পুরো নাম বারবারা মিলিসেন্ট রবার্টস । বয়েস ৬১ বছর। কিন্তু ‘বার্বি ’নামটুকুই এখন যথেষ্ট, গোটা পৃথিবী তাকে এক ডাকে চেনে।ষাটের দশক থেকে আজ অবধি ফ্যাশন পুতুল বাজারে জনপ্রিয়তার শীর্ষে এই পুতুল তারকা। শৈশব-কৈশোরের প্রতিটি মুহূর্ত থেকে শুরু করে জন্মদিন, বিবাহ, পেশা চয়ন, এমনকি অসুস্থতার মুহূর্তগুলিতেও মানুষের জীবনে সে আজ সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
কীভাবে তৈরি হয়েছিল বার্বি ডল? কেমন ছিল এই দীর্ঘ পথ চলা? আসুন, ফিরে দেখি বার্বি ডলের ইতিহাস। জেনে নিই বার্বি সম্পর্কে কিছু জরুরী তথ্য।
বার্বি ডলের জন্মকথা
সময়টা ১৯৫৫ সাল। সেসময় বাচ্চারা যেসব পুতুল নিয়ে খেলত সেগুলোর বেশিরভাগই ছিল কাগজ কিংবা কাপড়ের তৈরি। তার ওপর পুতুল মানেই ভাবা হতো একটি শিশুর অবয়ব, পুতুল যে শৈশব অতিক্রম করে কৈশোর কিংবা যৌবনের চেহারা পেতে পারে সে বিষয়ে তখনও কেউ গা করেনি।
ততদিনে আমেরিকায় বহুজাতিক খেলনা উৎপাদনকারী সংস্থা ম্যাটেল বেশ একটা জায়গা করে নিয়েছে। এলিয়ট এবং ম্যাট নামের দুই ব্যবসায়ী একত্রে ম্যাটেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এলিয়টের স্ত্রী রুথ হ্যান্ডলার তখন কোম্পানির কেনাবেচার দিকগুলো দেখতেন। বাড়ি ফিরে রুথ প্রায়ই লক্ষ্য করতেন তাঁর কিশোরী মেয়ে বারবারা কাগজের পুতুলদের বিশেষরকম কিছু জামাকাপড় পড়িয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের ভূমিকায় রেখে খেলতে চাইছে। সেই দেখে রুথের মাথায় একটা বুদ্ধি এল, তিনি তাঁর স্বামী এলিয়টকে বললেন – প্রাপ্তবয়স্ক চেহারার পুতুল বানালে কেমন হয়?
এলিয়ট তখন ম্যাটেলের কর্ণধার, তিনি এবং কোম্পানির অন্যান্য পরিচালক কেউই এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না। পরিণত চেহারার প্লাস্টিক পুতুল একেবারেই ভালো চোখে দেখবেনা সমাজ। কোন অভিভাবকই তাঁর সন্তানকে কিনে দিতে চাইবেন না। ফলে এধরণের পুতুল বানালে ম্যাটেলের লোকসান ছাড়া আর কিছুই নয়- এই বলে নিরস্ত করলেন রুথকে। কিন্তু রুথ তাতে দমলেন না । তিনি স্পষ্ট বুঝলেন যে কৈশোর আর যৌবনের মাঝখানটিতে উপযুক্ত খেলনা পুতুলের অভাব বোধ করছে মেয়েরা। বয়ঃসন্ধির মানসিক এবং শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুতুলের চাহিদাও পরিবর্তিত হতে বাধ্য। রুথের মাথায় রয়ে গেল সেই চিন্তার বীজ।
কিছুদিন পর সপরিবারে ইউরোপে ছুটি কাটাতে গিয়ে একটি সুইস দোকানে রুথ হঠাৎ দেখতে পেলেন পশ্চিম জার্মানির ফ্যাশন ডল ‘বিল্ড লিলি ’। বিল্ড লিলি তখন সদ্য ইউরোপের বাজারে এসেছে। পুতুলগুলোর উদ্দেশ্য ভিন্ন। তারা যৌন আবেদনে ভরা ,পরিনত চেহারার নারীমূর্তি যা কেবল ঠাট্টা করে বড়দেরই উপহার দেওয়া যায়, ছোটদের জন্য একেবারেই নয়। রুথ কিন্তু সেই বিল্ড লিলি ডল দেখেই আহ্লাদিত হলেন। মনে মনে ভাবলেন এইধরনের পুতুলই তো কৈশোর এবং যৌবনের মাঝের সময়ের ফাঁকটুকু পূরণ করতে পারত, এরকম কিছুই তিনি আসলে বলতে চেয়েছিলেন ম্যাটেলের কার্যনির্বাহীদের! নিজের ভেতরে জমিয়ে রাখা ইচ্ছের বাস্তবায়নে একটা বড় অনুপ্রেরণাস্বরূপ একটা বিল্ড লিলি ডল বাড়িতে কিনে আনলেন রুথ।
এরপর চলল দীর্ঘ পরিকল্পনা ও পরিশ্রম। বিল্ড লিলি ডলকে সামনে রেখে ইঞ্জিনিয়ার জ্যাক রায়ানের সাহচর্যে, বারংবার নক্সা পরিবর্তন করে রুথ একদিন বানিয়ে ফেললেন তাঁর স্বপ্নের প্রাপ্তঃবয়স্ক পুতুল, ‘বার্বি ডল’। নামটি রাখলেন কন্যা বারবারার নাম অনুসারে। ১৯৫৯ সালের ৯ই মার্চ, নিউইয়র্কের একটি খেলনার মেলায় বার্বিডলের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটলো।
প্রথম বার্বি ডল কেমন ছিল?
