আপনার পছন্দের মিষ্টির ইতিহাস জানেন? জানেন বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টির কি নাম?
মিষ্টি আর বাঙালি এক অবিচ্ছেদ্য সুসম্পর্ক সেই প্রাচীন কাল থেকে বিরাজমান। খাওয়ার শেষ পাতে অথবা কোন শুভ অনুষ্ঠানে মিষ্টি ছাড়া বাঙালির কিছুতেই চলে না। বলতে গেলে মিষ্টি বাঙালির জন্য সুখবরের বার্তা বয়ে আনে। তবে শুধু বাঙালি নয় মিষ্টির স্বাদে আকুল হয়েছে বহু বিদেশিও। এ্যন্টনি ফিরিঙ্গি থেকে লর্ড কার্জন ওদিকে বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ সবাই বারবার মিষ্টির ফাঁদে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন। মিষ্টির প্রশংসায় লেখা হয়েছে একাধিক গদ্য, নামের তাৎপর্যে তর্ক বিতর্কের ঝড়ও উঠেছে অনেক কিন্তু শেষমেশ সবাই বিবাদের কড়াপাক ছেড়ে গা ভাসিয়েছেন ডুব সাগরের রসে। তাই আজ বাঙালির প্রিয় কিছু মিষ্টির সৃষ্টির ইতিহাস জানা যাক।
আপনি কি জানেন ভারতের প্রাচীন মিষ্টির নাম?

মতিচুরের লাড্ডু ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টি। বয়স প্রায় দুহাজার বছর। যার উৎপত্তিস্থল বঙ্গ। লাড্ডু বঙ্গের মিষ্টি হলেও লাড্ডু শব্দটি কিন্তু সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ লাতিকা অর্থাৎ ছোটো বল। অন্যদিকে মতি শব্দের অর্থ মুক্তা আর চুর অর্থ ভাঙা বা চূর্ণ বিচূর্ণ করা, অর্থাৎ মতিচুর মানে চূর্ণবিচূর্ণ মুক্তার মিষ্টি। আন্দাজ করা হয় আনুমানিক দুহাজার বছরেরও আগে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে বিহারে এই মিষ্টির উৎপত্তি হয়।
নীহাররঞ্জন রায় ও বাঙালির আদি মিষ্টি
লাড্ডুর পরও অনেক বছরই বাঙালির কাছে তার মিষ্টির প্রধান উপাদান অর্থাৎ ছানার কোনো সন্ধান ছিল না সেই সময় ছানার পরিবর্তে মিষ্টির প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহার হতো বেসন, চিনি, নারকেল ও মুগের ডাল দিনে এছাড়াও শুধু চিনি দিয়েও তৈরি এক ধরণের চাকতিকেও সন্দেশ বলা হতো। সেইজন্যই নীহাররঞ্জন রায় তার বাংলার মিষ্টির ইতিহাস বইটিতে যেসব মিষ্টির সন্ধান দিয়েছেন তাতে কোনো ছানার মিষ্টির নাম নাই। দুধ থেকে তৈরি মিষ্টি বলতে পায়েস, দই ও ক্ষীরের কথা। তার বইটিতে তিনি বলেছেন, “কোজাগর পূর্ণিমা রাত্রে আত্মীয়-বান্ধবদের চিপিটক বা চিঁড়া এবং নারিকেলের প্রস্তুত নানা প্রকারের সন্দেশ পরিতৃপ্ত করিতে হইত এবং সমস্ত রাত বিনিদ্র কাটিত পাশা খেলায়।”
ছানার সাথে বাঙালির আলাপ

