বিশ্ব রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ের অতি দক্ষিণপন্থার উত্থান প্রায় হাত ধরাধরি করে একই সময়ে শুরু হয়েছিল। ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার বছর দেড়েকের মধ্যে আমেরিকার শাসন ক্ষমতার শীর্ষে বসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর কিছুদিনের মধ্যেই ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি হন জাইর বোলসেনারো। দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পদে বসেন অতি দক্ষিণপন্থী বরিস জনসন। তাকে ‘ব্রিটেনের ট্রাম্প’ নামে চিহ্নিত করেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি। এছাড়াও ইউরোপের বেশ কিছু দেশে এই সময়ে সর্বোচ্চ পদে বসেছেন দক্ষিণপন্থীরা।

এ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে গোটা বিশ্বেই উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং অসহিষ্ণুতার মাত্রা লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছে। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার মুহূর্তে। তখনো কেবলমাত্র হিটলার, মুসোলিনিরা নয় দিকে দিকে দক্ষিণপন্থীদের রমরমা শুরু হয়েছিল প্রায় একই সঙ্গে। আসলে এটা ইতিহাস। কথাতেই আছে হিস্ট্রি রিপিট এগেইন অ্যান্ড এগেইন। ইতিহাস বারে বারে ফিরে ফিরে আসে।

ইতিহাস যেমন বারে বারে ফিরে আসে তেমনই অতীতে দেখা গিয়েছে অতি দক্ষিণপন্থার উত্থান যেমন হাত ধরাধরি করে হয় তেমনি তার পতনও প্রায় হাত ধরাধরি করেই ঘটতে শুরু করে। সেই অনুযায়ী অনুমান করা যেতে পারে আমেরিকায় ভোটে হেরে ট্রাম্পের পতন তেমন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, তেমনই বাকি অতি দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রনায়কদের পতনও খুব শীঘ্রই ঘটবে। আর এই যায়গায় এসেই আর‌‌ও কতগুলি বিষয় চলে আসছে। এক্ষেত্রে পুরো বিষয়টি খুঁটিয়ে পর্যালোচনা করা জরুরি।

আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে ট্রাম্পের পরাজয় অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু বারে বারে সংবিধান এবং যাবতীয় রীতি-নীতিকে অস্বীকার করা এই মার্কিন রাষ্ট্রপতির সম্পূর্ণ পতন বোধহয় ঘটল আমেরিকার সংসদ ভবন ক্যাপিটল হাউস আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে। আসলে ট্রম্প সমর্থকদের এই হামলার পরবর্তী পর্যায়ে গোটা বিশ্বের পাশাপাশি আমেরিকার সাধারণ মানুষ ও রাজনীতিবিদরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেন এবং পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন তা নিশ্চিত করে দেয় ট্রাম্প জামানার সবকিছুকেই তারা ক্ষতিকারক বলে মনে করছেন! এই মনে করাটা খুব একটা ভুল‌ও নয়। বরং তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে তা বোধহয় পুরোটাই সঠিক চিন্তা ভাবনা।

ঠিক এই পর্বের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে পড়েছে ভারত। ক্যাপিটল হামলায় ভারতের জাতীয় পতাকা দেখা গিয়েছিল বলে নয়, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটি জড়িয়ে পড়েছে ওই ঘটনার পর মার্কিন রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলি যেভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ফেসবুক এবং টুইটারের মতো দুটি শীর্ষস্তরের সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থা ঘোষণা করে ট্রাম্পের যাবতীয় অ্যাকাউন্ট তারা ব্লক করে দিয়েছে। এর পরেই বিজেপির যুব সংগঠন যুব মোর্চার সর্বভারতীয় সভাপতি তথা বেঙ্গালুরুর সাংসদ তেজস্বী সূর্য সহ বেশকিছু শীর্ষস্তরের বিজেপি নেতা সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলির এই পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করেন!

তেজস্বী সূর্য বলেন, “টুইটার এবং ফেসবুকের পদক্ষেপ থেকে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের থেকেও এই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি অনেক বেশি ক্ষতিকারক। আমেরিকার রাষ্ট্রপতিকে ব্যান করে দেবার মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে এদের আটকাল না। এরা এক‌ই ধরনের কাজ এদেশেও করতে পারে। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত দ্রুত আইন প্রণয়ন করে এই সংস্থাগুলির হাত বেঁধে দেওয়া।”

আপাত ভাবে দেখলে মনে হবে এই তরুণ বিজেপি সাংসদ তার নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কি ট্রাম্পের পতনে অশনি সংকেত দেখতে শুরু করেছে এদেশের গেরুয়া শিবির? তাহলে কি বিজেপির আইটি সেল ভয় পেতে শুরু করেছে যে তাদের ওপরেও একই রকম নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে এই দুই সামাজিক মাধ্যম?

এই প্রশ্নগুলি ওঠা যেমন স্বাভাবিক তেমনি বিজেপির আইটি সেল যে লক্ষ লক্ষ ফেক অ্যাকাউন্ট বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তৈরি করে নিজেদের পক্ষে প্রচার চালায় তাও অতীতে বারবার প্রমাণ হয়ে গিয়েছে।
এখন যদি ফেসবুক, টুইটারের মতো সংস্থার পক্ষ থেকে এই অ্যাকাউন্টগুলিও ব্লক করে দেওয়া হয় এবং অসহিষ্ণু মতামত ছড়ানোর অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে শুরু করা হয়, তাহলে বেশকিছু বিজেপির শীর্ষস্তরের নেতাদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় তৈরি হতে পারে! সে ক্ষেত্রে জনমতকে ম্যানিপুলেটেড বা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী যেভাবে বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বিজেপি তা আর ততটা সম্ভব হবে না। কোটি কোটি মানুষের কাছে নিজেদের প্রোপাগান্ডা পৌঁছে দেওয়া এবং যেনতেন প্রকারে তা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে বিজেপি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে ভারতের রাজনীতিতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল তা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা ষোল আনা।

এই পর্যায়ে পৌঁছে শেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে আইটি সেলের প্রতিপত্তির ওপর নির্ভর করেই কি নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের এই সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে? সেক্ষেত্রে আইটি সেলের প্রতিপত্তি ধাক্কা খেলে তাদের এই রমরমা যে আর থাকবে না তা কি ইতিমধ্যেই বুঝে গিয়েছেন বিজেপি নেতারা?এই প্রশ্ন যেমন থাকবে তেমনি তার যে সরাসরি উত্তর মিলবে না এটাও পরিষ্কার। আসলে আমাদের অনেক কিছু বুঝে নিতে হয়!