fbpx
Home সম্পাদকীয় বৈশিষ্ট্যযুক্ত বর্তমান সমাজের দুর্বলতা ও বাংলা বানান

বর্তমান সমাজের দুর্বলতা ও বাংলা বানান

কবি অপূর্ব দত্ত তাঁর ‘বাংলা টাংলা’ কবিতায় লিখেছেন…

“নেভার মাইন্ড, বেঙ্গলিটা না শিখলেও চলে।”

বাঙালি মা যখন ছেলের এমন ভরসা হয়ে ওঠে যে, বাংলাটা না শিখলেও চলে, তখন মানুষে কোথায় ‘কি’ হয় আর কোথায় ‘কী’ হয়… এটা শেখার খুব কি তাগিদ অনুভব করবে… কী জানি… আমার তো মনে হয় করবে না। স্বাভাবিকভাবেই ছেলে-মেয়েরা বাংলা ভাষায় ‘ভেরি পুওর গ্রেড’ পেতে পেতে একদিন যেন কোথায় যেন হারিয়েই ফেলে বাংলা ভাষার ঐতিহ্যগুলিকে। বাংলা তখন তথাকথিত অশিক্ষিতের জন্য।
এ হেন ব্রাত্য বাংলা ভাষার বানানের প্রতি নজর দেবার প্ৰয়োজনীয়তা হারাচ্ছে বাঙালি সমাজ তথা সম্পূর্ণ বাঙালি জাতি।

বাংলা
independent24×7

বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থান:-

আমরা যখন ছোট ছিলাম, বাংলা ভাষার একটা আলাদা মাধুর্য ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে মানুষের চিন্তাধারা। রাস্তা, ঘাট, অফিস, কাচারী থেকে শুরু করে যে কোনো মানুষ তার বলা একটি বাক্যে যদি অন্তত একটা ইংরেজি, নিদেনপক্ষে হিন্দি শব্দও যোগ করতে পারে… তবে তার মধ্যে একটা ‘সেই’ ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। আর তথাকথিত ‘বাংরেজি’ নিয়ে বিশেষ কিছু নাই না বললাম।


বর্তমানে বাংলা বানান ভুলকে আমরা অপরাধ হিসেবে বা লজ্জা হিসেবে গ্রহণ করাটাও কমিয়ে দিয়েছি। বরং ইংরেজী বানানে ভুল থাকাটা লজ্জার, অগৌরবের।
রাস্তার দু’পাশের সাইনবোর্ড, ব্যানার, দেওয়াল-লিখন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের বাংলা লেখার হাল দেখলেই এই সত্যটা চোখে পড়বে।
ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল বানানে লেখাটাকেও আমরা যুক্তির নিরিখে প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছি, ভাবটা তো প্রকাশ পেলেই হল…বানানের প্রতি নজর দেওয়াটা এখানে ‘অতি পাকামি’ ইত্যাদি অভিধা পেয়ে থাকে।

বানান নিয়ে মতান্তর:-

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গিয়েছেন… “বর্তমান বাংলা বানানে যে বিশৃঙ্খলা চলছে তার মধ্যে একটা শৃঙ্খলা স্থাপন করা আবশ্যক এবং এ কাজের ভার বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেই গ্রহণ করা উচিত৷” তাঁরই প্রস্তাব অনুসারে গঠিত হয় বহুল পরিচিত “কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান-সংস্কার-সমিতি৷” ১৯৩৬ সালের মে মাসে “বাংলা বানানের নিয়ম” প্রথম পুস্তিকাও প্রকাশ হয়। তিনিই জানান…”বাংলাভাষার নিজস্ব ব্যাকরণ নেই।” এরপর যদিও তিনি “বাংলা শব্দতত্ত্ব” ও “বাংলাভাষা-পরিচয়” গ্রন্থে প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ রচনার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন৷
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এত প্রচেষ্টা তবু আজও বাংলা বানানে বাঙালির দুর্বলতা যেন চরম শিখরে পৌঁছেছে। তা যেন এক নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে।

