স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায় থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দলবদলের ঘটনা খুব একটা উল্লেখযোগ্য ছিল না। তাও যদি কেউ দলবদল করে থাকে তারা নিয়ম-নীতি মেনে তৎকালীন যে সাংবিধানিক পদে থাকতে, অর্থাৎ সাংসদ বা বিধায়ক পদে থাকলে তা থেকে ইস্তফা দিয়ে নতুন দলে যোগদান করত। এর অন্যতম উদাহরণ হল লোকসভার বর্তমান কংগ্রেস দলনেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী। তিনি প্রথমে বামপন্থী দল আরএসপির নেতা ছিলেন। পরবর্তীতে যাবতীয় পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে কংগ্রেসে যোগদান করেন।
পুরনো দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজের নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি করেছেন এরকম ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভুরি ভুরি আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জির কথা। তিনি কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন দল তৈরি করেন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিও একই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। যদিও তিনি পরবর্তীকালে আবার কংগ্রেসের ফিরে আসেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি স্বয়ং এক্ষেত্রে সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে তিনি নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করেন এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াইয়ের পর পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতা দখল করতে সফল হন। এছাড়াও সিপিআইএম ভেঙে তাদের তৎকালীন দুই প্রিয় নেতা সইফুদ্দীন চৌধুরী ও সমীর পুততুন্ড মিলে নতুন রাজনৈতিক দল পিডিএস তৈরি করেন।
পুরানো দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি উদাহরণ যথেষ্ট থাকলেও স্রেফ ক্ষমতার লোভে একটি রাজনৈতিক দল থেকে আরেক রাজনৈতিক দলে যাওয়ার ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে বলতে গেলে হালে শুরু হয়েছে। অভিযোগ করা হয় তৃণমূলের তৎকালীন সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায় এই প্রবণতার জন্মদাতা। তিনিই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দলবদলের এই উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিটি আমদানি করেন। সেই সময় তার হাত ধরে কংগ্রেস ও বামপন্থী দলগুলো থেকে অসংখ্য বিধায়ক, সাংসদ, পৌর ও পঞ্চায়েত প্রতিনিধি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করেছিল। পরবর্তীকালে এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম দুই যুবনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারী। শেষ কয়েক বছর ধরে আবার উল্টো স্রোত দেখা যাচ্ছে। মূলত তৃণমূল কংগ্রেস থেকে একাধিক বিধায়ক, পৌর ও পঞ্চায়েত প্রতিনিধিরা বিজেপিতে যোগদান করতে শুরু করেছে। অবশ্য বেশ কিছু কংগ্রেস ও বামপন্থী নেতাও এই স্রোতে সামিল হয়েছেন। নিন্দুকেরা বলে মুকুল রায় বিজেপিতে গিয়ে তার পুরানো “ফর্মে” আবার ফিরে এসেছেন। যদিও এই দলবদলের ঘটনাগুলিতে রাজনৈতিক আদর্শের কোনো জায়গা থাকে না। মূলত ক্ষমতার লোভেই এই শ্রেণীর নেতারা দলবদল করে থাকে। আমরা বরং এই রাজ্যের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দলবদলের ঘটনা ফিরে দেখি।
১) সুব্রত মুখার্জি
সুব্রত বাবু বর্তমানে রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী। এই বর্ষীয়ান রাজনীতিক একসময় জামা বদলের মতো ঘনঘন দলবদল করেছিলেন। সেই জন্য তার নাম হয়ে গিয়েছিল “তরমুজ”। দীর্ঘদিনের কংগ্রেস নেতা সুব্রত মুখার্জি তৃণমূল কংগ্রেস জন্ম নেওয়ার কয়েকবছর পর সেই দলে যোগদান করেন। কিন্তু তিনি তখনও কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন ইনটাকের রাজ্য সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেননি। পরবর্তী পর্যায়ে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে মতবিরোধ ঘটলে তিনি তৃণমূল ছেড়ে কংগ্রেসে ফিরে যান। বেশ কয়েক বছর কংগ্রেসের ঘর করার পর আবার দল ত্যাগ করেন তিনি। এই পর্যায়ে অল্প কিছুদিনের জন্য শরদ পাওয়ারের এনসিপিতে যোগদান করেন। তারপর আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের ফিরে আসেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে রাজ্যের মন্ত্রী হন।
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 1 images 30 1](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-30-1.jpeg)
২) সোমেন মিত্র
সৌমেন বাবু এই বছর লকডাউন চলাকালীন সময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সেই সময় তিনি কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি ছিলেন। এক সময়ের দাপুটে এই কংগ্রেস নেতা নব্বইয়ের দশকে কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন দলের প্রতিটি সক্রিয় কর্মীকে নামে চিনতেন। তার সঙ্গেই মতবিরোধের কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের কিছুদিন আগে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে আজীবনের এই কংগ্রেসী দল ত্যাগ করে তৃণমূলে যোগদান করেন। তিনি অবশ্য তার বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তৃণমূলে গিয়েছিলেন। ২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন এবং প্রথমবারের জন্য সাংসদ হন। পরবর্তীকালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মতবিরোধ ঘটলে সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আবার কংগ্রেসে ফিরে আসেন এবং কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব পান।
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 2 images 31 1](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-31-1.jpeg)
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 2 images 31 1](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-31-1.jpeg)
৩) মুকুল রায়
সাম্প্রতিক অতীতে রাজ্য রাজনীতিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দলবদলের ঘটনা এটিই। তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম লগ্ন থেকেই দলের সর্বভারতীয় সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন মুকুল রায়। মূলত তার সাংগঠনিক দক্ষতার ওপর ভর করেই রাজ্যের সর্বত্র সংগঠন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল তৃণমূল। তার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে সিপিআই(এম) এর মত সংগঠন ভিত্তিক দলের নেতারা বারেবারে ঘোল খেয়েছেন। দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা দখলের লড়াইকে কেন্দ্র করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হলে রাজ্যসভার সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি বিজেপিতে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি বিজেপির অন্যতম সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি।
