সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।সত্যজিৎ রায়ের প্রিয় অভিনেতা ছিলেন তিনি। অপর্ণা সেনের প্রথম নায়ক। আর সেই ১৯৫৯ সাল থেকে তিনি ছিলেন বাংলা তথা আপামর চলচ্চিত্র প্রেমীদের চিরকালীন ‘অপু’।
আজ আমাদের মধ্যে আর নেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। দীপাবলির পর দিন সমস্ত দীপ নিভিয়ে দিয়ে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে উদয়ন পন্ডিতের পাঠশালা। ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে চেনা শহরের অলি গলি, রাজপথ। রোগক্লিষ্ট বছরটা আরো একবার জানান দিয়েছে, ২০২০ শুধু নিয়েই নেয় না, সেই সঙ্গে আর না ফেরার বার্তাটুকুও গেঁথে দিয়ে যায় মনের একেবারে গভীরে।
১৯৩৫ থেকে ২০২০,সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ৮৫ বছরের জীবনটার দিকে ফিরে তাকালে কিন্তু দেখা যায়, বরাবরই মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করা একটা চিরঞ্জীবি রসদ। বাঙালির খুব চেনা সেই ভুবন ভোলানো হাসি দিয়েই গোটা জীবনটা মোড়া তাঁর। আর তাই ‘কোনি’ ছবির ক্ষিতীশ সিংহের হার না মানা ফাইটিং স্পিরিটে ভর করেই কখনো তিনি বলে ওঠেন “মৃত্যু, আয় তিন পাত্তি খেলি আয়!” আবার কখনো বলেন, “ওই যায় শবযাত্রা আমার, দু-হাতে ওড়াও বিন্নি খই..।”৯০-এর দশক জুড়ে বাঙালি ড্রইংরুমের একচেটিয়া সঙ্গী এই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় গোটা জীবনে অগুন্তি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাঁর সেরা ১০ ছবি কোনগুলো? আসুন একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক সেই তালিকায়।
১) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অপুর সংসার:
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সেরা ছবির তালিকায় ‘অপুর সংসার’ই যে শীর্ষে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এই ছবি পথের পাঁচালির সিক্যুয়েল। এটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৯ সালে। এটিই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি। এতে তাঁর বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। তাঁরও প্রথম ছবি ছিল অপুর সংসার।
২) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জয় বাবা ফেলুনাথ:
‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ফেলুদা সিরিজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি। এই ছবির হাত ধরেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বাঙালি চিনে ছিল ফেলুদা হিসেবে। বেনারসের মগনলাল মেঘরাজের সঙ্গে গোয়েন্দা ফেলু মিত্তিরের দ্বন্দ্বের টান টান উত্তেজনা সেই ১৯৭৯ সাল থেকে বাঙালির মনে গেঁথে আছে চিরকালীন হয়ে।
৩) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চারুলতা:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নষ্টনীড় গল্পটিকে সিনেমার আকারে বড় পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৪ সালে। এই ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। দেওর-বউদির সম্পর্কের যে ছবি এখানে ফুটে উঠেছে তা বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে অমর হয়ে থাকবে।
৪) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বেলাশেষে:
বিশ শতক পেরিয়ে এবার একটু চোখ রাখা যাক একুশ শতকের রঙিন চলচ্চিত্রে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ ‘বেলাশেষে’। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায় পরিচালিত এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল ২০১৫ সালে। দর্শকের মাঝে প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করছিল এই ছবি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন স্বাতিলেখা সেনগুপ্ত।
৫) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের হীরক রাজার দেশে:
‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এর সিক্যুয়েল ‘হীরক রাজার দেশে’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অন্যতম সেরা কাজ। উদয়ন পন্ডিত আর তাঁর পাঠশালা বাঙালি দর্শকের মনে গেঁথে থাকবে চিরকাল। এই ছবিতে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে জয় ছিনিয়ে নিতে শিখিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবির আবেদন আজও একই ভাবে বর্তমান সকলের মনে।
৬) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সোনার কেল্লা:
ফেলুদা সিরিজের আরেকটি ছবি সোনার কেল্লা। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল এই ছবি। এই ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ও অমর হয়ে আছে বাঙালি দর্শকদের। ফেলুদার ভূমিকায় তাঁর স্টাইল আজও জনপ্রিয়।
৭) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে বাইরে:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় নির্মিত অপর একটি কালজয়ী ছবি ‘ঘরে বাইরে’। এই ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন সন্দীপের ভূমিকায়।১৯৮৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল ঘরে বাইরে ছবিটি।
৮) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বসন্ত বিলাপ:
অপর্না সেনের বিপরীতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ভরপুর কমেডি ছবি বসন্ত বিলাপ। দীনেন গুপ্ত পরিচালিত এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে। সত্যজিৎ ঘরানার বাইরে এই ছবিতেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নিজ দক্ষতায় সমুজ্জ্বল।
৯) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কোনি:
কোনি ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ের কথাও না বললেই নয়। সাঁতারের প্রশিক্ষক হিসেবে ক্ষিতিশ সিংহ ওরফে ক্ষিদ্দা এক কথায় অনবদ্য। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৪ সালে।
১০) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অশনি সংকেত:
১৯৭৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং সন্ধ্যা রায় অভিনীত অশনি সংকেত। বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত গল্পের অবলম্বনে এই ছবির পরিচালনাতেও ছিলেন সত্যজিৎ রায়।