২৬ এপ্রিল রাজ্যের সপ্তম দফার ভোট। অতএব নির্বাচন পর্ব একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছে। সোমবার সপ্তম দফার ভোটের দিন মুর্শিদাবাদ, মালদা, পশ্চিম বর্ধমান জেলাগুলির পাশাপাশি কলকাতার দক্ষিণ ভাগের কেন্দ্রগুলিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মোট ৩৭ টি কেন্দ্রে ঐদিন ভোট দেবেন সাধারণ মানুষ। তবে করোনা পরিস্থিতির জন্য আগের ছয় দফার নির্বাচনের থেকে সপ্তম দফার ভোট অনেকটাই ব্যতিক্রম। নির্বাচন কমিশন প্রচার পর্ব এবং ভোটের জন্য যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণ মানুষকেও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রেখে ভোট দিতে যেতে হবে। নির্বাচন পরিস্থিতির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নতুন করে সামনে উঠে এসেছে। ভোট দানের সময় মানুষ এই বিষয়গুলো মাথায় রাখবেন বলে অনুমান। যে সাতটি কারণে সপ্তম দফার ভোট অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সে দিকে আমরা চোখ রাখব।


১) মালদায় খাতা খুলতে পারবে তৃণমূল?

২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকারকে হারিয়ে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট। যদিও কিছুদিনের মধ্যেই কংগ্রেস সরকার থেকে বেরিয়ে গেলে তৃণমূল একাই সরকার চালায়। কিন্তু ওই ভোটেও মালদা জেলায় একটি আসনেও জয়ী হয়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে গোটা রাজ্যে একাই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করেছিল তারা। সেবারেও মালদা জেলায় খাতা খুলতে পারেনি রাজ্যের শাসক দল। এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ রাজ্যের শাসক দল একটি জেলায় একদম খাতা খুলতে পারছে না তা অত্যন্ত বিরল ঘটনা।

২০১৪ এবং ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনেও মালদা জেলার দুটি লোকসভা কেন্দ্রের একটিতেও জয়লাভ করতে পারেনি তৃণমূল। উত্তরবঙ্গের এই জেলাটি তাদের বরাবরের বদ্ধভূমি হিসেবে থেকে গিয়েছে। মালদা জেলার বারোটি বিধানসভা কেন্দ্রের একটিতেও জয়লাভ করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ঘুরপথে অন্যদলের বিধায়কদের নিজেদের দিকে টেনে আনা, দল ভাঙিয়ে জেলা পরিষদ এবং পুরসভা ও পঞ্চায়েত দখল করার মতো ঘটনা ঘটাতে হয়েছে তৃণমূলকে। এবারের নির্বাচনের আগেও এই জেলার রাজনৈতিক সমীকরণ তাদের অনুকূলে নয়। এখানে লড়াই হচ্ছে বিজেপির সঙ্গে সংযুক্ত মোর্চার। বলা যেতে পারে মালদা জেলায় তৃণমূল একটি আসনে জয়ী হলে সেটাই তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হবে।

ভোট প্রচারে মালদায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও অনুযোগের সুরে বলেছেন তিনি মালদা জেলার জন্য সবকিছু করলেও এখানকার মানুষ তার দলকে ভোট দেন না। তাই মালদা জেলায় প্রথমবারের জন্য খাতা খোলার লড়াই লড়ছে তৃণমূল।


২) শুভেন্দুর বিদায়ে মুর্শিদাবাদ হাতছাড়া হবে কি তৃণমূলের?

