“স্তালিন জীবন হোক,
আজ থেকে মৃত্যুহীন জীবনের নাম হোক
কমরেড স্তালিন।”

– সুভাষ মুখোপাধ্যায়

আজকের দিনে জন্ম হয়েছিল জোসেফ ভিসারিওনোভিচ ইভানভের। জর্জিয় এই বালকটির শৈশব খুব দুঃখ কষ্টে কাটে। মদ্যপ বাবার অত্যাচার ছিল রোজের ঘটনা। তারপর একদিন হঠাৎ করে সেই বাবা পরিবার ছেড়ে চলে গেল অন্য জায়গায় নতুন করে সংসার পাতার জন্য। অথচ তার শুরুটা এত খারাপ না হলেও বোধহয় পারত। কারণ বাবার আয় খুব একটা খারাপ ছিল না, তিনি একটি মুচি সংস্থার মালিক ছিলেন। কিন্তু ওই বিধিবাম। মদ খেয়ে জুয়া খেলে যাবতীয় টাকা উড়িয়ে দিতেন তিনি।

এরপর মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা সেখানে ভালো রেজাল্ট করা সেই সঙ্গে দস্যিপনায় শিক্ষকদের ঘোল খাইয়ে দেওয়া, এগুলো খুব চেনা পরিচিত ইতিহাস বালক থেকে জোসেফের যুবক হয়ে ওঠার পথে। তারপর তো তৎকালীন নিষিদ্ধ বইপত্র পড়ে সেই মিশনারি স্কুল থেকে বহিস্কৃত হয়েছিল সে। এটাও জানা ঘটনা। আর এই যাবতীয় জানা ঘটনাগুলি জড়িয়ে আছে যে পৃথিবী বিখ্যাত নামটার সঙ্গে সেটি হল স্তালিন। যার অর্থ ইস্পাত বা ইস্পাত কঠিন মন।

অনেকে বলেন স্তালিন এই ছদ্মনামটি তিনি নিজেই ধারণ করেছিলেন আবার অনেকের মতে আরেক প্রবাদপ্রতিম মহাপুরুষ লেনিন তাকে দিয়েছিলেন এই নাম। সে যাই হোক এটা বিশ্বের সবাই জানে এক সময় ব্যক্তিগত ক্ষমতা এবং প্রভাব প্রতিপত্তির নিরিখে পৃথিবীর এক নম্বর মানুষ হয়ে উঠেছিলেন জোসেফ থুড়ি জোসেফ স্তালিন।

স্তালিন,
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধকালীন বলশেভিক পলিটব্যুরো; Source- Pinterest

মত-পথ-পরিকল্পনা-কার্যকলাপ নানান বিষয় নিয়ে তার প্রভাব এমন অতুলনীয় যে মৃত্যুর ৬৭ বছর পরও তা নিয়ে আজ শুধু আলোচনা হয় না, তার ভিত্তিতে দুনিয়ার সমাজতন্ত্রী মানুষরা দুই শিবিরে আজও বিভাজিত হয়ে পড়ে। একদল মনে করে তিনি সঠিক, আবার আরেক দল তার পথকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এই বিপুল প্রভাব বিস্তারকারী মনীষীর আজ জন্মদিন।

• জন্ম:

১৮৭৮ সালে ১৮ ডিসেম্বর জর্জিয়ার গোরি শহরে এক মুচির পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। ছোট থেকেই দেখেছে মদ্যপ বাবার খেয়াল চাপলেই মাকে ও তাকে বেধড়ক মারধর করে। সেই ঘটনাই হয়তো তার মনে ইস্পাতকঠিন মানসিকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। তারপর তো মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা, বাবার সংসার ছেড়ে চলে যাওয়া এসব ঘটনা ছিল। বাবা সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার পর জলবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিলেন স্তালিন, তার দাগ প্রমাণ স্বরুপ আজীবন মুখে করে বহন করে গিয়েছেন তিনি।

