তৃণমূল শাসিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে রাজ্যের বিজেপি নেতারা মাঝেমধ্যেই রাষ্ট্রপতি শাসনের জুজু দেখান। যেকোনো রাজনৈতিক অশান্তির পর এই রাজ্যের বিজেপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তোলা হয়। মজা হচ্ছে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হয়েও রাজ্যপাল জাগদীপ ধনকার পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রপতি শাসন জারির বিষয়ে কেন্দ্রের কাছে তদবির করেছেন বেশ কয়েকবার।

অবশ্য রাজ্যের বিরোধী দলের রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি এটাই প্রথম নয়। নানা সময় নানা রাজ্যে বিরোধীদের তরফ থেকে এই দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হলো সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের নির্দেশ অনুযায়ী বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেও কোনো রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারবেনা। একমাত্র সেই রাজ্যের রাজ্য সরকার যদি রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার সুপারিশ করে তবেই তা সম্ভব। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা সম্ভব না হলেও আমরা বরং বর্তমান পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে বিশ্লেষণ করে দেখি “যদি এই রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হতো, তাহলে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের কতটা ক্ষতি হতো।”

১) ক্ষমতা হারাতে হবে

কোনো রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়া মানে সেই রাজ্যের তৎকালীন নির্বাচিত বা দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়। তখন রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসাবে সেই রাজ্যের রাজ্যপাল রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাই পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হলে সর্বপ্রথম মমতা ব্যানার্জির সরকারকে ক্ষমতা হারাতে হবে। যা কখনোই তৃণমূল কংগ্রেস চাইবে না।

২) ঘুরপথে রাজ্য পরিচালনা করবে বিজেপি

রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হলে রাজ্যপাল প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্ব পাবেন। সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের শাসন সংক্রান্ত সমস্ত সিদ্ধান্তের ওপর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রভাব খাটাতে শুরু করবেন। যার অর্থ পরোক্ষভাবে বিজেপি নেতারা পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী হয়ে উঠবেন।

images 22 1
The Financial Express

৩) পুলিশ প্রশাসন কেন্দ্রের নির্দেশে চলতে বাধ্য থাকবে

রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হলে রাজ্যপালের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সরাসরি নির্দেশ দেওয়ার সুযোগ পাবে। এর ফলে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে প্রশাসন। যার প্রভাবে তৃণমূলের শক্তি ক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।

৪) রাজ্য সরকারের গোপন ফাইল কেন্দ্রের হাতে পৌঁছে যেতে পারে

সারদা, নারোদা কান্ড সহ নানা দুর্নীতির মামলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনেক জরুরী তথ্য বিভিন্ন সময় গোপন করে গিয়েছে বলে বিরোধীদের তরফ থেকে বারবার অভিযোগ করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হলে রাজ্য সরকারের প্রতিটি দপ্তরের ওপর কেন্দ্র প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে। তার ফলে এই সমস্ত ঘটনার যাবতীয় গোপন ফাইল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আর তা যদি বাস্তবায়িত হয় সে ক্ষেত্রে তৃণমূল পরিচালিত সরকারের যাবতীয় গোপন তথ্য ঘুর পথে বিজেপির হস্তগত হওয়া স্রেফ কিছু সময়ের বিষয়। আর এই সমস্ত তথ্য একবার হাতে পেলে বিজেপির পক্ষে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূলকে কোণঠাসা করে ফেলা আরো সহজ হবে।

৫) দলের ভাঙ্গন আরো চওড়া হবে

রাজ্য প্রশাসনের ওপর পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করার মাধ্যমে তৃণমূলের ভাঙ্গন আরো বাড়ানোর চেষ্টা করবে বিজেপি। তার ফলে বেশ কিছু শীর্ষস্তরের তৃণমূল নেতা দলত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দিতে পারে। এই ঘটনা যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে তৃণমূলের ব্যাপক শক্তিক্ষয় ঘটবে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি রাজ্যব্যাপী নিজেদের সংগঠনকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে সক্ষম হবে।

অনেক সময় দেখা গিয়েছে একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর দলের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। এর মূল কারণ হলো দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে দলের নেতারা যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন তা হাতছাড়া হলে চট করে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তারা মানিয়ে নিতে পারেন না। এর ফলে তারা তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের দিকে অনেক সময় ঝুঁকতে শুরু করে। যদি পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয় তবে তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে। তখন তৃণমূলের মধ্যেও ক্ষমতা হারানোর ফলে নেতৃত্বে রেখাংশের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেতে পারে, যার ফলস্বরূপ দলের ভাঙ্গন অনিবার্য হয়ে উঠবে।