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 3 images 32 2](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-32-2.jpeg)
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 3 images 32 2](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-32-2.jpeg)
৪) রেজ্জাক মোল্লা
সিপিআই(এম) এর কৃষক নেতা রেজ্জাক মোল্লা দলের অভ্যন্তরে “চাষার ব্যাটা” নামে পরিচিত ছিলেন। বরাবরের ঠোঁটকাটা এই লড়াকু নেতা দীর্ঘদিন ধরে বামফ্রন্ট সরকারের ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী ছিলেন। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের পরাজয়ের পর রেজ্জাক চেয়েছিলেন তাকে বিরোধী দলনেতা করা হোক। কিন্তু দল তার আবেদনে সাড়া না দিয়ে সূর্যকান্ত মিশ্রকে বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব দেয়। এর কিছুদিন পরেই তিনি দলত্যাগ করে তৃণমূলে যোগদান করেন।
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 4 images 33 3](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-33-3.jpeg)
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 4 images 33 3](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-33-3.jpeg)
৫) মানস ভুঁইয়া
মানস বাবু একসময় কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি ছিলেন। সেইসঙ্গে ২০১১ এর বিধানসভা নির্বাচনের পর কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা এবং তৃণমূল-কংগ্রেসের জোট সরকারে অন্যতম মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পান। পরে তৃণমূলের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে কংগ্রেস জোট থেকে বেরিয়ে আসলে মানুষ বাবুকেও মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দিতে হয়। কিন্তু ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই তিনি দলের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। পরবর্তীকালে দলত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করেন। তিনি এখন তৃণমূলের একজন রাজ্যসভা সাংসদ।
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 5 images 34 1](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-34-1.jpeg)
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 5 images 34 1](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-34-1.jpeg)
৬) শোভন চ্যাটার্জি
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের “কিচেন কেবিনেটের” অন্যতম সদস্য শোভন চ্যাটার্জি ছিলেন তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তৃণমূলের অভ্যন্তরে অত্যন্ত শক্তিশালী নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। একত্রে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও কলকাতার মেয়র ছিলেন। সেই সঙ্গে তৃণমূলের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সভাপতিও ছিলেন। দলের সঙ্গে মতবিরোধ ঘটায় শোভন বাবু কলকাতার মেয়র পদ এবং মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দিলেও, বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা না দিয়েই বিজেপিতে যোগদান করেন। তিনি বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন।
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 6 images 35 1](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-35-1.jpeg)
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 6 images 35 1](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-35-1.jpeg)
৭) অর্জুন সিং
রাজ্যের বাহুবলী নেতা নামে পরিচিত অর্জুন ছিলেন ভাটপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক এবং ভাটপাড়া পৌরসভার তৃণমূল পৌর প্রধান। লোকসভা ভোটে প্রার্থী হাওয়া নিয়ে বিতর্কের কারণে তিনি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেন এবং বিজেপির টিকিটে লোকসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভও করেন।
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 7 images 36 2](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-36-2.jpeg)
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 7 images 36 2](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-36-2.jpeg)
৮) মৌসম বেনজির নূর
মালদার প্রবাদপ্রতিম কংগ্রেস নেতা ও দেশের প্রাক্তন রেলমন্ত্রী গনি খান চৌধুরীর ভাগ্নি মৌসম মালদা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস সাংসদ এবং মালদা জেলা সভাপতি ছিলেন। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের কিছুদিন আগে তিনি দলত্যাগ করে তৃণমূলে যোগদান করেন। তবে তৃণমূলের টিকিটে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও পরাজিত হন মৌসম। তিনি বর্তমানে তৃণমূলের মালদা জেলার সভাপতি।
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 8 images 37 1](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-37-1.jpeg)
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 8 images 37 1](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-37-1.jpeg)
৯) খগেন মুর্মু
দীর্ঘদিনের সিপিআই(এম) বিধায়ক খগেন বাবু ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে দল ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগদান করেন এবং লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভ করেন তিনি।
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 9 images 38 2](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-38-2.jpeg)
![বঙ্গ রাজনীতিতে দল বদলের 10 কিসসা 9 images 38 2](https://www.banglakhabor.in/wp-content/uploads/2020/12/images-38-2.jpeg)
১০) সব্যসাচী দত্ত
সব্যসাচী বাবু তৃণমূলে থাকাকালীন একাধারে ছিলেন রাজারহাটের বিধায়ক এবং বিধাননগর পৌরনিগমের মেয়র। দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার পরেও দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এরপরই তিনি দলত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দেন। যদিও দলত্যাগ করার সময় বিধায়ক পদ থেকে তিনি ইস্তফা দেননি।
বঙ্গ রাজনীতির বর্তমান সময়ের দলত্যাগের ঘটনা নিয়ে তালিকা বানাতে বসলে তা বোধহয় শেষ করা যাবে না। সেই অতি দীর্ঘ তালিকা থেকে অতি উল্লেখযোগ্য দশটি দলত্যাগের ঘটনা এখানে উল্লেখ করলাম আমরা।