বার্বি ডলের সাধারণ মাপ সাড়ে এগারো ইঞ্চি। প্রথম বার্বির পোশাক ছিল একটি কালো-সাদা জেব্রা মার্কা স্যুইমসুট, মাথায় গোছ করে বাঁধা পনি টেইল। সোনালি এবং বাদামি চুল উভয় গড়নেই প্রথম বার্বি র মডেলটি উপলব্ধ ছিল। তার পোশাক তৈরি করেছিলেন ম্যাটেল ফ্যাশন ডিজাইনার শার্লট জনসন। ক্রমশই “টিন-এজ ফ্যাশন মডেল” হিসাবে বার্বি র চাহিদা বাড়তে শুরু করেছিল। প্রথম লটের পুতুলগুলো তৈরি হয়েছিল জাপানে। জাপানি গৃহবধূরা নিজে হাতে বার্বির পোশাক সেলাই করেছিলেন।
উৎপাদন ও বিপণন
উৎপাদনের প্রথম বছর অর্থাৎ ১৯৫৯ সালেই প্রায় ৩৫0,000 বার্বি ডল বিক্রি হয়েছিল। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে এবং সিনেমায় বার্বির উপস্থিতি দেখতে পেল সারা পৃথিবী। যদিও অভিভাবকরা প্রাথমিকভাবে এই পুতুল বাচ্চাদের কিনে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না, মূল কারণ হিসেবে বলা যায়, সেই প্রথম কোন পুতুলের শরীরে স্পষ্ট স্তনাভাস ও নিতম্ব দেখা যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে লুই মার্কস অ্যান্ড কোম্পানী ১৯৬১ সালের মার্চ মাসে ম্যাটেলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলো। তাঁদের অভিযোগ ম্যাটেল বিল্ড- লিলির নিতম্বের জয়েন্টের জন্য গ্রিনিয়ার এবং হাউসারের পেটেন্ট চুরি করেছে। অবশেষে মামলার নিষ্পত্তি করে ১৯৬৪ সালে ম্যাটেল বিল্ড- লিলি পুতুলের জন্য ২১,৬০০ ডলারের বিনিময়ে গ্রিনিয়ার এবং হাউসারের কপিরাইট এবং পেটেন্ট অধিকার কিনে নিতে বাধ্য হয়।
রূপান্তর ও সংযোজন
১৯৭১ সালের মধ্যে অনেকবার বার্বি র চোখ ও শারীরিক ভঙ্গিমা বদলানো হয়। বদলানো হয় বিপণন কৌশলও, কারণ ততদিনে প্রতি সেকেন্ডে বিশ্ব জুড়ে অন্তত তিনটি করে বার্বি বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য খেলনার সংস্থাও বার্বির অনুকরণে পুতুল বানাতে শুরু করেছিল। বার্বির পরিবারে ইতিমধ্যে এসেছিল আরও নতুন নতুন সদস্য। রুথের নিজের ছেলের নাম অনুসারে বার্বির পুরুষবন্ধু কেণ, ছোট বোন কেলি, যার পরবর্তী কালে নাম হয় চেলসিয়া এবং কিশোরী বোন স্টেসি তাদের মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিত। ২০১৩ সালের পর বার্বির বাজার কিছুটা পড়ে গেল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ ফিরে এল নতুন বিপনন কৌশল ” কার্ভি” সিরিজ নিয়ে। এখানে বার্বির চেহারা সাধারণ মানুষের মতো। তারাও বেঁটে , মাঝারি এবং দোহারা গড়ন হতে পারে সেটাও মানুষ আগে ভেবে দেখেনি। ইতিপূর্বে কেবল পেশার দিক থেকেই চমক দেখিয়েছিল চাঁদে যাওয়া মহাকাশচারী বারবি, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কিংবা আর্টিস্ট বার্বিরা। আবার জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যেতে তাই দেরি হলনা ম্যাটেল গোষ্ঠীর , সেইসঙ্গে বার্বিডলও আগের উচ্চতায় বিরাজ করতে থাকলো।
সকলের প্রিয় বার্বি
সদস্য সংখ্যা বর্তমানে বাড়তে বাড়তে অনেক এবং সেইসমস্ত চরিত্রদের নিয়ে গল্পেরও শেষ নেই। বার্বি পরিবারের সমস্ত চরিত্রদের নিয়ে তৈরি হয়েছে একের পর এক অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রও। সেখান থেকেই মানুষ তাদের নিত্য নতুন গল্প জানতে পারে। বাড়ি, গাড়ি, ইউনিকর্ন ঘোড়া, প্রাসাদ এসবকিছু নিয়ে রুপকথার জগৎ যেমন তৈরি হয়েছে শিশুদের জন্য, তেমনি পেশা চয়ন কিংবা রোলমডেল হিসেবেও রয়েছে বিভিন্ন বয়েসী বার্বি ডল। মানুষ তার নিজের বয়স ও পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো ধরনের বার্বি ডল পেতে পারে আজ। কোন অসুস্থ শিশুর মনোবল বাড়াতে আরেকটি সঙ্গীর ভূমিকায় থাকতে পারে ক্যান্সার পেশেন্ট বার্বি কিংবা হুইল চেয়ারে বসা বার্বি ও।
[…] […]
[…] […]
[…] […]