ভারতীয় প্রাচীন চিকিৎসা শাস্ত্র হল আয়ুর্বেদ চিকিৎসা। এই চিকিৎসা ৫০০০ বছরের পুরাতন। জীবকুলের কল্যান সাধনের জন্যই এই চিকিৎসা। প্রাচীন যুগে না ছিল হ্যমিওপথি না ছিল আল্যাপথি। তাই আয়ুর্বেদ চিকিতসাই ছিল ভরসা।  আয়ুর্বেদ চিকিৎসা হত সম্পুর্ণ ভেসজ পন্থা অবলম্বনে। শরীরের কোথাও আঘাত লাগলে গাছের মূল, শিকড় বেটে বা শারীরিক কোন অসুস্থতা দেখা গেলে গাছ, গাছালি, জড়িবুটি বাকল, ফুলের রস বা সেগুলি দিয়ে পথ্য তরি করেই খাওয়ানো হত। এবং প্রত্যেকেই তাতে উপকার পেত।

আয়ু’ শব্দের অর্থ ‘জীবন‘ ও ‘বেদ’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’। অর্থাৎ আয়ুর্বেদ কথার অর্থ জীবনজ্ঞান, যে জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের কল্যান সাধন হয় তাই আয়ুর্বেদ। পবিত্র বেদ এর একটি ভাগ – অথর্ববেদ এর যে অংশে চিকিৎসা বিদ্যা বর্ণিত আছে তা-ই আয়ুর্বেদ। 

আয়ুর্বেদ যেহেতু ভেসজ উপায়ে অবলম্বনে চিকিৎসা ও তার পথ্য ভেসজ এবং তাতে কোন পার্শপতিক্রিয়াও নেই তাইএই চিকিত্‍সা বর্তমানে ‘হারবাল চিকিত্‍সা’ তথা ‘অলটারনেটিভ ট্রিটমেন্ট’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

বহু মানুষ আজ আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসী হচ্ছে। কারন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আল্যাপথিতে অনেক পার্শ প্রতিক্রিয়া  থাকে। অনেক সময় এক রোগ থেকে নিরাময় পেতে অ্যালাপথি ঔষধের সেবন করে দেখা যায় আরও অন্য কোন ভয়ঙ্কর রোগ। তাই রোগের উপশম নির্মুল করতে ও এই আয়ুর্বেদিক ঔষধের উপর মানুষ ভরসাপ্রাপ্ত হয়ে পড়ছে। মর্ডান এলোপ্যাথি অনেক ঔষধেরই পার্শ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেমনঃ ঔষধ সিপ্রোফ্লক্রাসিন, ফ্লুক্লক্রাসিলিন, মেট্রোনিডাজল, ক্লক্রাসিলিন প্রভৃতি ঔষধ রোগ সারানোর পাশাপাশি মানব শরীরকে দুবর্ল করে ফেলে এবং দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে স্মৃতিশক্তি, যৌনশক্তি, কর্মক্ষমতা কমে যায়। কিন্তু আয়র্বেদিক সম্পুর্ন ভেষজ উপায়ে চিকিৎসা হয়ে থাকে তাই এক্ষেত্রে কোন রকম ক্ষতি সাধন হয় না বরং  শরীরের অনেক রোগ যেমন পলিওভারি সিস্ট ঠিক হয়ে যাচ্ছে, ত্বক ও চুলের কঠিন রোগের নিরাময় ঘটছে ।

রোগ নির্নয় পদ্ধতি

আয়ুর্বেদ চিকিতসার পদ্ধতি সকল চিকিৎসা থেকে আলাদা। রোগীর শারীরিক ও মানসিক সম্পূর্ণ অবস্থার বিচার করে তবেই রোগ নির্ণয় করা হয়। চিকিত্‌সক আরো কিছু বিষয়ে ধ্যান দেন, যেমন রোগীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, হজমের ক্ষমতা, কোষ, পেশী ও ধাতু ইত্যাদি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  আক্রান্তের শারীরিক টিশুগুলি, ধাতু, কোন জায়গায় রোগ স্থিত, রোগীর রোধক্ষমতা, প্রাণশক্তি, দৈনন্দিন রুটিন এবং রোগীর ব্যক্তিগত, সামাজিক, ও অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা।

