গত লোকসভা ভোটে দলের অত্যন্ত খারাপ ফলাফল হওয়ার পর ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে মূলত অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শে চুক্তি করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পরামর্শ এবং কৌশলে তৃণমূল লাভবান হবে কিনা তা বোঝা যাবে একুশের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বের হওয়ার পর। তবে তার আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলটিতে বেশ কিছু পরিবর্তন নজরে আসছে।

নির্বাচনী কৌশল রচনা করেন যারা সেই বিশেষজ্ঞদের অন্যতম প্রধান কাজই হলো একটি দলের যা ত্রুটি ও খামতি আছে সেগুলিকে শুধরে দেওয়া এবং তার প্লাস পয়েন্ট গুলোকে আরো বেশি করে মানুষের সামনে তুলে আনা। পিকে ঠিক এই কাজটাই করছেন তৃণমূলের অভ্যন্তরে। আমরা বরং একটু খুঁজে দেখি পিকের প্রভাবে তৃণমূলের প্রধান কোন পাঁচটি পরিবর্তন ঘটল।

images 14 1
AITC

১) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলটপকা মন্তব্যে লাগাম টানা

প্রশান্ত কিশোর তার কাজ শুরু করার পর থেকেই দেখা গিয়েছে তৃণমূল সুপ্রিমোর ভাষণে অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে। এর আগের পর্যায়ে তিনি মাঝেমধ্যেই বেশকিছু আলগা মন্তব্য করে বিতর্কের শিরোনামে উঠে আসতেন। খুব সম্ভবত প্রশান্ত কিশোর তাকে বুঝিয়েছেন যে এই সমস্ত আলগা মন্তব্য করার ফলে তা নিয়েই চর্চাতেই ব্যস্ত থাকে রাজ্যবাসীর একাংশ এবং মিডিয়াগুলি। যার ফলে সরকারের উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলি নিয়ে যাবতীয় আলোচনা পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে প্রশান্ত কিশোরের এই পরামর্শটি সাদরে গ্রহণ করেছেন তা তার বর্তমান সময়ের বক্তৃতাগুলি শুনলেই বোঝা যাবে। তিনি আর আগের মতো “ডহর বাবু” সুলভ ইতিহাস বিকৃত মন্তব্য যেমন করেন না, ঠিক তেমনি অসম্পূর্ণ তথ্য‌ও আর জনসমক্ষে পেশ করেন না।

FL18SUVENDUADHIKARI
FL

২) জেলা পর্যবেক্ষক পদ তুলে দেওয়া

প্রশান্ত কিশোর আসার আগে তৃণমূলের সাংগঠনিক কাঠামোয় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ ছিল জেলা পর্যবেক্ষক পদটি। প্রতিটি জেলার পর্যবেক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করা হতো শীর্ষ স্তরের কোনো একজন নেতাকে। এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জেলার পর্যবেক্ষক পদে ছিলেন অধুনা বিদ্রোহী তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারী। পিকে এসে তৃণমূল নেত্রীকে বোঝান এই পদটি থাকলে দলের মধ্যে তার সমান্তরাল একটা ক্ষমতার কেন্দ্র তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তারপর‌ই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের সাংগঠনিক কাঠামো সংস্কার করে জেলা পর্যবেক্ষক পদ তুলে দিয়ে তার বদলে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সর্বোচ্চ স্তরের একটি কোর কমিটি গঠন করেন।

প্রশান্ত কিশোরের আশঙ্কা যে সঠিক ছিল তা প্রমাণিত হয়ে যায় শুভেন্দু অধিকারীর বিদ্রোহ করার মধ্য দিয়ে। কারণ জেলা পর্যবেক্ষক পদ তুলে দেওয়ার ফলে এই বিদ্রোহী তৃণমূল নেতার ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তি বহুলাংশে কমে যায়। তারপরেই পুরানো ক্ষমতা ফিরে পেতে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন দলের বিরুদ্ধে।

