যদি জিজ্ঞেস করা হয় পছন্দের মাছের নাম, অধিকাংশ বাঙালিই বলবেন ইলিশ! শুধু বাঙালি বললে আবার ভুল বলা হবে, কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনেক মানুষের পছন্দের মাছের তালিকায় শুরুতেই ইলিশ মাছ থাকে । মাছের নামটা হয়তো সেখানে ইলিশ নয়, তবু এই মাছ চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়। সব দেশেই আসলে এই মাছের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে । শুধুই কি অপূর্ব স্বাদ-গন্ধ ?

IMG 20210202 WA0023

না, ইলিশ মাছের জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে আরো বিবিধ কারণ! আসুন জেনে নিই আমাদের সকলের প্রিয় ইলিশ মাছ সম্পর্কে দু-চার কথা ।


ইলিশ সামুদ্রিক মাছ কিন্তু প্রজননের জন্য অদ্ভুত ভাবে মিষ্টি জলে অর্থাৎ নদীতে আসতে হয়। শুনলে অবাক লাগবে পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা অঞ্চলের জলের কেমিকেল প্যারামিটার এদের ডিম পাড়ার উপযুক্ত।তাই এখানেই ওরা সুদূর সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে আসে।

ইলিশের ব্যতিক্রমী জীবনচক্রের সঙ্গেও তুলনা চলে না আর কোনো মাছের। নোনা জলের এই মাছ ডিম পাড়তে নদীর উজান বেয়ে উঠে যায় মিষ্টি জলে। ডিম ছাড়া হয়ে গেলে ফের ভাটিতে ভাসে সাগরের পথে। ডিম ফুটে মাছ হওয়া চারাও ছোটে সাগর পানে। জীবনচক্র পূর্ণ কতে ডিম ছাড়ার সময় হলে ফের উঠে আসে নদীর অগভীর জলেতে।

IMG 20210202 WA0027


ঘণ্টায় ৭১ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে দক্ষ সাঁতারু ইলিশ। ডিম ছাড়ার জন্য এরা ১২শ’ কিলোমিটার সাঁতরাতেও রাজি। তবে গভীরতা ৪০ ফুট হলে সাঁতরাতে সুবিধা হয় ওদের। উজান বাওয়ার সময় কিছু খায় না এরা। ডিম ছাড়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে, একেকটি মাছ ডিম ছাড়তে পারে ২০ লক্ষ পর্যন্ত। সারা বছর ডিম দিলেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেই সবচেয়ে বেশী ডিম ছাড়ে ইলিশ।

ইলিশ মাছ ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। বড় ইলিশের ওজন হয় আড়াই কেজি পর্যন্ত। পুরুষের চেয়ে আকারে বড় হয় স্ত্রী ইলিশ। বাড়েও দ্রুত। মাত্র ১ থেকে ২ বছরের মধ্যেই প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়ে যায় ইলিশ মাছ।

সমুদ্রের নোনা জল থেকে ইলিশ যতো নদীর উজানে যেতে থাকে ততো তার শরীর থেকে আয়োডিন, লবণ ঝরতে থাকে। দীর্ঘ পথ চলে যত সে মিষ্টি জলে থাকে ততোই কমে তার দেহের চর্বি, লবণ, খনিজ। বাড়ে স্বাদ। তাই সমুদ্রের ইলিশের স্বাদ কম। আর স্বাদ বেশী গঙ্গা পদ্মার ইলিশের।

ইলিশ যখন ডিম পাড়ার জন্য আসে তখন নয় জেলেরা
ডিম সমেত মাছ ধরে নেয় অথবা ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার পরে বড় হতে না দিয়েই “খোকা ইলিশ” ধরে নেওয়া হয় । এই কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়ত জানবেই না ইলিশ মাছের নাম ।

মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলছেন, এখন গঙ্গা নদীতে পলি জমার ফলে মোহনায় ডিম পাড়তে আসা অনেক ইলিশ সাগরে ফিরে যেতে পারে না। তাদের ঠিকানা হয়ে যায় এই গঙ্গা। এই সব আবাসিক ইলিশকে সাধারণত দেখা যায় গঙ্গার মোহনা থেকে অন্তত ৩৫০ কিলোমিটার উত্তরে ফারাক্কার কাছে। তাই মৎস্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব ‘আবাসিক’ ইলিশের ২০ শতাংশকেও বাঁচিয়ে রাখা গেলে এবং পরবর্তী সময়ে এরা প্রজননে সক্ষম হলে এই রাজ্যে আর ইলিশের অভাব হবে না।

