেওয়ার মহারাজা সার্কাস দেখে খুশী হযে দুটি বাঘ উপহার দেন । তার আগে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসে বাঘ ছিলো না।

ক্রমশঃ কয়েক বছরের মধ্যে‌ই গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস সারা ভারতে প্রসিদ্ধ হযে পড়ে, এবং এমন খুব কম‌ই করদ রাজ্য সে সময় ছিলো যেখানে খেলা দেখায় নি । ভারত ছাড়াও শ্রীলংকা, পেনাং, সিঙ্গাপুর, জাভা, নানা জায়গায় গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস খেলা দেখায় ।

গ্রেট ইণ্ডিয়ান সার্কাস আর প্রিয়নাথ বসুর গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস প্রায় এক‌ই সময়ে তাদের যাত্রা শুরু করলেও, দুটির মধ্যে একটা গুনগত ফারাক ছিল । গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাসের অংশীদার রাজেন্দ্রলাল সিংহ বাঙালী হলে‌ও, তার পরিচালনার ভার ছিল বিদেশী আবেলের ওপর । খেলোয়াড়দের মধ্যেও অনেকে ছিলেন বিদেশী । অন্যদিকে প্রিয়নাথ বসুর গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের পরিকল্পনা, পরিচালনা সবের মূলে‌ই একজন বাঙালী , খেলোয়াড়রাও সব ভারতীয় । এরা কারণে পরবর্তী কালে এ‌ই সার্কাস আর শুধুমাত্র সার্কাস বলে‌ই গণ্য থাকে‌নি, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যখন জাতীয়াতাবাদী চেতনা রূপ পাচ্ছে, তখন বাঙালীর গর্বের বস্তু হয়ে ওঠে । দেশীয় সংবাদপত্রও গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের প্রভূত প্রশংসা করে তাতে যোগ দেয় । দুটি উদাহরণ ,

The Circus has been doing splendid service in its own way to the country (বন্দে মাতরম / 8.1.1908)

The Circus is indeed the pride of the Bengalees (হিন্দু পেট্রিয়ট/ 28.12.1908)

এবার সার্কাসের ইতিহাস থেকে নজর সরিয়ে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের দু-একজন সদস্যের কথা বলব । স্বল্প পরিসরে সবার কথা বলার সম্ভব নয় , তবে তা‌ই বলে যাঁরা বাকি পড়লেন তাঁরা কোন অংশে ছোট নন , তাঁদেরকে নিয়ে পরে লেখার ইচ্ছে র‌ইল ।

প্রথমে যাঁর কথা সশ্রদ্ধ মনে স্মরণ করব, তিনি একজন মহিলা , নাম সুশীলাসুন্দরী । একজোড়া বাঘ নিয়ে খেলা দেখাতেন, খালি হাতে খাঁচায় ঢুকতেন, হাতে একটা সামান্য লাঠি পর্যন্ত থাকতো না । খেলা দেখাতে দেখাতে বাঘের গালে চুমু খেতেন । বাঘের খেলা ছাড়াও ট্র্যাপিজ আর জিমন্যাস্টিকসের খেলা দেখাতেন । এছাড়াও আরো একটা বিপজ্জনক খেলা দেখাতেন – তাঁকে মাটিতে সমাধি দেওয়া হত, তারপর একটা ঘোড়ার খেলা দেখানো হয়ে গেলে আবার মাটি খুঁড়ে তোলা হত । একবার খেলা দেখানোর সময়ে প্রচণ্ড ঝড়ে সব লন্ডভণ্ড হয়ে যায় , যে যেদিকে পারে ছুটে পালায়, সুশীলা মাটিতে সমাধিস্ত ছিলেন, তাঁর কথা কারোর মনে ছিল না । দুর্যোগ মিটে যাবার পর খেয়াল হতে সবাই মিলে খোঁজাখুঁজি শুরু করতে দেখতে পেলেন সুশীলা একটা খুঁটির গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে কাঁপছেন, তার পা দুটো তখনো মাটির মধ্যে । কারোর সাহায্যের অপেক্ষা না রেখে সুশীলা নিজের চেষ্টায় মাটি ঠেলে বেরিয়ে এসেছেন। একবার একটা নতুন বাঘ নিয়ে খেলা দেখানোর সময়ে বাঘ তাঁকে আক্রমণ করে , ওঠার ক্ষমতা ছিলো না, রক্তাত্ত শরীরে গড়িযে কোন মতে বাঘের নাগাল থেকে বেরিয়ে আসেন । সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিলো, কলকাতায় এনে মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা করানো হয়, সুস্থ হতে একবছর লেগেছিল । দুঃখের কথা এমন একজন মহিলা, যিনি একশো বছর আগেকার রক্ষণশীল সমাজের সমস্ত বেড়া ভেঙে আক্ষরিক অর্থে বাঘের সাথে খেলতেন তাঁর কথা আমরা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছি । আমার অক্ষমতা, আমি এনার ব্যাপরে আরো কিছু জানতে পারি নি ।