বাংলা ভাষায় বানানের প্রতি নজর দেবার প্ৰয়োজনীয়তা হারাচ্ছে বাঙালি:-

বাংলা ভাষায় বানানের প্রতি নজর দেবার প্ৰয়োজনীয়তা হারাচ্ছে বাঙালি এর কারণ কী?
প্রথমত: অবশ্যই আমাদের বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রতি অনীহা।
দ্বিতীয়ত: বাংলা বানান বিষয়ে অসচেতনতা।
তৃতীয়ত: বাংরেজি ভাষার ব্যবহার। না আছে ইংলিশ সম্পূর্ণ বলার দক্ষতা আছে আমাদের, না আছে সম্পূর্ণ ছাড়ার মানসিকতা।
চতুর্থত: বানান নিয়ে আলোচিত বিভ্রান্তি। ছোট থেকে এক রকম শুনে বড় হয়ে ওঠার পর জানতে পারি, সেটা ঠিক নয়। এসলতা অন্য, তখন সেটা পরিবর্তন করতে না পারার জন্যও ভুল হয়।
পঞ্চমত: বাংলা একাডেমি কর্তৃক বানানবিধি পরিবর্তন করার ফলে বিভ্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

বাস্তব পর্যালোচনা:-

যদি বাস্তব পর্যালোচনা করা যায়, তবে এক্ষেত্রে কিন্তু সম্পূর্ণ দোষ বাঙালির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোকে দেওয়া যায় না। হঠাতই বাংলা একাডেমির বাংলা বানান বিধিতে রদবদল…এর একটা অন্যতম কারণ।
শৈশব থেকে আমরা যে বানান পড়ে বড় হলাম, হঠাতই একটা নির্দেশিকা সেই বানান গুলোকে ভুল বলে দিল…. দিল না কোনো যুক্তি, ব্যাখ্যা ও গ্রহণযোগ্যতা। স্বাভাবিক বাঙালি মনে প্রশ্ন জাগলো….আগের বানান গুলো বাতিল হলো কোন যুক্তিতে। এত বড় একটা পদক্ষেপ নেবার সাথে সাথে সার্বিক প্রচারটা বড্ড জরুরি ছিল।


‘শ্রেণী’ কেন হয়ে গেল ‘শ্রেণি’…..যুক্তিটা সবার কাছে পরিষ্কার নয়, স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করতে দ্বিধা…কেন? কেন নতুন বানানটাই ঠিক? পুরোনো বানানে ভুল কী ছিল।
একই ভাবে যুক্ত অক্ষরে পরিবর্তন…. বাঙালি হৃদয়ে বানান ভীতি দূর করে দিয়েছে। কাউকে বললেই সে বলে ওঠে….’ওরে বাংলায় বানান ভুল হয় না। ওটা আগে হতো। এখন যা লিখব সেটাই ঠিক।’….একেবারে নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না, এমন উক্তি গুলোকে।

এভাবেই একেক জায়গায় একেক ধরনের বানান লক্ষ করা যাচ্ছে। ‘বাংলা একাডেমি’র বানান অভিধান থাকলেও কোনো সংস্কার নেই। যে কারণ কোনটি শুদ্ধ এবং কোনটি অশুদ্ধ বানান বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে বাঙালি মনে। এ ক্ষেত্রে একটা দৃঢ় পদক্ষেপ দরকার।

বাংলা একাডেমি এবং বিশেষজ্ঞরাও একমত, বাংলা বানান নিয়ে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে সেটিকে ঠেকাতে উপযুক্ত শিক্ষা এবং সরকারি উদ্যোগের কোনও বিকল্প নেই।
তবে আমি মনে করি, বাংলা বানানের মূল সমস্যাগুলো হলো ই, ঈ, উ, ঊ-কার যুক্ত শব্দগুলোকে নিয়ে, ক্রিয়ার কিছু কথ্য রূপ নিয়ে, ‘ঙ’ এবং অনুস্বারের ‘ং’ ব্যবহার নিয়ে, শব্দের শেষে বিসর্গের ‘ঃ’ প্রয়োগ নিয়ে, দন্ত্যন মূর্ধণ্য নিয়ে, ও-কারের প্রয়োগ নিয়ে, বিদেশি শব্দের বাংলা রূপ নিয়ে।