৩) মুখপাত্ররা ছাড়া বাকিদের মুখ খোলা বন্ধ হয়ে যায়

প্রশান্ত কিশোর এসে দেখেন কংগ্রেস ঘরানার রাজনৈতিক দল হওয়ায় তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা সেভাবে নেই। তার ফলে যেকোনো রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে দলের একাধিক নেতা সংবাদমাধ্যমের সামনে দলীয় অবস্থানের নাম করে নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো বিবৃতি দিচ্ছেন। এর ফল স্বরূপ তৃণমূলের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে যেমন বারবার বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তেমনি দল সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের কাছে ভুল বার্তা গিয়েছে একাধিকবার। এই পরিস্থিতির বদল ঘটাতে এই ভোট কৌশলীর পরামর্শ মতো দলীয় মুখপাত্র ছাড়া আর কোনো নেতার সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খোলা কড়াভাবে বন্ধ করে দেন তৃণমূল নেত্রী। যার সুফল ইতিমধ্যেই হাতেনাতে পেতে শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেস।

images 15 3
Facebook

৪) একাধিক জনসংযোগ মূলক প্রকল্প গ্রহণ

২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের খারাপ ফলাফল হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল জনসাধারণের সঙ্গে দলীয় নেতা ও কর্মীদের দূরত্ব তৈরি হ‌ওয়া। প্রশান্ত কিশোর এই বিষয়টি লক্ষ্য করেন এবং তিনি বুঝতে পারেন তৃণমূল কংগ্রেসকে মানুষ ভোট দেয় মূলত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেই। এর পরেই তার কৌশল রচনা করতে শুরু করেন তিনি। প্রথমেই “দিদিকে বলো” এর মতো একটি মেগা জনসংযোগ কর্মসূচি রাজ্যবাসীর সামনে নিয়ে আসেন তিনি। এই কর্মসূচির সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে তারপর আরও একাধিক জনসংযোগ মূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। রাজনৈতিক মহল মনে করচ্ছে এই সমস্ত কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে তাদের নষ্ট হয়ে যাওয়া জনসংযোগ অনেকটাই নতুন করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে রাজ্যের শাসক দল।

৫) পিছনের সারিতে চলে যাওয়া নেতাদের গুরুত্ব দেওয়া

প্রশান্ত কিশোর এসে তৃণমূল নেতৃত্বকে একটা কথা পরিস্কার বুঝিয়ে দেন বিজেপির মোকাবিলা করতে গেলে তাদের একজোট হয়ে লড়াই করতে হবে। তাই দলীয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যারা পিছিয়ে পড়ে বর্তমানে কোণঠাসা হয়ে পড়ে আছেন তাদেরকেও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কারণ এই সমস্ত নেতাদের প্রতি জনসাধারণের একটা স্বাভাবিক সহানুভূতি কাজ করে। তাই এই সমস্ত পেছনের সারির নেতাদের গুরুত্ব না দিয়ে অবহেলা করলে তার ক্ষতিকারক প্রভাব আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্কের ওপর পড়তেই পারে।

images 16 2
OneIndia Bengali

এরপরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে উদ্যোগ নিয়ে পুরানো যে সমস্ত কর্মীরা বসে গিয়েছিলেন বা পিছনের সারিতে চলে গিয়েছিলেন তাদেরকে আবার সক্রিয় করে তোলেন। বর্তমানে তৃণমূলের সমস্ত জেলা ও ব্লক স্তরে একসময়ের নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া বহু নেতাকে আবার সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে।

এই মুল পাঁচটা কারণ ছাড়াও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শে তৃণমূল নেতৃত্ব গ্রহণ করেছে। এই ভোট কৌশলী তৃণমূল নেতৃত্বকে বোঝান পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা ধরে রাখতে গেলে বাঙালির জাতিসত্তাকে হাতিয়ার করতে হবে। উল্টোদিকে বিজেপি হিন্দু আবেগকে হাতিয়ার করে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে নিজেদের দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তার পাল্টা হিসাবে বাঙালি আবেগ‌ই হতে পারে তৃণমূলের মূল হাতিয়ার।

এখন দেখার পিকের পরামর্শে তৃণমূলের অভ্যন্তরে এই যে সমস্ত বদল ঘটেছে তার সুফল আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তারা পায়, নাকি এই বদলগুলো রাজ্যের মানুষের কাছে কেবল মাত্র “আই ওয়াশ” হয়েই থেকে যাবে !