মহাকাব্য বলতে শুধুই সাহিত্যের একটা ঘরানা বোঝায় না, প্রাচীন সময়ের জীবন্ত দলিল মহাকাব্য। যে কোনো দেশের যে কোনো ভাষার মহাকাব্যই তাই ইতিহাস প্রেমী মানুষের অন্যতম আকর্ষণ। গল্প, উপন্যাস, নাটক এমনকি কাব্যও পাঠকের কাছে সেই আবেদন জাগাতে পারে না যা একটা মহাকাব্য জাগিয়ে তোলে। একটা গোটা সময়কেই তার সমস্ত খুঁটিনাটি সমেত হাজির করে মহাকাব্য। বাদ দেয় না কিছুই।

তবে মহাকাব্য কোনো ইতিহাসের গ্রন্থ নয়, তাই বাস্তব হুবহু পাতায় পাতায় তুলে ধরার দায় নেই মহাকাব্যের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাই দেখা যায় মহাকাব্যের পাতায় স্থান পেয়েছে অলীক কল্পনা আর অবাস্তব গাঁজাখুরির আখ্যান। আর এই বৈশিষ্ট্যই হয় তো মহাকাব্যকে করে তুলেছে ইতিহাসের চেয়ে অনেক বেশি আবেদনময়ী। মহাকাব্যের পাতায় পাতায় পাঠক খুঁজে চলেন হারানো ইতিহাসের চিরন্তন রূপরেখা।

আমাদের দেশের দুটো মহাকাব্যের কথা জানা প্রায় সকলেরই। বইয়ে না পড়লেও ছোটোবেলায় ঠাকুমার গল্পের আসরে কিংবা ঘুমপাড়ানি গানের সঙ্গে সঙ্গে, রামায়ণ মহাভারতের উপাখ্যান প্রবেশ করেছিল আমাদের মর্মে মর্মে। তাও যদি না হয়, অন্তত বিনোদন জগতে সিনেমা সিরিয়ালের দৌলতে রাম রাবণের যুদ্ধ আর পান্ডব কৌরবদের আখ্যানের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে সকলের। আজকের প্রতিবেদনে আসুন জেনে নেওয়া যাক অন্যান্য দেশের মহাকাব্যের আখ্যানের কথা। জেনে নেওয়া যাক পৃথিবীর সেরা প্রাচীনতম ৬ মহাকাব্য কোনগুলো?

১) গিলগামেশের মহাকাব্য (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ):

17 54 07 images 1

ভাবতে অবাক লাগে, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্য হল মহাকাব্যই। অর্থাৎ সাহিত্য হিসেবে প্রথম লেখা হয়েছিল একটি মহাকাব্য, আর তার নাম হল গিলগামেশের মহাকাব্য। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় এই মহাকাব্য লেখা হয়েছিল। আক্কাদীয় ভাষাতে লিখিত এই মহাকাব্য উরুক দেশের রাজা গিলগামেশের কাহিনী। উরুকের মানুষ রাজা গিলগামেশের অত্যাচারে যখন বিপর্যস্ত, তখনই তাঁদের পরিত্রাণের জন্য দেবতারা পাঠান এনকিদুকে। গিলগামেশ আর এনকিদুর যুদ্ধ, তাঁদের বন্ধুত্ব এবং তৎকালীন মেসোপটেমিয়ার নানা উত্থান পতনের কাহিনী নিয়ে জমজমাট গিলগামেশের মহাকাব্য।

২) মহাকাব্য ইলিয়াস ( আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দ) :

17 54 50 images 1

গ্রিক কবি হোমারের লেখা ইলিয়াসকে কেউ কেউ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য বলেও উল্লেখ করে থাকেন। প্রাচীন গ্রিক কবিদের মধ্যে হোমারের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। শুধু গ্রিস নয়, সমগ্র পাশ্চাত্য সভ্যতার উপরেই হোমারের মহাকাব্যের প্রভাব অবিস্মরণীয়। ট্রয় নগরীর সঙ্গে গ্রিকদের যুদ্ধের গল্প বলে মহাকবি হোমারের ইলিয়াস। বীরত্বের জয়গানই এই মহাকাব্যের মূল উদ্দেশ্য।

৩) মহাকাব্য ওডিসি ( আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দ) :