কিন্তু তার জীবনের নতুন মোড়া আসে ১২ বছর বয়সে। সেই সময় তিনি ঘোড়ার গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে আহত হলে স্থানীয় একটি হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। অদ্ভুতভাবে সেই হাসপাতাল থেকে অপহৃত হয়েছিলেন তিনি। সেই কান্ডটা ঘটিয়েছিল আর কেউ নয় তার দায়িত্বজ্ঞানহীন পিতা। তার বাবা অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে একটি চামড়ার কারখানায় জোর করে কাজে লাগিয়ে দেয়। সেই সময়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন পুঁজিবাদী শক্তি কিভাবে শ্রমিকদের শোষণ করছে। যদিও কয়েকদিনের মধ্যেই সেই কারখানা থেকে পালিয়ে আসতে সফল হন তিনি।

১৮৯৯ সালে মিশনারি স্কুল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। অভিযোগ ছিল নিষিদ্ধ হওয়া সত্বেও মার্কস-এঙ্গেলস রচিত দাস ক্যাপিটাল লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তেন এই মেধাবী ছাত্রটি। সেইসঙ্গে সমাজতান্ত্রিক একটি গুপ্ত সমিতির সদস্য হয়েছিলেন তিনি। যার স্বাভাবিক পরিণতি হয়েছিল এই বহিষ্কার। এরপর সোশালিস্ট ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য হন এবং পুঁজিবাদবিরোধী বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

খুব দ্রুত জার বাহিনীর নজরে পড়ে যান স্তালিন। জার শাসনামলের গুপ্তচর বাহিনী “ওখরানা” তাঁকে গ্রেপ্তার করার বিষয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে বুঝতে পেরেই আত্মগোপন করেন এই স্বভাব বিপ্লবী। যদিও একসময় ঠিক ধরা পড়ে যান। ১৯০২ সালে তাকে সাইবেরিয়ার চালান করে দেয় জার বাহিনী। সে সময় সরকার বিরোধী কার্যকলাপে অভিযুক্তদের সাইবেরিয়াতেই নির্বাসিত করা হতো। যদিও বেশিদিন তাকে আটকে রাখা সম্ভব হয়নি, তিনি জেল থেকে পালিয়ে আসেন। এক সময় নিয়ম হয়ে উঠেছিল তাকে জার বাহিনী আটক করে জেলে ভরবে আর তিনি জেল থেকে পালিয়ে আসবেন। এইভাবে প্রায় ১২ বার কারারক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে জেল পালিয়েছিলেন তিনি।

images 2 12
তিনজন সর্বোচ্চ বলশেভিক নেতৃত্ব স্তালিন-লেনিন-ট্রটস্কি;Source- Wikipedia

• জারের পতন এবং সমাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা:

কিছুদিনের মধ্যেই ভ্লাদিমির ইলিয়ানিচ লেনিনের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে স্তালিনের। তারা একত্রে রাশিয়ায় জার শাসন উচ্ছেদ করে সমাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করতে থাকেন। যদিও স্তালিন জেলবন্দি থাকা অবস্থাতেই ১৯১৭ সালে রাশিয়ার জার শাসনের পতন ঘটে এবং বিপ্লবী সরকার ক্ষমতা দখল করে। যদিও প্রথম পর্যায়ে লেনিন-স্তালিনের বলশেভিক পার্টি ক্ষমতায় আসতে পারেনি। সেই পর্যায়ে গণতন্ত্রকামী এবং সমাজতন্ত্রীদের আরেকটি ধারা মেনশেভিকরা শাসন ক্ষমতার নিজেদের কব্জায় নিয়ে চলে আসে। প্রধানমন্ত্রী হন কেরেনস্কি।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বলশেভিকদের সঙ্গে মেনশেভিকদের ঝামেলা তৈরি হয়। বলশেভিকরা অভিযোগ করতে শুরু করে মেনশেভিকরা সংশোধনবাদী মানসিকতা নিয়ে চলছে যা সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য পূরণের পথে প্রধান বাধা হবে। এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে আবার অস্থির হয়ে ওঠে রাশিয়ার পরিস্থিতি। প্রায় গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই সময় স্তালিন ও ট্রটস্কিকে সামরিক দিক দেখভালের মূল দায়িত্ব দেন লেনিন। দুজনেই তাদের লক্ষ্যে সফল হন কেরেনস্কি সরকারের পতন ঘটিয়ে। রাশিয়ার শাসনক্ষমতা দখল করে নেয় বলশেভিকরা।