রোগ নির্ণয়ের বিশেষ কিছু পরীক্ষা

  • সাধারণভাবে শারীরিক পরীক্ষা
  • নারীর স্পন্দন পরীক্ষা
  • মূত্র পরীক্ষা
  • মল পরীক্ষা
  • জিহ্বা এবং চোখ পরীক্ষা
  • চামড়া এবং কান পরীক্ষা, স্পর্শনেন্দ্রিয় এবং শ্রবনেন্দ্রিয় এর ক্রিয়াকলাপ পরীক্ষা

আয়ুর্বেদ চিকিৎসার জনপ্রিয়তা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আর মানুষ  বরাবর বিকল্প রাস্তা খোঁজে, যেখানে টাকা কম মানুষ সেদিকেই ভিড় করে।  আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার সব থেকে ইতিবাচক দিক হলো এটা প্রাকৃতিক ও এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। খরচ অ্যালোপ্যাথির চেয়ে অনেক কম।  তাই অন্যন্য চিকিৎসা পদ্ধতির পাশাপাশি আয়ুর্বেদ চিকিৎসার  অবদানকে কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।

আয়ুর্বেদিক পথ্য

 হলুদ

হলুদকে অনেক সময়া অলৌকিক ভেষজ বলা হয়ে থাকে। এতে থাকে ফাইবার পটাশিয়াম, ভিটামিন বি-৬, ম্যাগনেশিয়াম ও ভিটামিন সি। এতে থাকা কারকিউমিন নামক রাসায়নিক বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। হলুদ পরিপাকে সাহায্য করে, ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়ে, অনিদ্রা দূর করতে সাহায্য করে, ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। 

বাসকপাতা

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ উদ্ভিদ বাসক। এর পাতায় থাকে এক ধরনের ক্ষারীয় পদার্থ ও তেল। শ্বাসনালীর লালাগ্রন্থিকে সক্রিয় করে বলে বাসক শ্লেষ্মানাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কাশি এবং শ্বাসনালীর প্রদাহে এই পাতা বিশেষ উপকারী। তাছাড়া কৃমি, হাঁপানি, জন্ডিস ইত্যাদি রোগে বাসক পাতা ব্যবহার করা হয়। 

আদা

এটি ঝাঁঝালো এই খাবারটি খাদ্যের স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি দেহের সুস্থতার জন্যও বিশেষভাবে উপকারী। মুখের রুচি ফেরাতে আদার কোনো জুড়ি নেই। ক্রোমিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও জিঙ্ক, লবণ, পটাশিয়াম ইত্যাদি উপাদান রয়েছে আদাতে। আদার রয়েছে বিভিন্ন রকম ভেষজ গুণ। বমি বমি ভাব, হজমে সমস্যা, মাথা ঘুরানো, সর্দি-কফ-কাশি, জ্বর, ব্যথা ইত্যাদি সমস্যায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে আদা খাওয়া হয়।

মধু

মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান থাকে। এরমধ্যে রয়েছে ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৫, বি৬, আয়োডিন, জিংক ও কপারসহ অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান। মধু দেহের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সুরক্ষায় কাজ করে। ফুসফুসের যাবতীয় রোগ, অনিদ্রায়, কোষ্ঠকাঠিন্যে, হজমে, দেহে তাপ উৎপাদনে, হাঁপানি রোধ, সর্দি-কাশিসহ অন্যান্য রোগে কাজ করে মধু।

তুলসীপাতা

রোগব্যাধির যম বলা হয় তুলসীকে। তুলসীপাতাতে রয়েছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-ফাংগাল উপাদান যা রক্ত পরিশুদ্ধ করে। বিপাক ক্রিয়ায় সহায়তা ও দেহের ক্ষয় নিরাময়, দেহে ইনসুলিন উৎপাদনের মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে রক্তে চিনির পরিমাণ কমিয়ে দেয় এই পাতা। ব্রংকাইটিস,  অ্যাজমা, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও সর্দি-কাশিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তুলসী। এছাড়াও সর্দি কাশি হলে তুলসীকে পথ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

তাই বলাই যায় প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান জুগ সকলেই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার দিকে ভিড়েছে। ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য জে এখনও বাহিত হচ্ছে তা সত্যি গর্বের বিষয়। তাই ধীরে ধীরে যত সময় এগোচ্ছে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা জনপ্রিয় হচ্ছে।