রাজ্য সরকার পশ্চিমবঙ্গের ইলিশ রক্ষার জন্য ইলিশের ‘অভয়ারণ্য’ গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে।এই রাজ্যের গঙ্গার ইলিশ রক্ষার জন্য রাজ্যের নদীতে ডিম পাড়তে আসা তিনটি এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। সমুদ্র থেকে এই তিনটি এলাকায় ইলিশ এসে ডিম পাড়ে। এই এলাকা তিনটি হলো রায় চক-গোদাখালী, ত্রিবেণি-বলা গড় এবং লালবাগ-ফারাক্কা এলাকার গঙ্গা নদী। এই তিনটি এলাকাকে রাজ্য সরকার ‘ইলিশের অভয়ারণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে এখানের ইলিশ রক্ষা এবং ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইলিশ বড় না হওয়া পর্যন্ত জারি থাকবে ছোট ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা। শুধু তা-ই নয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারও বিশেষ নজর চালাবে এই চিহ্নিত অভয়ারণ্যের দিকে, যাতে করে মৎস্যজীবীরা ইলিশ বড় না হওয়া পর্যন্ত জালে আটকাতে না পারে। শুধু তা-ই নয়, এই অভয়ারণ্যে গড়া হবে ইলিশ গবেষণা কেন্দ্রও।

জিরো স্যালিনিটিতে অর্থাৎ নোনা ভাব থাকবে না এমন জলে ইলিশ চাষ করার চেষ্টা চলছে পৃথিবী জুড়ে।রাজ্য সরকার পুকুরে ইলিশ চাষের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মৎস্যবিজ্ঞানীরা পুকুরে ইলিশ চাষের জন্য দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবারের ‘দা হিলসা কনজারভেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’ নরওয়ের সংস্থা নোফিমার সঙ্গে যৌথভাবে প্রকল্প নিয়েছে। নরওয়ের এই সংস্থার ৪৫ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে বিভিন্ন মৎস্য চাষের। রাজ্য সরকার এই প্রকল্পের জন্য দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায় চকের কাছে ফলতা ও পূর্ব কলকাতার জলাভূমির ছয়টি জায়গা চিহ্নিত করেছে। যদিও এখন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ভারত ও বাংলাদেশের ইলিশ সংরক্ষণের জন্য বিধিবদ্ধভাবে কাজ করছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রস্তাবিত ইলিশের এই অভয়ারণ্যের জন্যও কাজ করবে আইইউসিএন।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে ১৫ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সমুদ্র ও এর সন্নিহিত অঞ্চলের ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ ছাড়া ইলিশ রক্ষা করতে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করে। তা সত্ত্বেও দেখা যায়, মৎস্যজীবীরা সেই নির্দেশ অমান্য করে ‘খোকা ইলিশ’ ধরছে।

IMG 20210202 WA0026


স্বাস্হ্য রক্ষায় ইলিশ

স্বাদ ও গন্ধের জন্য ইলিশ অনন্য। প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশে রয়েছে প্রায় ২১ দশমিক ৮ গ্রাম প্রোটিন, উচ্চ পরিমাণ ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড, নায়সিন, ট্রিপ্টোফ্যান, ভিটামিন, বি ১২, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনে সিয়ামসহ অন্যান্য ভিটামিন ও মিনারেলস।

হার্টের সুস্থতা বজায় রাখতে চাইলে ইলিশ খাওয়া যেতেই পারে। এতে আছে প্রচুর ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। যা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। সামুদ্রিক মাছ হিসেবে ইলিশে সম্পৃক্ত চর্বি কম থাকে। ফলে সুস্থ থাকে হার্ট।

রক্তনালির স্বাস্থ্য রক্ষায় ভালো রাখতে ইলিশ মাছ বেশ উপকারী। এতে ইপিএ ও ডিএইচএ নামক ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। আর সে কারণেই ইলিশ মাছ খেলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়।

ইলিশে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাট ত্বক ভালো রাখতে সাহায্য করে। এতে থাকা প্রোটিন কোলাজেনের অন্যতম উপাদান। এই কোলাজেন ত্বক নমনীয় রাখতে সাহায্য করে, পড়তে দেয় না বয়সের ছাপ।