এরই মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ রাশিয়ার অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি করে। সেই ক্ষতির পরিমাণ আর বাড়তে না দেওয়ার উদ্দেশ্যে লেনিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়া জার্মানির সঙ্গে সন্ধিচুক্তি স্থাপন করে। আপাতভাবে দেশের শান্তির পরিস্থিতি ফিরে আসলে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজে মন দেয় বলশেভিকরা। এই পর্যায়ে লেনিনের পর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নেতা হিসাবে স্বীকৃতি পান ট্রটস্কি ও স্তালিন। ইউরোপের অন্যান্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টিরগুলির সঙ্গে যোগাযোগ থাকা এবং তাত্ত্বিক নেতা হওয়ার সুবাদে অনেক বেশি পরিচিত ছিলেন ট্রটস্কি। ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার খর্বকায় একটু আড়াল থেকেই যেন কাজ করতে পছন্দ করতেন স্তালিন। তিনি বরং ধীরে ধীরে দলের অভ্যন্তরে তার প্রভাব বৃদ্ধি করার দিকে মন দেন।

ট্রটস্কি ছিলেন দলের সামরিক কমিশনের প্রধান কমান্ডার। এই পরিস্থিতিতে শরীরে গুলি লাগার পর থেকে লেনিন ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করলে ১৯২২ সালে স্তালিনকে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আসলে ট্রটস্কির কার্যকলাপ সম্বন্ধে লেনিনের মনে কিছু সংশয় তৈরি হয়েছিল। যদিও স্তলিনের একরোখা মনোভাব এবং দলীয় নেতাদের ওপর দমন-পীড়নের ঘটনা কানে যেতে অসুস্থ লেনিন দলের কেন্দ্রীয় কমিটিকে চিঠি দিয়ে স্তালিনের বিরোধিতা করেন। তিনি তাতে জানিয়েছিলেন দল এবং রাশিয়ার স্বার্থে স্তালিনকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া জরুরি।

images 3 13
নিকোলাই বুখারিন; Source- The kaiserrich wiki

ইতিমধ্যেই কামেনভ এবং জিনোভিয়েভকে নিজের শিবিরের দিকে টেনে ট্রটস্কিকে দলের মধ্যে ক্রমশ কোণঠাসা করে ফেলেন স্তালিন। অবশ্য ট্রটস্কির বিরুদ্ধে কম অভিযোগ ছিল না। তিনি দলের অভ্যন্তরে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে এমনকি ভিনদেশের সাম্রাজ্যবাদ শক্তিগুলোর সঙ্গে হাত মেলানোর চেষ্টা করছেন বলে বেশ কিছু প্রমাণ বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটির সামনে হাজির করতে সক্ষম হয়েছিলেন স্তালিন। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যু হলে আরো কোণঠাসা হয়ে পড়েন ট্রটস্কি। ১৯২৭ সালে তাকে নির্বাসন দেয় বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটি, বকলমে স্তালিন।

১৯২২ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর শয্যাশায়ী অবস্থাতেই দলের কেন্দ্রীয় কমিটিকে এক দীর্ঘ চিঠি দেন লেনিন। সেই চিঠিতে তিনি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মূল্যায়ন করেন। তাতে ট্রটস্কির অ-বলশেভীয় প্রবণতা সম্বন্ধে দলকে সতর্ক করেন। সেই সঙ্গে জিনোভিয়েভ ও কামেনভের থেকে দলকে সতর্ক থাকতে বলেন। তিনি পরিষ্কার উল্লেখ করেন অক্টোবর বিপ্লবের সময় প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করার মতো ঘটনা এই দুই নেতা আবারও ঘটাতে পারেন। কারণ তাদের মধ্যে সেই প্রবণতার সম্পূর্ণভাবে বিদ্যমান। আরেক শীর্ষ নেতা বুখারিনের মনোভাব পুরোপুরি মার্কসবাদ সম্মত নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