17 55 55 images 1

গ্রিক কবি হোমারেরই লেখা অপর মহাকাব্য হল ওডিসি। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় লেখা এই মহাকাব্যটির গুরুত্বও ইলিয়াসের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এই কাব্যে ট্রয় নগরীর ধ্বংসের পরে ইথাকার রাজা ওডিসিউস তার নিজের স্বদেশের ভূমিতে ফিরে আসার ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। ফেরার পথে বহু ঝড় ঝাপটা বাঁধা বিপত্তির মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। সঙ্গীহীন ভাবে ঘরে ফেরার এক বেদনাদীর্ণ কাহিনী ওডিসি। হোমারের দুটি মহাকাব্যেই কিন্তু দেবতাদের অলৌকিক কার্যকলাপের বর্ণনা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়।

৪) মহাভারত মহাকাব্য (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ অব্দ) :

17 56 29 images 1

সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীন ভারতের দুটি প্রধান মহাকাব্যের মধ্যে অন্যতম হল মহাভারত। প্রাচীনত্বের দিক থেকে এটি পৃথিবীতে চতুর্থ। সম্পত্তির বিবাদ কিভাবে ভাঙন ধরায় একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে, ধর্মের প্রতিষ্ঠার জন্য কিভাবে যুগে যুগে বলি হয় অধর্ম, মহাভারত বলে সেই কাহিনী। আর কৌরব পাণ্ডবের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের হাত ধরে উঠে আসে প্রাচীন ভারতের সমাজ অর্থনীতি রাজনীতির সুস্পষ্ট উপাখ্যান। মহাঋষি বেদ ব্যাসকেই এই মহাকাব্যের রচয়িতা বলে মনে করা হয়। তবে ঐতিহাসিকদের মতে বেদ ব্যাস কোনো একজন ব্যক্তির নাম নয়, ছদ্মনামধারী একাধিক ব্যক্তির মিলিত রচনা মহাভারত মহাকাব্য।

৫) রামায়ণ মহাকাব্য (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক) :

17 56 51 images

প্রাচীন ভারতের অন্যতম বিখ্যাত মহাকাব্য হল মহাকবি বাল্মীকি রচিত রামায়ণ। এটিও সংস্কৃত ভাষায় লেখা। মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, আদর্শ ইত্যাদি ব্যাখ্যার মাধ্যমে ধর্মের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই মহাকাব্যে। ভগবান রামের পত্নী সীতাকে রাবণের অপহরণে যে কাহিনীর জটিলতা দানা বাঁধতে থাকে, অবশেষে লঙ্কার যুদ্ধে রাবণের পরাজয়ের মাধ্যমে ধর্মের প্রতিষ্ঠাতেই হয় তার পরিসমাপ্তি। রামায়ণ ৭টি কাণ্ড ও ৫০০টি সর্গে বিভক্ত ২৪,০০০ শ্লোকের সমষ্টি। অলৌকিক ঘটনা এবং দেবতার মাহাত্ম্য প্রচার রামায়ণেরও মূল উদ্দেশ্য।

৬) মহাকাব্য ইনিড ( আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৯ অব্দ) :

17 58 25 images 1

প্রাচীন গ্রিসের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বেড়ে উঠেছিল রোমান সভ্যতা। শুধু তাই নয়, গ্রিক সংস্কৃতি সভ্যতার নানা দিকের সঙ্গে রোমান সংস্কৃতির মিল ছিল অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর। গ্রিক কবি হোমারের মতোই প্রাচীন রোমের জনপ্রিয় কবি ছিলেন ভার্জিল। মহাকবি ভার্জিল রোমান ভাষায় লেখেন সর্বকালের সেরা মহাকাব্য ইনিড। রোমান সম্রাট অগাস্টাসের সময়কালে এই কাব্য লেখা হয়। এই কাব্যের সঙ্গেও পাওয়া যায় হোমারের মহাকাব্যের সূত্র। ইলিয়াস কাব্যটি যেখানে শেষ হয়, সেই ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবশেষ থেকেই শুরু হয় ভার্জিলের ইনিডের উপাখ্যান। এই কাব্যের নায়ক ইনিয়াসের ট্রয় থেকে কার্থেজ নগরীর উদ্দেশ্যে যাত্রার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে ইনিড মহাকাব্যে।

সবশেষে বলা যায়, প্রাচীন মহাকাব্য গুলির অসাধারণ কবিত্ব শক্তি এবং চরিত্রচিত্রণ আজকের একুশ শতকের পাঠকের মনেও বিস্ময়ের উদ্রেক করে। দেশ বিদেশের সমস্ত মহাকাব্যই কোথাও গিয়ে যেন এক সুরেই গাঁথা হয়ে যায়।