বাংলার আধুনিক মিষ্টি সন্দেশ রসগোল্লার বয়স বড়জোর দু আড়াইশ বছর। আধুনিক মিষ্টির প্রধান উপাদান অর্থাৎ ছানার সাথে বাঙালির প্রথম আলাপ করায় পর্তুগিজরা। ভাস্কো দা গামা কালিকট বন্দরে এসেছিলেন ১৪৯৮ সালে। তাদের কাছ থেকে বাঙালি ময়রারা ছানা ও পনির তৈরির কৌশল শেখে। তবে ছানার মিষ্টির ভারতে বিস্তারে আরো সময় লেগে যায়। প্রথম দিকে বিভিন্ন ধর্মীয় কারণেই ছানার মিষ্টি থেকে বিরত থাকলেও স্বাদ আর আভিজাত্যে বাঙালিকে নিজে থেকেই ছানার মিষ্টিকে আপন করে নেয়।
সাহিত্যেও মিস্টির প্রভাব কোনোকালেই বাদ পড়েনি। তাই বাঙালার মিষ্টিকে প্রধানত দু ভাগে ভাগ করেছিলেন স্বয়ং ‘সুকুমার রায়’ প্রথম হলো একক বা মৌলিক মিষ্টি যার মধ্যে গুড় বা চিনির সাথে আর কিছু মিশ্রিত থাকে না। যেমন – গুড় বা চিনির নাড়ু ও চাকতি, পাটালি, বাতাসা, খাজা, ছাঁচ ইত্যাদি। আর দ্বিতীয় হলো যৌগিক মিষ্টি, যদিও একেও দু ভাগে ভাগ করা যায়। এক গুড় বা চিনির সাথে দুগ্ধজাত কোন উপকরণ ছাড়া অন্য দ্রব্য দ্বারা তৈরি মিষ্টি। যেমন – নারকেল, তিল এসবের নাড়ু, চিঁড়া, মুড়ি, খৈ-এর মোয়া ইত্যাদি। আর দুগ্ধজাত দ্রব্যদ্বারা তৈরি নানান ধরণের মিষ্টি, যা মিষ্টিপ্রিয় বাঙালির সুপরিচিত। যেমন – রসগোল্লা, সন্দেশ ইত্যাদি।
কিছু ঐতিহ্যবাহী ছানার মিষ্টি ও তাদের ইতিহাস
১) রসগোল্লা ও কলকাতার কলম্বাস

রসগোল্লা, নামটার মধ্যেই যেন একটা আলাদা তৃপ্তি আছে। ভারতের এমন কোনো রাজ্য নেই যেখানে রসগোল্লা পাওয়া যাবে না। এই রসালো মিষ্টি নিয়ে দুই রাজ্যের এক শুষ্ক মনভাব থাকলেও আজ তা উধাও। আইনি সম্মতিতে রসগোল্লা জনক এখন বাংলা। যদিও ঐতিহাসিকদের মতে মধ্যযুগে কোনো এক সময় সালেপুরেই নাকি রসগোল্লার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। তবে বিভিন্ন আইনি পদক্ষেপে চিৎপুরে ১৮৬৪ সালে বিখ্যাত ময়রা নবীন চন্দ্র দাস যে প্রথম রসগোল্লা আবিষ্কার করে আপাতত সেই সম্মতিতে রসগোল্লা এখন বাংলার পকেটে।
‘রসগোল্লা’র ইতিহাসে নবীন চন্দ্রের অবদান বাঙালি সিনেমাও বানিয়ে নিয়েছে। এই রসগোল্লা আবিষ্কারে অনেক ঝক্কি পোহাতে হলেও প্রথমে বাঙালী নবীন দাসের রসগোল্লাকে ভালো মতো নেয়নি। বেশি সময় ধরে ফোটানো হতো বলে দেবতারা নাকি তা পছন্দ করবেন না এমনটাই মনে করতেন তাঁরা। কথিত আছে একদিন ভগবান দাস বগলা নামে জনৈক ব্যবসায়ী গ্রীষ্মের দুপুরে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাগবাজারের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। ব্যবসায়ীর পুত্র পথে প্রচণ্ড গরমে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লে, এমন সময় তিনি নবীন দাসের দোকান দেখতে পান। দেখেই ছেলেকে নিয়ে দোকানের সামনে এসে থামলেন। বগলার ছেলেটি তখন এতই তৃষ্ণার্ত যে চলার শক্তিটুকুও তার ছিল না। বাধ্য হয়ে বগলা দোকানদারের কাছে এক গ্লাস জল চাইলে দোকানদার ছেলেটিকে জলের সঙ্গে একখানা রসগোল্লাও খেতে দেন।
আর সেই মিষ্টির স্বাদ পেয়ে ভগবান দাস বগলার ছেলে দারুণ তৃপ্ত হলো, তার চোখে মুখে ফুটে উঠলো আনন্দের ঝিলিক। ছেলের খুশি দেখে বাবাও খেয়ে ফেললেন একখানা রসগোল্লা। তারপর আরো একটা। রসগোল্লার অপূর্ব স্বাদে মুগ্ধ হয়ে পিতা-পুত্র মিলে পেটভরে খেলেন মিষ্টি। আর সেই থেকেই রসগোল্লা হয়ে উঠল বাঙালির কাছে জনপ্রিয়।
১৯ শতকে নবীন চন্দ্র দাসকে বউবাজারের কলম্বাস নামে ডাকা হতো।
২) লেডি ক্যানিং থেকে লেডি কিনি