স্তালিনের মতাদর্শ নিয়ে কোনো প্রশ্ন না তুললেও তাকে অত্যন্ত একরোখা এবং কর্মসূচি রূপায়ণে নিষ্ঠুর প্রকৃতির বলে বর্ণনা করেন। ১৯২৩ সালের ৫ মার্চ কেন্দ্রীয় কমিটিকে আরেকটি চিঠি দিয়ে স্তালিনের আচরণ অত্যন্ত রূড় বলে চিহ্নিত করে তাকে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার আবেদন জানান লেনিন।

লেনিনের মৃত্যুর চার মাস পর বলশেভিক দলের ত্রয়োদশ পার্টি কংগ্রেস লেনিনের চিঠি সর্বসমক্ষে এনে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন স্তালিন। যদিও তার সেই ইচ্ছেতে বাকি নেতারা সম্মত হননি। তাদের দাবিতেই দলের সাধারণ সম্পাদক পদে তিনি থেকে যান। যদিও অনেক গবেষক দাবি করেন স্তালিন সুকৌশলে বাকি নেতাদের দিয়ে তার প্রতি সমর্থনের বিষয়টি বিশ্বের সর্বসমক্ষে তুলে ধরেছিলেন।

• স্তালিনবাদ:

১৯২২ সালে দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর লেনিনবাদ অর্থাৎ রাশিয়ার উন্নতির বিষয়ে লেনিনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে প্রায় খারিজ করে দেন তিনি। এই পর্যায়তেই স্তালিন নিজের মতামত দলের সামনে রেখে ট্রটস্কির পথের বিরোধিতা করেন। ট্রটস্কির মত ছিল রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হওয়ার পর ইউরোপের বাকি দেশগুলিতেও সেই বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে হবে, তবেই পৃথিবীর মানুষকে শোষণ থেকে মুক্ত করা সম্ভব হবে। এই মতের বিরোধিতা করে স্তালিন পরিষ্কার জানান আগে নিজের দেশকে শক্তিশালী রূপে গড়ে তোলা প্রয়োজন তবে এই অন্যান্য দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা সফল হবে। তার এই মতকে স্তালিনবাদ বলা হয়।

এই পরস্পরবিরোধী মতামতকে কেন্দ্র করে বলশেভিক পার্টির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও ধীরে ধীরে নিজের সাংগঠনিক দক্ষতাকে হাতিয়ার করে দলের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে নিয়ে নেন স্তালিন। এরপরই তিনি লেনিনের “ইনক্লুসিভ ডেভলপমেন্টর” নীতিকে নস্যাৎ করে দিয়ে জানিয়ে দেন দেশ দ্রুত শিল্পায়নের পথে হাঁটবে। এই সময় স্তালিন ইউরোপের বাকি শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য রাশিয়াতে দ্রুত ভারী শিল্পের প্রসার ঘটানো শুরু করেন। তাঁর এই পদক্ষেপ সফল হয়। রাশিয়া একটি কৃষিপ্রধান অনুন্নত রাষ্ট্র থেকে দ্রুত শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়।

• স্তালিনের কর্মপদ্ধতি:

দেশকে খুব দ্রুত শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে সক্ষম হলেও এই সময়ে একাধিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত রাশিয়া তার ভারসাম্য হারায়। বিশেষত কৃষি কাজে যুক্ত মানুষদেরও কলকারখানায় কাজের দায়িত্ব দেওয়ায় দেশের একাধিক অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। যার ফলে অনাহারে বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা যায়। এই শিল্পায়নের রাস্তায় চলতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ওপর অত্যাচার নেমে আসে। যারা কল-কারখানাগুলিতে কাজ করতে অস্বীকার করে তাদের হয় গুম-খুন না হলে সাইবেরিয়ার শ্রমশিবিরে নির্বাসিত করা হয়েছিল।

