সুনন্দাদেবীর রান্নাঘর: মালপোয়া (০১)

  গোপাল সেবা করে তাকে আবির মাখিয়ে মন দিয়ে পুজোটা সেরে শঙ্খ বাজালেন সুনন্দাদেবী। ভোগের থালাটা নিয়ে দরজার কাছে আসতেই লাল আবিরে পূর্ণ হাতদুটি সোজা সুনন্দাদেবীর গালে, কোনমতে ভোগের থালাটা সরিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন… ‘ভীমরতি হয়েছে নাকি, বুড়োবয়সে?’
 ‘হ্যাঁ’, বলেই সাদা পাঞ্জাবীতে অনন্য সুনীল বাবু আস্তে করে হাত থেকে থালাটা সরিয়ে রেখে গোটা আবিরের প্যাকেটটাই ঢেলে দিয়ে স্মিত হেসে বললেন, ‘বয়সটা শরীরের হয়েছে, মনের নয়’, বলেই বুকের কাছে হাতটা চেপে ধরেই দ্রুত পদে উঠে গেলেন ছাদে।
এক মাথা ভর্তি আবির নিয়ে সুনন্দাদেবী ধীরে ধীরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালেন। পঞ্চান্ন ছুঁই ছুঁই সুনন্দাদেবীর গালেও যেন কিশোরীর আভা, যেন সদ্য বিবাহিতা সেই ঊনিশের মেয়েটি।
  আবার উঠে গেলেন ঠাকুর ঘরে। গোপালের পায়ে দেবার জন্য আনা হলুদ আবিরের প্যাকেটটি হাতে নিয়ে বিড়ালের ন্যায় ধীরে ধীরে উঠে গেলেন ছাদে। 
ছাদের গাছ গুলোয় আজ ফুলের সমাহার। রক্ত করবী ফুটেছে থোকায় থোকায়। আর দূরে একটা চেয়ার টেনে বসেছেন সুনীল বাবু। দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে মুখে একটা দুষ্টু হাসি, নিজের কর্মের জন্য নিজেকেই বাহবা দিচ্ছেন মনে মনে, আর বুকে একটা লাল হাতের স্পর্শ… ভালোবাসা প্রকাশের চিহ্ন।
  হলুদ আবিরের প্যকেট সহ মাথায় ঢালতে যেতেই দুই হাতে মুঠো করে রাখা হলুদ আবির সুনন্দাদেবীর গালে দিয়ে হাত দুটো দিয়ে ধরে ফেলেন সুনন্দাদেবীর হাত। আর হা হা হা করে প্রাণখোলা হাসিতে আকাশ বাতাস উত্তাল করে তোলেন। দুই হাতে বন্দী সুনন্দাদেবী, নিজের মাথাটাই ঘষে দিলেন সুনীলবাবুর গালে, ও নিজের গালের হলুদ আবির লাগাবার জন্য তাঁর গালে নিজের গাল ঠেকাতেই পাশের মেহগনি গাছের পাতার ফাঁক থেকে ডেকে উঠল কু কু কুহু…..
  লজ্জায় মুখ লুকোলেন সুনীলবাবুর বুকে। আর নিজের মাখানো হলুদ ও লাল রঙে রেঙে উঠলেন তিনিও। হাতটা ছেড়ে আলতো করে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন… ‘বাসন্তিক শুভেচ্ছা সু।’ বহুদিন পর এ নাম শুনে আরো আঁকড়ে ধরলেন তিনি সুনীলবাবুকে।
  ‘ছাড়ো, নীচে যাবো। চা করতে হবে’, বলেই একটু হলুদ আবির তাঁর পায়ে ছুঁয়ে সে অবিরমাখা হাত নিজের মাথায় দিলেন। টুপ করে স্ত্রীকে বুকের মাঝে আবারও টেনে নিলেন সুনীলবাবু।
  চা করে এনে দিয়ে বললেন, ‘আজ বাজার যাবে? বাইরে সব্বাই তো রং দিয়ে দেবে?’ 
 ‘কি আনতে হবে বলুন, মহারানী। আমাকে রঙ দেওয়া যে সবার পক্ষে সম্ভব নয়, তার প্রমান তো পেলেন’, বলেই আবার সেই হা হা হা করে হাসি।
 ‘আজ দোল পূর্ণিমা, মালপোয়া বানাব।’ কয়েকটা জিনিস আনলে ভালো হত। 
 ‘লিস্টি করে দিলেই চলে আসবে’, বলেই প্রস্তুত হতে গেলেন।
বাজারে বের হলেন সুনীলবাবু। আর আলুর দম ও চাটনী বানালেন সুনন্দাদেবী। দুপুরে গরম গরম লুচি বানাবেন আজ। আর সাথে মালপোয়া।
  দুধটা বসিয়ে নাড়তে থাকলেন, এক কিলো দুধ আধ কিলো করতে করতেই সুনীলবাবু ময়দা ও এলাচ নিয়ে ফিরলেন।
  একটি পাত্রে চিনি ও জল দিয়ে সেরা করতে বসালেন। ঘনদুধে আস্তে আস্তে ময়দা দিয়ে মাখতে থাকলেন, একটু লেই মত করে ফেটাতে থাকলেন, সামান্য বেকিং পাউডার দিলেন।
  সেরাটা না খুব ঘন না খুব পাতলা এমন নামালেন। এলাচ গুঁড়ো ও জাফরান ছড়িয়ে দিলেন তাতে।
  কড়াই বসালেন, ঘি দিলেন তাতে। বাড়িময় সুগন্ধ ছড়ালো। ধীর পায়ে রান্না ঘরে সুনীলবাবু, ‘উফফফ কি সুন্দর গন্ধ, বাইরে মন টিকছে না।’
‘খবরদার! বলছি, আর জ্বালাতন করবে না। যাও বাইরে গিয়ে বসো। আমি খাবার নিয়ে যাচ্ছি।’ লাল ও হলুদ আভায় যেন অনন্যা সুনন্দাদেবী। তাকিয়ে থাকলেন নিজের স্ত্রীর দিকে। 
 একটু লজ্জা পেয়ে সুনন্দাদেবী বললেন,

‘ছেলেমানুষী কোরো না যাও…’ অগত্যা আবার বাইরে বের হয়ে এলেন সুনীলবাবু।
  সুনন্দাদেবী গরম ঘিয়ে মিশ্রণটি হাতায় করে ছাড়লেন, দুইপাশ বাদামী করে ভেজে চিনির সেরাতে ছেড়ে দিলেন। এরপর
ভেজে তুললেন গরম গরম লুচি। তারপর একটা প্লেটে মালপোয়া তুলে সামান্য কাজু, পেস্তা ছড়িয়ে লুচি তরকারির সাথে গরম গরম পরিবেশন করলেন।
  তৃপ্তি করে সেই মালপোয়া খেয়ে দরাজ গলায় বলে উঠলেন সুনীলবাবু, ‘আমায় যদি স্বর্গে যেতে বলে তাও তোমায় নিয়ে যাবো, নরকেও।’
 ‘মরণ’, বলে ঘরে গিয়ে বিছানায় শুলেন সুনন্দাদেবী। পাশে সুনীলবাবুও শুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আর পরম নিশ্চিন্তে তাঁর বুকে মাথা রেখে দুপুরে না ঘুমানো সুনন্দাদেবী আজ ঘুমিয়ে পড়লেন।