মুর্শিদাবাদ জেলাতেও তৃণমূলের অবস্থা অনেকটা মালদার মত ছিল। যদিও এখানে অল্পবিস্তর ঘাস ফুল ফুটছিল। কিন্তু মুর্শিদাবাদ জেলার দায়িত্ব শুভেন্দু অধিকারীর হাতে তুলে দেওয়ার পর এখানে ঘাসফুল শিবিরের রমরমা শুরু হয়। ২০১৯ এর লোকসভা ভোটে মুর্শিদাবাদের তিনটি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে দুটিতেই জয়ী হয় তারা। বলা যেতে পারে এই জেলার দলীয় সংগঠন পুরোটাই গড়ে উঠেছিল শুভেন্দুর হাত ধরে। পরে শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের একটা বড়ো অংশও দল ছাড়ে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে তারা সবাই যে বিজেপিতে গিয়ে সামিল হয়েছে তা নয়, অনেকেই পুরানো দল কংগ্রেসে ফিরে এসেছে।

মুর্শিদাবাদ জেলায় তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব অত্যন্ত তীব্র। এই পরিস্থিতিতে অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বে এখানে কংগ্রেস নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করার পর কিছুটা হলেও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তৃণমূল। যদিও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই জেলায় বিজেপি এখনও তৃতীয় শক্তি হয়েই আছে। তাই তৃণমূল ও সংযুক্ত মোর্চার মধ্যে এই জেলায় ভোটের লড়াই হলেও অনেকটাই অ্যাডভান্টেজ অবস্থায় আছে মোর্চা। তাদের একটাই মাইনাস পয়েন্ট কিছু জায়গায় কংগ্রেসের সঙ্গে বামফ্রন্টের অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে। তবে সেই অন্তর্দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারলে মুর্শিদাবাদে আবার কংগ্রেস-সিপিআই(এম) এর দাপট দেখা যেতে পারে।


৩) পশ্চিম বর্ধমানে বিজেপির সঙ্গে লড়াই কাদের?

কয়লা খনি এবং শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত পশ্চিম বর্ধমান জেলার বিধানসভা কেন্দ্র গুলোতে বিজেপির রমরমা অবস্থা দিনের আলোর মত পরিষ্কার। বিশেষ করে এই এলাকার অবাঙালি ভোটের বেশিটাই গেরুয়া শিবিরের দিকে হেলে আছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে তাদের সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাদের তা নিয়ে। প্রচারের জাঁকজমকে তৃণমূল অনেকটাই দৃশ্যমান হলেও এখানকার বিজেপি বিরোধী সাধারণ মানুষের একটা বড়ো অংশের মনে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীরা জায়গা করে নিয়েছে বলে খবর। বিশেষত এখানকারই জামুরিয়া বিধানসভা কেন্দ্রে ঐশী ঘোষের মত ছাত্র নেত্রীকে সিপিআই(এম) প্রার্থী করায় তা যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে গোটা শিল্পাঞ্চলে। আবার পরপর দু’বার এই অঞ্চলে বিজেপির সাংসদ নির্বাচিত হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি বলেও অনেকের ক্ষোভ আছে। তাই তৃণমূলের দাবি ছাপিয়ে গিয়ে এই জেলায় বিজেপির মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে আসতে পারে সংযুক্ত মোর্চা। যদিও তৃণমূলের অবস্থান একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। সব মিলিয়ে আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের ভোটচিত্র এবারে একটু জটিল।


৪) দক্ষিণ কলকাতায় আদৌ প্রভাব ফেলতে পারবে বিজেপি?

সপ্তম দফার ভোটে দক্ষিণ কলকাতার যে চারটি কেন্দ্রে নির্বাচন হবে সেগুলি বরাবরই তৃণমূলের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এই চার কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থীরা রাজ্য রাজনীতির অন্যতম হেভিওয়েট। কিন্তু এবারে এখানে দাঁত ফোটানোর জন্য মরিয়া লড়াই চালাচ্ছে বিজেপি। যদিও তারা খুব বিশেষ কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কারণ তৃণমূলের দলীয় অবস্থানের পাশাপাশি এই এলাকার প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে দলীয় তৃণমূল প্রার্থীরা ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির ওপর ভর দিয়ে ক্ষামতি পূরণ করে দিতে পারেন বলে একাংশের অভিমত।