IMG 20210201 WA0021


গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের একজন নামকরা জিমন্যাস্ট ছিলেন পান্নালাল বর্দ্ধন । এনার সাথে আমার একটা পারিবারিক সম্পর্ক আছে, ইনি আমার প্রপিতামহের ছোট ভাই । প্রিয়নাথ বসুর শিষ্য এ‌ই জিমন্যাস্টের স্পেসালিটী ছিল হরিজন্টাল বারের খেলা । প্রিয়নাথ বসুর নিজের কথায়, ব্যাক ফ্লাইং এবং ডবল সমার্সল্টে এনার মত দক্ষ খেলোয়াড় তখনকার দিনে ইংরেজদের মধ্যেও বিরল ছিল । 1900 সালে প্যারিস এক্সিবিশনে মতিলাল নেহরু যে কলাকুশলীদের টিম পাঠান তার মধ্যে ইনিও ছিলেন । এঁর আর একটি গুণ ছিলো, ইনি ভালো ক্ল্যারিওনেট বাজাতেন ।

IMG 20210201 WA0022



যাঁর কথা বলে শেষ করব, তাঁর নাম যাদুকর গণপতি চক্রবর্তী । ইনি সার্কাসে যোগ দেন বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকার জন্যে , কিন্তু অল্প সময়ে তাঁর প্রতিভা প্রিয়নাথ বসুর নজরে আসে । সাধরনতঃ ম্যাজিসিয়ানরা স্টেজের ওপর ম্যাজিক দেখান, দর্শকেরা থাকেন অনেক দুরে, স্টেজের সমনে । কিন্তু গণপতি সার্কাস রিঙের খোলা জায়গায় ,যার তিনদিকে দর্শক আছে , সেখানে খেলা দেখাতেন। এনার একটি প্রসিদ্ধ খেলা ছিল ‘Illuision Box‘ । গণপতিকে পিছ্মোড়া করে বেঁধে একটা থলেতে পুরে , থলের মুখ বেঁধে একটা কাঠের বাক্সে পুরে , বাক্সটাকে দড়ি দিয়ে আস্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হত , আর তাতে একটা তালা লাগিয়ে চাবিটা কোন দর্শককে দিয়ে দেওয়া হতো । এরপর বাক্সের ওপর তবলা আর আর একটা ঘন্টা রেখে দিয়ে বাক্সের চারপাশে পর্দা ফেলে দেওয়া হতো । এবার দর্শকদের মধ্যে কেউ কোন তালের নাম বললে পর্দার পেছনে তবলা সে‌ই তালে বেজে উঠত। খেলার শেষ অংশে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে গণপতি পর্দার বাইরে আসতেন্, আর দর্শকদের কাছ থেকে নানা রকম জিনিস, যেমন, চশমা, ভিজিটিং কার্ড, আংটি ,ইত্যাদি সংগ্রহ করে বাক্সটা তিনবার প্রদক্ষিণ পর্দা তুলে ভেতরে ঢুকে পড়তেন । সাথে সাথে পর্দা তুলে দেখা যেত গণপতি ভতরে নে‌ই । বাক্স খুললে ভেতরে থলিতে পোরা গণপতিকে পাওয়া যেত, সঙ্গে দর্শকদের থেকে সংগৃহীত জিনিষপত্র। তাঁর আর একটা খেলা ছিলো Illusion Tree | গনপতিকে হাতকড়া, পায়ে বেড়ি পরিয়ে শেকলে দিয়ে একটা ক্রুশের সঙ্গে বেঁধে সামনে একটা হারমনিয়াম রেখে চারদিকে পর্দা ফেলে দেওয়া হত । এবার এক-দুই-তিন বলা মাত্র ভরে হারমানিয়াম বেজেহে উঠত । বাজনার শেষে আবার এক-দুই-তিন বলার সাথে সাথে পর্দা তুলে দেখা যেত গণপতি শেকলে আগের মত‌ই বাঁধা রয়েছেন।

বাঙালীর সার্কাস বাঙালীর উদ্যমশীলতার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু কোন অজানা কারণে আমরা আজ এর কথা সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছি । শুধু তাই নয় দুঃখের কথা ‘সার্কাস’ কথাটা এখন বাঙলা ভাষায় একটা শ্লেষাত্মক রূপ পেয়েছে ।