চোখ ভালো রাখতে সাহায্য করে ইলিশ। এতে থাকা ভিটামিন এ এবং ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড চোখের সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। দৃষ্টিশক্তি কমে আসার সমস্যা কাটাতে সাহায্য করতে পারে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড।

আয়োডিন, সেলেনিয়াম, জিঙ্ক, পটাশিয়ামে ভরপর ইলিশ। থায়রয়েড গ্ল্যান্ড সুস্থ রাখে আয়োডিন, সেলেনিয়াম উৎসেচক ক্ষরণে সাহায্য করে যা ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করতে পারে।ইলিশে থাকা খনিজ, বিশেষ করে ফসফরাস দাঁত এবং ক্যালসিয়াম হাড়ের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয়। সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও লৌহ স্বাভাবিক শরীর বৃদ্ধি এবং মানসিক বিকাশের জন্য জরুরি উপাদান।

ইলিশে আছে ভিটামিন এ, ডি এবং ই। আর ভিটামিন ডি খুব কম খাবারেই মেলে। ভিটামিন এ রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে এবং ডি শিশুদের রিকেট রোগ থেকে রক্ষা করে।

যে ভাষায় যে নাম


মিয়ানমারে বার্মিজ ভাষায় বলা হয় না-থা-লোক, না-থালাংক।

ভারতে বাংলা ভাষাভাষীরা বলেন ইলিশ এবং ছোট ইলিশকে বলেন খোকা ইলিশ।

অসমিয়া ভাষায় বলা হয় ‘ইলিহি’।

তেলেগু ভাষায় বলা হয় পালাসা, পালাসাহ, পালিয়া, পোলাসা

গুজরাটি ভাষায় বলা হয় চাকশি, চাকসি, চাসকি, পাল্লা।

হিন্দিতে বলা হয় হিলসা, পালা

কানাড়া ভাষায় বলা হয় মুল্লাসু, পালাসা, পালিয়া, পোলাসা

মালয়ালাম ভাষায় বলা হয় পালিয়াহ, পালুভা, ভালাভা।

মারাঠি ভাষায় বলা হয় পালা, পাল্লা, পালভা

উড়িয়া ভাষায় বলা হয় ইলিশ, ইলিশা, জোড়ি

উল্লাম, ভেনগান্নাই, সেভা বলা হয় তামিল ভাষায়

শ্রীলঙ্কায় তামিল ভাষায় ইলিশকে বলা হয় সেভ্ভা, উল্লাম।

পাকিস্তানের পাঞ্জাবি ভাষায় ইলিশকে পাল্লা এবং উর্দুতে পালো ও পুল্লা বলা হয়।

ভিয়েতনামে ক্যা কে বলা হয় ইলিশকে

যুক্তরাষ্ট্রে বৈশ্বিক নাম হিলসা বলেই ডাকা হয়।

যুক্তরাজ্যে বলা হয় হিলসা হেরিং

পোলান্ডে পলিশ ভাষায় বলা হয় হিলজা ইনডিজস্কা

পর্তুগালে পর্তুগিজ ভাষায় ইলিশকে বলা হয় পালা।

চেক ভাষায় ইলিশের নাম প্লাককা ইলিশা, স্লেড পালাসাহ।

IMG 20210202 WA0025


ডেনমার্কে ইলিশের নাম হিলসা-স্টামস্লিড।

স্প্যানিশ ভাষায় ইলিশের নাম সাবালো হিলসা

সুইডিশ ভাষায় বলা হয় হিনডিস্ক স্টাকসিল

এস্তোনিয়ান ভাষায় ইলিশকে বলা হয় ইন্ডিয়া সালিলুসা

রাশিয়ায় রুশ ভাষায় এই ইলিশকেই ডাকা হয় তেনুয়ালোসা নামে।

ইরাকে আরবি ভাষায় ইলিশের নাম শোর

ইরানে ফারসি ভাষায় ইলিশকে কয়েকটি নামে ডাকা হয়। যেমন: বার্ক, মাহি খোর কুচিকু, সবোর, সবুর, জাবুর, জমুর।

ওমানে ইলিশকে ডাকা হয় চাকোরি নামে

ম্যান্ডারিয়ান চায়নিজ ভাষায় চীনে ইলিশের নাম ইচাচা।