বিজেপি মূলত এই চারটি কেন্দ্রের মধ্যে রাসবিহারী ও ভবানীপুরকে টার্গেট করেছে‌। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী রাসবিহারী কেন্দ্রে তারা এগিয়েছিল। যদিও কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন মেয়র পারিষদ দেবাশীষ কুমারকে প্রার্থী করে নিজেদের খামতি তৃণমূল অনেকটাই মিটিয়ে ফেলতে পেরেছে বলে মনে করা হচ্ছে। আবার ভবানীপুর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরানো কেন্দ্র। এইখানে অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষকে প্রার্থী করে জেতার চেষ্টা করছে গেরুয়া শিবির। যদিও এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় রাজ্য রাজনীতির অন্যতম হেভিওয়েট। তবে এই দুটি কেন্দ্র তৃণমূলের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে বিজেপি। আবার বালিগঞ্জ কেন্দ্রটিতে তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত মুখার্জির সঙ্গে মূল লড়াই হচ্ছে সিপিআই(এম) প্রার্থী ফুয়াদ হালিমের। সব মিলিয়ে বলা যায় দক্ষিণ কলকাতায় নিজেদের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার লড়াই লড়ছে বিজেপি। যদিও পরিস্থিতি তাদের খুব একটা অনুকূল নয়।


৫) লড়াইয়ে ফিরে আসার যুদ্ধ মোর্চার-

সপ্তম এবং অষ্টম দফায় সংযুক্ত মোর্চার ঘাঁটিগুলোতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলা যেতে পারে। এই দুই দফায় পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখার যুদ্ধ লড়বে মোর্চা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে সপ্তম দফার নির্বাচনে নিজেদের প্রভাবিত এলাকাগুলিতে মরণ কামড় দেবে সংযুক্ত মোর্চা। তবে এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে যে শরিকি বিভেদ আছে তা একেবারে পিছনের সরিয়ে রেখে তাদের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া জরুরী। কারণ শরিকি বিভেদ মিটিয়ে নিতে না পারলে সেই সুযোগে বিজেপি এবং তৃণমূল ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাবে।


৬) করোনা বিধি কতটা কার্যকর হয়-

সপ্তম দফার নির্বাচনের আগে ২৩ এপ্রিল নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বাকি দুই দফার নির্বাচনের আগে আরও কঠোর করোনা বিধি জারি করা হয়। কমিশন পরিষ্কার জানিয়েছে প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীকে এই করোনা বিধি মেনে চলতে হবে। ভোটের দিনে শারীরিক দূরত্ব রেখে ভোটারদের লাইন দেওয়া, মাস্ক এবং স্যানিটাইজার সঠিকভাবে ব্যবহার করার মতো কঠোর নির্দেশিকা জারি করেছে নির্বাচন কমিশন। তাই সপ্তম দফার ভোটে প্রথম দেখা যাবে সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক দলগুলি কতটা করোনা বিধি মেনে চলছে। সেই সঙ্গে এই বিধি কার্যকর করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন ঠিক কী ভূমিকা নিচ্ছে সেটাও এই দিনই পরিষ্কার হয়ে যাবে।


৭) করোনা আবহাওয়া ভোটারদের মনে কতটা প্রভাব ফেলবে?

এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ হাজারের গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলে। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ ভোটাররা প্রবল আতঙ্কে ভুগছেন। অনেকেই দাবি তুলেছেন এই মুহূর্তে জনস্বাস্থ্যের কথা ভেবে ভোট প্রক্রিয়া বাতিল করে দেওয়া জরুরি। তাই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ভোটারদের একটা বড়ো অংশ করোনা আতঙ্কের জন্য ভোট কেন্দ্রমুখী নাও হতে পারেন। সেক্ষেত্রে রাজ্যে ভোটদানের হার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেতে পারে। অর্থাৎ সপ্তম দফার নির্বাচনে পরিষ্কার হয়ে যাবে করোনা আতঙ্ক সাধারণ মানুষের ভোট নিয়ে উৎসাহে ঠিক কতটা প্রভাব ফেলছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলির‌ও হিসেব-নিকেশ যথেষ্ট ওলট-পালট হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।