এই সময়ে স্তালিনের বিরুদ্ধে কেবলমাত্র পুঁজিবাদী দুনিয়াই সরব হয়ে উঠেছিল তা নয়, অনেক বামপন্থী নেতৃত্ব সোচ্চার হয়ে ওঠে। তার এই দমন-পীড়নের মাধ্যমে দেশের উন্নতির পথ কাম্য নয় বলে অনেকেই দাবি করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাশিয়া ভ্রমণের সময় লেখা রাশিয়ার চিঠিতে যেমন সেই দেশের আমূল পরিবর্তন এবং উন্নতির কথা উল্লেখ করেছেন, তেমনি মানুষের স্বাধীনতার হারানোর কথা সুস্পষ্টভাবে লিখে গিয়েছেন।

images 4 11
দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে স্তালিন; Source- Foreignpolicyi.org

এই সময়ে দলের অভ্যন্তরে স্তালিন বিরোধী অংশ ষড়যন্ত্রে শামিল হয়। তাদের মদত দিতে এগিয়ে আসে আমেরিকা-ব্রিটেনের মতো দেশগুলি। এর ফলে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক সরকারকে রক্ষা করতে কড়া পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন স্তালিন। অভিযোগ ওঠে প্রমাণ ছাড়াই স্রেফ সন্দেহের বশে অসংখ্য মানুষকে শাস্তি দিয়েছিলো ক্রেমলিনের গুপ্তচর বাহিনী। এমনকি অনেককে গুম খুন পর্যন্ত তারা করেছিল বলে অভিযোগ। তবে কেবলমাত্র সাধারণ মানুষরাই নয়, সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর মতো সর্বোচ্চ স্তরের সদস্যদের পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড দেন স্তালিন।

জিনোভিয়েভ এবং কামেনভকে স্তালিনের নির্দেশে হত্যা করা হয়। ট্রটস্কি মেক্সিকো পালিয়ে গিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হলেও ১৯৪০ সালে স্তালিনের নির্দেশে এক গুপ্তচর আলোচনা করার অছিলায় ট্রটস্কিকে হাতুড়ি মেরে হত্যা করে বলে অভিযোগ।

নানান বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপের ফলে সন্দিহান হয়ে ওঠা স্তালিনের পক্ষে যেমন স্বাভাবিক ছিল, তেমনি দলের অভ্যন্তরে একের পর এক নেতাকে হত্যা করে তিনি সমাজতন্ত্রের বদলে একনায়কতন্ত্রী শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন রাশিয়ায়। কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে ভিন্নমত স্বীকৃত হলেও স্তালিন ক্রমশ তাঁর বিপক্ষ শিবিরকে নিকেশ করে দেন। যার মাধ্যমে স্তালিনের বিরোধিতা করতে পারে এরকম আর কেউই অবশিষ্ট রইল না।

images 5 11
Source- Amazon.com

• দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্তালিন:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি জার্মানির আক্রমণে ব্রিটেন-ফ্রান্সের মতো ইউরোপীয় মহাশক্তি ষগুলি যখন কোণঠাসা তখন সোভিয়েত রাশিয়ার যোগদান গোটা যুদ্ধের গতিপথকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়। নাৎসী বাহিনীর আক্রমণে ফ্রান্সের পতন ঘটে যায় এবং ব্রিটেনও যথেষ্ট কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল এই সময়। এই পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে নাৎসি জার্মানি আক্রমণ করলে রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হয় লাল ফৌজ। পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে নাৎসি সেনাদের বধ্যভূমিতে রাশিয়াকে পরিণত করে স্তালিনের নেতৃত্বাধীন লাল ফৌজ। এই যুদ্ধে একেবারে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্তালিন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজ বার্লিন দখল করে নিলে হিটলারের পতন ঘটে। ঘটনা হলো এর ফলে এক ভয়ঙ্কর বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল গোটা বিশ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে গোটা দুনিয়া পুঁজিবাদী এবং সমাজতন্ত্রী এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সমাজতন্ত্রী দলের নেতৃত্বে থাকেন জোসেফ স্তালিন। ঠিক এই পর্যায়ে ঠান্ডা যুদ্ধে লিপ্ত হয় পৃথিবীর প্রথম দুই শক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।

