লাভ জিহাদ! আশ্চর্যজনক এক শব্দ বন্ধ। একটি ইংরেজী ও একটি আরবি শব্দকে একত্রে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার ফলে কোনো সঠিক অর্থ তৈরি না হলেও একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতার ইন্ধনে এই শব্দটা বর্তমানে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।

ইংরেজিতে লাভ মানে ভালোবাসা এটা আমরা সবাই জানি। আর আরবি শব্দ জিহাদের অর্থ হলো সংগ্রাম। এই দুটো শব্দকে একত্রিত করলে মানে দাঁড়ায় ভালোবাসার সংগ্রাম!

ভালোবাসা হলো মানুষের মনের অত্যন্ত পবিত্র এক অনুভূতি। সেই অনুভূতি লালন পালনের জন্য বা অর্জনের জন্য কখনো কোনোদিন কাউকে সংগ্রাম করতে হয়নি। আর যে ভালোবাসা অর্জন করতে সংগ্রামের প্রয়োজন হয় তা আসলে ভালোবাসা নয়, তা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট কারণবশত চাহিদার তাড়না।

অবশ্য ভারতের হিন্দুত্ববাদী নানান সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের নেতারা ভিন্ন ধর্মীয় বিবাহের ক্ষেত্রে লাভ জিহাদ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করছেন। মূলত হিন্দু পরিবারের মেয়ের সঙ্গে কোনো মুসলমান পরিবারের ছেলের বিবাহ হলে বিজেপি নেতারা সেই ঘটনাকে লাভ জিহাদের তকমা দিয়ে দিচ্ছে। দাবি করছে মুসলিম ছেলেটি ভুল বুঝিয়ে হিন্দুধর্মের মেয়েকে বিবাহে বাধ্য করেছে। তারা এক্ষেত্রে বিবাহের পর মেয়েটির ধর্ম পরিবর্তনের প্রসঙ্গে যুক্তি হিসাবে খাড়া করার চেষ্টা করছে।

কিন্তু ঘটনা হলো একটি মুসলিম মেয়ে যদি একটি হিন্দু ছেলের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুসলিম মেয়েটিও ধর্ম পরিবর্তন করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে। অতএব এক্ষেত্রে বিবাহের পর ধর্ম পরিবর্তন করা ভারতীয় সমাজে খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এর থেকে খুব সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে লাভ জিহাদ নিয়ে যাবতীয় প্রচারের পিছনে কোনো তত্ত্বগত জোরালো ভিত্তি নেই। কেবলমাত্র সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এরকম একটা আজগুবি ও অস্বাভাবিক তত্ত্বকে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছে বিজেপি নেতারা।

বিজেপি বিরোধী নানান রাজনৈতিক দলগুলের পক্ষ থেকে বারেবারে অভিযোগ তোলা হয়েছে হিন্দু মুসলিম বিভাজন ঘটানোর উদ্দেশ্যে বিজেপি লাভ জিহাদ নিয়ে এত মাতামাতি করছে। যদিও এই অভিযোগ খুব একটা সঠিক নয়। কারণ বিজেপির রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে তারা রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে, ধর্মের উন্নতির জন্য রাজনীতির ব্যবহার করেন না। তবে সবচেয়ে বড় যুক্তি হল হিন্দু ধর্মের কোনো ধর্মগ্রন্থে বা প্রামাণ্য নথিতে এরকম কোনো উদ্ভট শব্দ নেই। তা থেকেই বোঝা যায় ধর্মের গন্ডির সম্পূর্ণ বাইরে অবস্থান করছে “লাভ জিহাদ”।

প্রশ্ন উঠতে পারে এই তত্ত্বকে সামনে এনে বিজেপির কী লাভ? এরকম একটা তত্ত্ব সামনে আনার ফলে দাঙ্গার মতো ব্যাপক ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টিকারী ধ্বংসলীলা না চালিয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণকে সংঘটিত করা সম্ভব। যার ফল ভোটের সময় বিজেপি অবশ্যই পাবে।
সেই সঙ্গে বিজেপি রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল হওয়ায় তারা নারী পুরুষের মধ্যে মেলামেশা, নিজের ইচ্ছায় বিবাহ এগুলো পছন্দ করেনা। এক্ষেত্রে লাভ জিহাদের জুজু দেখিয়ে বিশেষত হিন্দু পরিবারের মেয়েদের ওপর বিধিনিষেধ আরো কঠোর করা সম্ভব হবে।


ভারতবর্ষে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী ভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিবাহ আইন সম্মত। এরকম বিবাহ সমাজে প্রচলিত থাকলেও তার সংখ্যা যথেষ্ট কম। অতএব বিজেপির পক্ষ থেকে আশঙ্কার যে মূল জায়গাটি প্রচার করা হয়, সেটারই বাস্তব ভিত্তি খুবই দুর্বল। কিন্তু এরকম একটা গোজামিল তত্ত্ব বাজারে ছেড়ে দেওয়ার ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তাদের নিজেদের অনুগত বানিয়ে রাখা অনেক সহজ হয়ে যাবে বিজেপির পক্ষে।

লাভ জিহাদ তত্ত্বকে জনপ্রিয় করে তোলা মধ্য দিয়ে সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করা বিজেপির মূল লক্ষ্য না হলেও এটিকে হাতিয়ার করে তারা রাজনৈতিক ফায়দা অতি অবশ্যই পেতে চায়। তাই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো লাভ জিহাদ আটকানোর জন্য আইন প্রণয়নের কথা জানিয়েছে। এই আইন প্রণয়নের মূল কারণ হলো নিজেদেরকে মানুষের সামনে হিন্দু ধর্মের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরা।