মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃতীয়বার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ইতিমধ্যেই শপথ নিয়েছেন। রবিবার তিনি তার মন্ত্রিসভা গঠন করবেন। প্রথম তিনটি তৃণমূল সরকারের যে নির্বাচনী সাফল্য দেখা যাচ্ছে তা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করতে পারে বামফ্রন্ট সরকারকে। তারাও প্রথম থেকেই এরকম অপ্রতিরোধ্য ছিল।

বামফ্রন্ট সরকার ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম ক্ষমতায় আসে। এরপর তারা প্রথমবার কিছুটা ধাক্কা খেয়েছিল ১৯৮৪ সালের লোকসভা ভোটে। সেবার প্রবল কংগ্রেস হওয়ায় এ রাজ্যে ২০ টি আসনে জিতেছিল বিরোধী প্রার্থীরা। একইরকমভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কা খেয়েছেন। কিন্তু বামফ্রন্ট যেমন পরবর্তীকালে ধাক্কা সামলে নিতে পেরেছিল দেখা যাচ্ছে মমতাও সেরকমই ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে যাবতীয় ধাক্কা সামলে নিয়েছেন। উল্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয় তৃণমূল সরকার গঠন করলেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূলের এই সাফল্য দেখে অনেকেরই চোখ কপালে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু তৃতীয় তৃণমূল সরকারের চলার পথ খুব মসৃণ হবে মোটেও ব্যাপারটা তেমন নয়। বরং বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে মমতাকে। আমরা সেরকমই কিছু সমস্যার কথা আগাম আপনাদের সামনে তুলে ধরব।

১) গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব-

তৃণমূলের অভ্যন্তরে এতদিন আদি ও নব্যের দ্বন্দ্ব চলেছে। কিন্তু এবার আলাদা করে নব্য তৃণমূল বলে কিছুই প্রায় নেই। কিন্তু যা অনুমান আগামী দিনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামী যুব তৃণমূল কর্মীরা দলের ভেতর মূল ভূমিকায় আসতে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই এতদিন দলকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন যারা তারা নিজেদের জায়গা হারানোটাকে এত সহজে মেনে নেবে না। তাই এবারে নতুন প্রজন্ম বনাম পুরাতন প্রজন্মের লড়াই দেখা যেতে পারে তৃণমূলের অভ্যন্তরে। এই লড়াই সামলানোটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।

নতুন প্রজন্মের দলীয় কর্মীদের গুরুত্ব না দিয়েও তৃণমূল নেত্রীর কোন‌ও উপায় নেই। কারণ এবারের নির্বাচনী সাফল্যে এই নবীন প্রজন্মের অবদান অনেকটাই। স্বাভাবিকভাবেই তৃণমূলের ফার্স্ট জেনারেশন নেতারা এবার দলের অভ্যন্তরে কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে।

২) অভিষেককে নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করা-

মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পর তৃণমূলের হাল কার হাতে যাবে তা মোটামুটি সবাই জানে। কিন্তু তৃণমূলের অভ্যন্তরে অনেক নেতাই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত নন। তারা মমতার সঙ্গে যতটা সচ্ছন্দে কাজ করতে পারেন ততটা অভিষেকের সঙ্গে সম্ভব নয়। তাছাড়া অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাবভাব, চালচলন অনেকেরই বিরক্তির কারণ।

সব মিলিয়ে তৃতীয় তৃণমূল সরকার গড়ার পর নিজের ভাইপোকে সরকারিভাবে দলের মুখ করে তোলাটা এখন তৃণমূলনেত্রীর কাছে একটি কঠিন লড়াই। তৃণমূলের বেশিরভাগ প্রথম সারির নেতারা যদি অভিষেককে মেনে নিতে আপত্তি জানান তবে তৃণমূলনেত্রীর গোটা পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে।

৩) দুর্নীতি মুক্ত ভাবমূর্তি গড়ে তোলা-

প্রথম দুই তৃণমূল সরকার আমলে দুর্নীতির অভিযোগ সবচেয়ে ক্ষতি করেছে জোড়া ফুল শিবিরের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির গায়ে বেশ ভালোমতোই আঘাত করেছে এই অভিযোগ। স্বাভাবিকভাবেই তৃতীয়বার সরকার গঠন করার পর দুর্নীতির অভিযোগ গা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করবেন তৃণমূলনেত্রী। যদিও বিষয়টা এতটা সহজ নয়।

সরকার এবং দল সর্বস্তরে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কাটমানি নেওয়ার অভিযোগ সর্বজনবিদিত ঘটনা। একের পর এক তৃণমূল নেতারা এই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও বলছে এই সমস্ত অভিযোগ বেশিরভাগই স্মৃতি। এই পরিস্থিতিতে দলের ভাবমূর্তি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ করে তুলতে দুর্নীতির পথ থেকে সরে আসতে হবে তৃণমূলকে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিগতভাবে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির হলেও তার দলের নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশ তার পথ অনুসরণ করে না। স্বাভাবিকভাবেই দল এবং সরকারের অভ্যন্তরে দুর্নীতি বন্ধ করা মমতার এক বড় চ্যালেঞ্জ।

৪) বিজেপির ধর্মের রাজনীতিকে ঠেকিয়ে রাখা-

ভোটে তৃণমূল জিতলেও এ রাজ্যে বিজেপি দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তারা খুব একটা কম ভোট পায়নি। স্বাভাবিকভাবেই বাংলায় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ধারা বজায় রাখতে এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন ঠেকাতে হলে বিজেপিকে অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে হারাতে হবে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল সমস্যা হল তার দলের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক চরিত্র নেই। তাই বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মোকাবিলা করতে গিয়ে তার দলের কেউ কেউ পাল্টা সাম্প্রদায়িকতার পথে হেঁটে ফেলেন। এই ভুল এবার সংশোধন করতেই হবে তৃণমূলনেত্রী’কে, না হলে বিজেপিকে ঠেকানো সম্ভব হবে না।

৫) কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা-

গত দশ বছরে তৃণমূল রাজ্যজুড়ে উন্নয়নের ঝড় তুললেও কর্মসংস্থানের সুযোগ সেভাবে তৈরি করতে পারেনি। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে কর্মসংস্থান ইস্যু বারবার তাদের বিদ্ধ করেছে। তৃতীয় তৃণমূল সরকারের আমলে রাজ্যজুড়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।

বিশেষ করে রাজ্যের বিপুল সংখ্যক তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়ের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে এজন্য শিল্পায়নের পথে অবশ্যই হাঁটতে হবে মমতাকে। কিন্তু আদৌ কি তৃণমূলনেত্রী সেটা পারবেন? তার নিজের বেশকিছু নীতির জন্য এই সংশয় থেকেই যাচ্ছে!