মেয়ে,তারা কি গোয়েন্দা হতে পারে? সম্ভব? এই পেশায় মেয়েদের উপস্থিতি কতটা লক্ষণীয়? কি বলে সাহিত্য?
মেয়েদের অবস্থান পর্দার আড়ালেই চিরকাল ছিল। মেয়ে বলেই তাকে থাকতে হয়েছে নিজের প্রতিভাকে অবদমিত করে। সম্ভব হয়নি স্বাধীনতার পরেও মেয়েদের স্বাধীনভাবে বাঁচা। স্বদেশ হোক বা বিদেশ মেয়েদের জন্য চিত্রটা সব জায়গাতেই এক। বাল্যবিবাহ, পর্দাপ্রথা, অন্দরমহল, শিক্ষাহীনতা ও পেশাভুক্ত না হওয়া জীবন কাটাতে হত মেয়েদের সর্বত্রই। একবিংশ শতাব্দীর সময়ে এসেও মেয়েরা অবাঞ্ছিত, অবহেলিত, অবদমিত থেকে গেছে কোথাও কোথাও।

আজকে মেয়েরা সব অবগুণ্ঠন সরিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছে। আজ নারী পেশার সর্বস্তরেই বিচরণ করে স্বাধীনভাবে। যে পেশাই হোক না কেন – সাহিত্য রচনা, চাকুরীজীবী, ব্যবসা, ড্রাইভার, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, পুলিশ, বিমানকর্মী, সৈন্য কিম্বা গোয়েন্দা। নারী আজ প্রেয়সী ও পেশায় পারদর্শিনী, দুই-ই বটে।
শিক্ষায়, স্বীকৃতিতে উন্নীত হয়ে মেয়েরা যখন বাইরের জগতে পা রাখল তখন আরেক নতুন চ্যালেঞ্জ এলো তাদের সামনে। লিঙ্গ বৈষম্য এনে দিল মেয়েদের জীবনে পেশাগত হীনমন্যতা। উন্নতি হলে করুণার ফলে এসেছে সেই উন্নতি আর বিফল হলে অযোগ্য- তাই হয়নি। খুব সহজেই এই তকমাগুলো এঁটে দেওয়া হয় মেয়েদের কর্মজীবনে।
এই তকমাগুলো আরও অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে যখন মেয়েরা শারীরিক শ্রম ও বুদ্ধির কোনও কাজে নিযুক্ত হয়। সেনাবাহিনী? পুলিশ? গনিতজ্ঞ? গোয়েন্দা? এও কি মেয়েদের কাজ নাকি? এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি এমন মেয়ে খুব কম আছে। সে প্রশ্ন বাইরে থেকে আসুক বা তার নিজের বাড়িতে।
এই সব কিছুর প্রভাবই প্রতিফলিত হয় সাহিত্যে। প্রথম মহিলা হিসেবে আত্মজীবনী রচনা করেন রাসসুন্দরী দেবী – “আমার জীবন”। অনিয়েজ গোনয্যে বোয়াজিউ থেকে মাদার টেরেসার সুদীর্ঘ কর্মজীবনের সাক্ষী হয়ে আছে বহু জীবনী (বায়োগ্রাফি) ও ডকুমেন্টারি। মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর কাজও সাহিত্যের আঙিনা ছুঁয়ে গেছে বিভিন্ন লেখকের কলমে। সমাজের প্রেক্ষাপট অনুপস্থিত নয় সাহিত্যে মহিলা গোয়েন্দা চরিত্র তুলে ধরতেও।
মোড ওয়েস্ট (Maud West) ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক বাস্তবিক একজন মহিলা গোয়েন্দা, যিনি ১৯০৫ সালের মতো সময়েই নিজস্ব অনুসন্ধান সংস্থা বা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলে ছিলেন এবং বিভিন্ন দেশ ঘুরে তিনি তাঁর গোয়েন্দাগিরির ছাপ রেখে গেছেন। সাহিত্যের অঙ্গনে এই রকম ব্যক্তিত্ব চিত্রিত হয়েছে আগাথা ক্রিস্টির “মিস মার্পেল” আর সুচিত্রা ভট্টাচার্যের “মিতিনমাসি” চরিত্র দুটির মধ্যে দিয়ে।