• স্তালিনের ব্যক্তি জীবন:

স্তালিন প্রথম বিবাহ করেন ১৯০৩ সালে একতারিনা সভানিদজেকে। তাদের এই দাম্পত্য সম্পর্কে একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিয়েছিল, নাম ছিল ইয়াকভ দঝুগাশভিলি। যদিও বিবাহের চার বছর পর একতারিনা মারা যান। স্তালিনের পুত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির হাতে আটক হলে তারা তার প্রাণের বিনিময়ে একজন উচ্চপদস্থ জার্মান সেনা অফিসারের মুক্তি চায়। কিন্তু নিজের রাজনৈতিক আদর্শে বরাবরের মতো অবিচল স্তালিন সেই প্রস্তাবে সম্মত না হলে জার্মানরা তার পুত্রকে হত্যা করেন। যদিও অনেকে বলেন তার কোনো পুত্র নেই বলে সেই সময়ের দাবি করেছিলেন স্তালিন।

এই প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা দ্বিতীয় বিবাহ বিয়ে করেন নাদিয়া আলুইলুয়েভাকে। অভিযোগ স্তালিনের দুর্ব্যবহারে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। তাদের দাম্পত্য সম্পর্কে স্বেতলানা আলুইলুয়েভা নামে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়েছিল, যিনি স্তালিনের মৃত্যুর পর ষাটের দশকে আমেরিকায় পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে তার লেখা বইয়ে স্তালিনকে একজন নিষ্ঠুর এবং দানবিক পিতা হিসাবে দাবি করেন তিনি।

• মৃত্যু পরবর্তী স্তালিন:

১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ মৃত্যু হয় স্তালিনের। মৃত্যুর সময় তিনি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার মৃত্যুর পর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা যায় নিকিতা ক্রুশ্চেভের হাতে। ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি স্তালিনকে মুছে ফেলার কাজ শুরু করে। তারা প্রচার করতে শুরু করে লেনিনের পথ থেকে সরে এসে স্তালিন রাশিয়ার জনসমাজে বিপর্যয় ডেকে এনেছিলেন। তৎকালীন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির এই পদক্ষেপের সমালোচনায় সরব হয়েছিল পৃথিবীর অন্যান্য বহু দেশের কমিউনিস্ট দলগুলি। বিশেষ করে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধ তখন থেকেই শুরু হয়।

স্তালিনের উদ্যোগ এবং দক্ষতা যেমন পৃথিবীর একটি অনুন্নত অন্ধকারে ডুবে যাওয়া দেশকে খুব দ্রুত উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল, তেমনি মানুষের ওপর নাবিয়ে এনেছিল তীব্র অত্যাচারের দণ্ড। তার আমলেই যেমন পৃথিবী প্রথমবারের জন্য দেখল দেশের প্রতিটা মানুষ সমানভাবে পেট ভরে খেতে পায় বাঁচতে পারে, তাদের চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে, তেমনি ব্যাক্তিস্বাধীনতার যাবতীয় অধিকার হারিয়েছিল সোভিয়েতের মানুষজন। তাই জোসেফ স্তালিনকে সরলভাবে ভালো-মন্দ ব্যাখ্যায় আটকে রাখা যাবে না। তার কর্মপদ্ধতি যেমন মানুষের জীবনের মৌলিক অধিকারগুলি অর্জনে সহায়ক হয়েছিল, তেমনি তিনি কোটি কোটি মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিলেন। স্বীকার করতেই হবে লেনিনের নেতৃত্বে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সফল হলেও তাকে বাস্তবে সফল করে তুলেছিলেন স্তালিন। কমরেড জোসেফ স্তালিন।