স্বামী বিবেকানন্দ, যে নামটা ভারত তথা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে এক উজ্জ্বলময় হরফে লিখিত। একাধারে তিনি ছিলেন হিন্দু সন্ন্যাসী ও পাশ্চাত্যে বেদান্তের প্রচারক এবং একজন দার্শনিক,  শিক্ষক এবং মানব ও স্বদেশ প্রেমের অন্যতম পূজারী  “যুব নায়ক”।

Picture1

স্বামীজির মৃত্যুর পর বহু বছর কেটে গিয়েছে। বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে মনে প্রশ্ন জাগে, তিনি যে সংকল্প নিয়েছিলেন স্বপ্নের ভারতবর্ষ গড়ার, তা কি আদৌও সেদিকে অগ্রসর হয়েছে?

 বহু ক্ষেত্রে সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। অন্ত্যজ শ্রেণিকে এখনও তো অনেক জায়গায় ছোটো হয়ে বসবাস করতে হয়, পদে পদে অপমানিত হতে হয়, সমান অধিকার পায়না তারা এখনও। স্বামীজি ছিলেন জাতপাত এর ঘোর বিরোধী। তিনি সারা ভারত পরিব্রাজন করে,ভারতের বিভিন্ন স্থানে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা কুসংস্কার, জাতপাত ,শোষণ, বঞ্চনা কে এবং নিজে চাক্ষুষ দর্শন করে এর বিরুদ্ধে নিজের মত প্রকাশ করেন।জাতপাতের বিরুদ্ধে তাঁর বহুপ্রচলিত ভাষণ

 ‘হে ভারত, ভুলিও না- নীচজাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই। হে বীর সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল- আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। বল- মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।

ধর্মীয় সন্ত্রাস, দাঙ্গা,হানাহানি দিনের পর দিন চলেই আসছে। যুদ্ধ, রক্তপাত ঘটেই চলেছে।

কিন্তু স্বামীজি বলেছিলেন শান্তির কথা, মানুষ কে ভালোবাসার কথা,

“জীবে প্রেম করে যেই জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর”

স্বামী বিবেকানন্দ সর্বদাই ধর্মীয় ঐক্য ও সৌভ্রাতৃত্বের পন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন।

এখনও বহু মানুষ আশ্রয়হারা,অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন পথের ধারে। রাজনীতি, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি —সব স্তরে দেখা দিয়েছে এক ধরনের অবক্ষয়ের চিত্র।

কিন্তু তার উপদেশ ,তার বাণী তো আমাদের শিখিয়েছিল  জীব ও মানব প্রেমের পবিত্র মন্ত্র। তিনি বলেছিলেন

 ‘মাতৃদেব ভব , পিতৃদেব ভব ‘ ; আমি বলি, ‘ দরিদ্রদেব ভব, মূর্খ দেব ভব ‘ ।

 দরিদ্র , মূর্খ , অজ্ঞাণী , কাতর – ইহারাই তোমার দেবতা হউক , ইহাদের সেবাই পরমধর্ম জানিবে । তিনি সর্বদা দরিদ্র ও অনাহারের পাশে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে দাড়িয়েও কেনো আমরা অনাহার দরিদ্রদের পাশে দাঁড়াতে পারছিনা? সমাজের প্রতিটি স্তরে যে ভাবে দুর্নীতি ছেয়ে গিয়েছে, তা কারও অজানা নয়। পাল্টা দিয়ে চলেছে ধর্ম-বিদ্বেষের রাজনীতি। স্বামী বিবেকানন্দ এই সমস্যা প্রসঙ্গে আগেই সতর্ক করেছিলেন—“ধর্মের সংহতি-স্থাপনই ভবিষ্যৎ ভারত গড়িবার প্রথম সোপান। সেই মূল ঐক্যের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া নিজেদের এবং জাতির কল্যাণের জন্য পরস্পরের সর্ববিধ মতভেদ ও অকিঞ্চিৎকর কলহ আমাদের বর্জন করিবার সময় আসিয়াছে। বহু দিকে বিকীর্ণ আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের সম্মিলন দ্বারাই ভারতে জাতীয় ঐক্যের প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।” বিবেকানন্দ কথিত এই ধর্মের সঙ্গে প্রচলিত সম্প্রদায়গত ধর্মের কোনও যোগ নেই। যোগ একমাত্র হৃদয়ে।

তিনি প্রচার করেছেন শিক্ষার। স্বামীজি মনে করতেন সমাজকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে গেলে সবার প্রথমে সমাজের প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। এবং তার ফলেই মানুষের সৎ শক্তি ও ইচ্ছা শক্তি সঠিকভাবে বিকাশ ঘটবে।১৮৯৪ সালের ২০ জুন আমেরিকা থেকে হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লেখা চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, “জনসাধারণকে শিক্ষিত করা এবং তাহাদিগকে উন্নত করাই জাতীয় জীবন-গঠনের পন্থা।” এই প্রসঙ্গেই স্বামী শুদ্ধানন্দকে লেখা ১৮৯৭ সালের একটি চিঠির কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে বিবেকানন্দ লিখেছেন, “জনসাধারণকে যদি আত্মনির্ভরশীল হতে শেখানো না যায়, তবে জগতের সমগ্র ঐশ্বর্য ভারতের একটি ক্ষুদ্র গ্রামের পক্ষেও পর্যাপ্ত সাহায্য হবে না।”

বর্তমানের এই মূল্যবোধের সংকটের যুগে আমাদের অতি অবশ্য প্রয়োজন সমাজ সংস্কারক স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারাকে গ্রহণ করার। যতদিন সমাজে এমন দুর্গতি থাকবে ততদিন স্বামীজীর শিক্ষা দর্শন প্রাসঙ্গিক হয়ে থেকে যাবে।