বাস্তব জীবনের ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই সাহিত্য সৃষ্টি হয়। তাই বাস্তবে মহিলা গোয়েন্দারা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথেই গল্পে, বইয়ে গোয়েন্দা হিসেবে মেয়েরাও জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। বইয়ের পাতাতেই শুধু তারা আবদ্ধ থাকেনি, ফুটে উঠেছে ছবিতে, চলচ্চিত্রের পর্দাতেও।
সিরিজ হিসেবে মিস মার্পেল অভিনীত হয়েছে ছোট ও বড়ো দুই পর্দাতেই। মিস মার্পেল রেডিও অনুষ্ঠানেও জনপ্রিয় হয়। জাপানিজ মাংগা এবং অ্যানিমেতেও মিস মার্পেলের ৩৯ টি এপিসোড প্রকাশিত হয়।
মিতিনমাসি ২০১৯ সালে বড়ো পর্দায় আসে এবং নির্দেশক আরও একটি ছবির নির্মাণ করছেন বর্তমানে যা আগামী বছর মুক্তি পেতে চলেছে। মিতিনমাসির মতো ছোট পর্দায় একটি বাংলা সিরিয়াল “গোয়েন্দা গিন্নি” দর্শকদের ভীষণ পছন্দের হয়ে ওঠে যার কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল একজন সংসারী মহিলা, পেশায় গোয়েন্দা।

অ্যালিস ক্লেমেন্ট (Alice Clement) ১৯০৯ সালে শিকাগো পুলিশের বিভাগে নিযুক্ত হয়ে ১৯১৩ সালে গোয়েন্দা হিসেবে কাজ শুরু করেন। সমাজের সব প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে সাংসারিক দায়-দায়িত্ব সামলে বুদ্ধির বলে মেয়েরাও যে গোয়েন্দা হয়ে উঠতে পারে তা আরও একবার প্রমাণিত হয় ক্লেমেন্টের উদাহরণে।
তাঁর সমস্ত কেসের মধ্যে “দ্য ডালকাইমার” (The Dulcimer) সবথেকে বিখ্যাত। যেখানে পুরুষ গোয়েন্দারা হার মেনে মেয়েটির দেহ ব্যবসাকেই তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে ধরে নেয় তখন ক্লেমেন্ট আসল কারণ খুঁজে বের করে মৃত্যু রহস্যের সমাধান করেন। আন্তর্জাতিক মাধ্যমে মুক্তি পাওয়া এই ইউটিউব ভিডিও অনুসারে সর্বস্তরে অ্যালিস ক্লেমেন্ট কে “লেডি শার্লক হোমস” বলে আখ্যা দেওয়া হয়।

রজনী পণ্ডিত (Rajani Pandit) হলেন ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা গোয়েন্দা। ১৯৯১ সালে তিনি রজনী ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো শুরু করলে বিজ্ঞাপনের জন্য খবরের কাগজের দপ্তর তাঁকে নাকোচ করে দেয়। এমন নানা বাঁধা পেরিয়ে সেই রজনী পণ্ডিতই ২৯ বছরে ৭৫ হাজার কেস সমাধান করেছেন। তাঁর সংস্থায় পরবর্তীকালে ২০ জন কর্মী নিযুক্ত হয়,দেশেই শুধু নয় বিদেশের অনেক কেসও সমাধান করেছেন রজনী।
কেসের সমাধানের জন্য বহুবিধ ছদ্মবেশ তাঁকে এযাবৎ নিতে হয়েছে, যেমন- বোবা, গর্ভবতী, অন্ধ, কাজের মহিলা ইত্যাদি। ১৯৯৮ সালে Times of India পত্রিকার একটি সাক্ষাৎকারে রজনী বলেন,
"I've played a maidservant, a blind woman, pregnant woman, dumb woman—fear is not a word in my dictionary"

প্রকৃতি মহিলাদের বিশেষত্বে কোনও খামতি রাখেনি, তাই কাজের জন্য কোনও লিঙ্গ বৈষম্য বাঁধা হতে পারেনা, একথা যেদিন সকলে বিশ্বাস করতে পারবো সেদিন আর এই প্রশ্নের কোনও জায়গা থকবে না যে মহিলারা গোয়েন্দা হতে পারে কি পারে না! শুভ মহরৎ, ববি জাসুস, ডিটেকটিভ নানি এমন ছবি আর হাতে গোণা একটা কি দুটো নয়, তৈরি হবে অসংখ্য। মেয়ে? গোয়েন্দা? উত্তরে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলা যাবে – হ্যাঁ, হতে পারে। হয়। হবেও।