মিষ্টি দাঁড়িপাল্লায় বরাবর দক্ষিণ কলকাতার চেয়ে বেশি ঝুঁকে উত্তর কলকাতা আর এই পাল্লায় এক বিশাল জায়গা অধিগ্রহণ করে আছেন ভীম চন্দ্র নাগ। কুক অ্যান্ড কেলভি-র মালিক থেকে আশুতোষ রায় বা জগদীশচন্দ্র বসু সবাই তখন ভীম নাগের মোহে। ঠিক এই সময়ই লেডি ক্যানিং তাঁর জন্মদিনে ভীম নাগকে আমন্ত্রণ জানান এমন কিছু মিষ্টি তৈরি করার আবদার করেন, যার স্বাদ আগে কেউ কোনওদিন পায়নি। ভীম নাগ তাতেই রাজি হয়ে যে বিশেষ ধরনের মিষ্টিটি তৈরি করেছিলেন, তার স্বাদ লেডি ক্যানিংকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছিল। এরপর আত্মতৃপ্ত লাটসাহেব ভীম নাগকে তুলে দেন দু-হাত ভরা উপহার। আর তারপর থেকেই এই বিশেষ ধরনের মিষ্টির নামকরণ লেডি ক্যানিংয়ের নামানুসারে হয় ‘লেডিকেনি’ হয়ে ওঠে।
৩) সরপুরিয়া ও সরভাজা

সরপুরিয়া ও সরভাজার সৃষ্টির ইতিহাস নিয়ে একপ্রকার বিতর্কের আবহ আছে মিষ্টির ইতিহাসে। কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃততে উল্লেখ আছে, অদ্বৈত আচার্য নিজেই চৈতন্যদেবকে সরপুরিয়া পাঠাতেন। কিন্ত আধুনিক সভ্যতা তার অন্য দিক তুলে ধরছেন, সরপুরিয়া সৃষ্টি কর্তা অধর চন্দ্র দাসের পিতা সূর্য কুমার দাস। শোনা যায় দরজা বন্ধ করে ছানা, ক্ষীর ও সর দিয়ে তৈরি করতেন সরপুরিয়া ও তাঁর অপর আবিষ্কার সরভাজা। যুবক অধর চন্দ্র দাস তার বাবার কাছ থেকেই সেই কৌশল শিখে প্রথম মিষ্টির দোকান খোলেন নাম দেয় অধর চন্দ্র দাস।
৪) মিষ্টি দই ও গাঙ্গুরাম

ভোজনরসিক বাঙালি রসগোল্লা, সন্দেশের পাশাপাশি যে জিনিসটিকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্রয় দেয় সেটি মিষ্টি দই যার আবিস্কাকর্তা চৌরাশিয়ার গাঙ্গুরাম। কথিত আছে ভিখারির ছদ্মবেশে এসে স্বয়ং ‘নারায়ণ’ নাকি একদিন গাঙ্গুরামের হাত থেকে এক ভাঁড় দই খান। এরপর তিনি পরম তৃপ্ত হয়ে তাঁকে আশীর্বাদও করেন।
৫) লবঙ্গ লতিকা

প্রায় ১৭০ বছর পুরোনো মিষ্টির দোকান ফেলু মোদকের বিখ্যাত মিষ্টি লবঙ্গ লতিকা। লবঙ্গ লতিকা বাঙালির মিষ্টি হলেও এটি আত্মস্থ করা হয়েছে ব্রিটিশদের কাছ থেকে। তবে ব্রিটিশরা এর মধ্যে পুর হিসেবে পেস্ট্রির ব্যাবহার করলে ফেলু মোদক মিষ্টির ভাঁজে নারকেলের পুর দিয়েই প্রথম এই মিষ্টির সাথে বাঙালির পরিচয় ঘটান। তবে ধীরে ধীরে সেই পুরে জায়গা বদল করে নিয়েছে ক্ষীর, চকলেট প্রভৃতি, সাথে ফ্লেভারের বদল এনেছেন তারা।
আরো জানুন…
https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/bengal-s-portuguese-sweets



