images 7 10
BD news24

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘আধুনিক বাংলা অভিধানে’ ঈদের বিকল্প বানান ‘ইদ’ প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে এক সময় হয়তো ‘ইদ’ বানানটিই সবাই মেনে নেবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ঈদের ‘ঈ’-কে ‘ই’ করার কী দরকার ছিল? আবহমানকাল থেকেই ঈদকে ‘ঈ’ দিয়ে লেখা হচ্ছে। তাছাড়া ঈদ তো একটা উৎসবের নাম। নাম ও ট্রেডমার্ক কি ইচ্ছামতো বদলানো ঠিক?
একইভাবে ‘বাড়ি’, ‘পাখি’ লিখব, না ‘বাড়ী’, ‘পাখী’?
কোথায় ‘কি’ লিখব, কোথায় ‘কী’?
‘পুজো’, ‘ধুলো’ লিখব না ‘পূজো’, ‘ধূলো’?
‘হত’, ‘হতো’, না ‘হোত’ কী লিখব?
‘বাংলা’ লিখব, না ‘বাঙলা’?
‘বাঙালি’ লিখব, না ‘বাঙ্গালি’?
‘শশী’ র ‘ঈ’ কখন ‘ই’ হবে?
কখন ‘কালি’ হবে, কখন ‘কালী’….
মনে হয় এ বিভ্রান্তি সকলের মনে।

বাংলা
Amazone

প্রমিত বানানের নিয়মে উল্লেখ করে হয়েছে, ‘সকল অ-তৎসম শব্দে কেবল ‘ই’ এবং ‘উ’ এবং এদের চিহ্ন ব্যবহৃত হবে। যেমন : বাঙালি, ইংরেজি, উনিশ, আরবি। তবে কোনও কোনও স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার দেওয়া যেতে পারে।

যেমন : রাণী, পরী, গাভী। কিন্তু অভিধানে অন্য পাই আমরা।
প্রমিত বানানের নিয়মে উল্লেখ আছে, “তৎসম শব্দে ট, ঠ, বর্ণের পূর্বে ‘ষ’ হয়। যেমন- বৃষ্টি, দৃষ্টি, নিষ্ঠা, পৃষ্ঠা। কিন্তু বিদেশি শব্দে এই ক্ষেত্রে ‘স’ হবে। যেমন- স্টল, স্টাইল, স্টিমার, স্টুডিও, স্টেশন, স্টোর, স্ট্রিট। কিন্তু খ্রিষ্ট যেহেতু বাংলায় আত্তীকৃত শব্দ এবং এর উচ্চারণও হয় তৎসম কৃষ্টি, তুষ্ট ইত্যাদি শব্দের মতো, তাই ‘ষ্ট’ দিয়ে ‘খ্রিষ্ট’ শব্দটি লেখা হবে।” কিন্তু অভিধানে উল্লেখ আছে ‘খ্রিস্ট’। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে…. ‘পাঠ্যপুস্তকের বানানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকায় বানানটিকে অপরিবর্তনীয় রাখা হয়েছে।’

youtube


এবারে প্রশ্ন হলো, ‘পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’ ‘বাংলা একাডেমি’কে অনুসরণ করবে নাকি ‘বাংলা একাডেমি’ ‘পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’-কে অনুসরণ করবে? নিয়ম যদি ‘খ্রিষ্ট’ হয় তবে অভিধানে ‘খ্রিস্ট’ লেখার আদৌ দরকার আছে কি?

বাস্তবিক আমি তো লিখতে গিয়ে একবার গুগল দেখি তো আর একবার অভিধান। আমি চাই সঠিকটা লিখতে। কিন্তু তাও লিখতে পারি না… আপনি ‘লক্ষ্য’… বানান জানেন ‘য’ ফলা দিয়ে। কিন্তু বর্তমানে ‘য’ ফলা উঠে গিয়েছে।
তবে আমি কী করব ‘য’ ফলা দিয়ে লিখলে কেউ ভুল বলে, যাঁরা বানান নতুন বিধি দেখেছেন, আর না দিলে অন্যরা রে রে করে তেড়ে আসেন। বলেন তাঁরা, মানিনা এসব বানান বিধি… আমি মহা সঙ্কটে। হয়তো আপনিও…

কারণ যাই হোক না কেন, বর্তমান সমাজে বাংলা বানান তথা বাংলা ভাষা অবহেলিত, এটা চরম সত্য। ভাবনার অবকাশ আছে মনে হয়।

NO COMMENTS