১৯৭৭ সালের ২১ জুন জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের প্রথম বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। সেই সময় তিনিই ছিলেন অটোমেটিক চয়েজ। স্বাধীনতার আগে থেকেই দীর্ঘ লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নেতৃত্তের শীর্ষস্থানে উঠে আসেন জ্যোতি বাবু। ঘটনা হলো বর্তমানে “সেই রাম‌ও নেই, সেই রাজত্ব‌ও নেই”! ২০১১ সালে রাজ্যের ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার পর কমতে কমতে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় রাজনৈতিক  শক্তিতে পরিণত হয়েছে বামফ্রন্ট, বলা ভালো সিপিআই(এম)। কারণ ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি এবং সিপিআই এই বাকি তিন বড় শরিক দলের অস্তিত্ব বলতে আর কিছুই নেই পশ্চিমবঙ্গে, এক কথায় তা বলাই যায়। তাদের পুরোটাই নির্ভর করে বড় দাদা সিপিআই(এম) কি করবে তার ওপর।

২০১৯ এর লোকসভা ভোটের নিরিখে বিচার করলে এই মুহূর্তে অনেক দূরের তিন নম্বর শক্তিতে পরিণত হয়েছে বামেরা। যেখানে তৃণমূল এবং বিজেপিকে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে পরস্পর লড়াই করছে সেখানে বামেরা লড়ছে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বজায় রাখতে! কারণ লোকসভা নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে একুশের বিধানসভা নির্বাচনেও যদি সম্পূর্ণ শূন্য হাতে ফিরে আসে বামপন্থী দলগুলো সেক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব মুছে যাবে পশ্চিমবঙ্গের বুক থেকে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে এসইউসিআই(সি) এর কথা বলা যায়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বর্তমানে এই অতি বামপন্থী দলটির আর কোনো গুরুত্ব নেই। একসময় দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলী ও জয়নগর এই দুটি বিধানসভা কেন্দ্র একচেটিয়াভাবে নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হলেও বর্তমানে সেই জায়গাতেও চরম অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে এসইউসিআই(সি)।

ঘটনা হল এসইউসিআই(সি) কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বামফ্রন্টের অন্তর্গত দল নয়। সে যাই হোক, আমাদের মূল ফোকাস করব সিপিআই(এম) এর ওপর। কারণ? হ্যাঁ, কারণ একটা আছে। তৃণমূল ও বিজেপির নিত্যদিনের আকচা আকচি এবং দল ভাঙার খেলায় ক্রমশ মনে হচ্ছে রাজ্যের একটা বড় অংশের মানুষের কাছে তৃতীয় বিকল্পের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের মধ্যে যদি জোট হয়, তবে এই জোটই আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃতীয় বিকল্পের পরিসর দখল করতে পারে। আর কে না জানে রাজনীতি মহা অনিশ্চয়তার খেলা। সম্ভাবনা আপাতত কম হলেও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না বাম-কংগ্রেস জোটের ক্ষমতায় চলে আসার বিষয়টি।

কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে দাবি করা হচ্ছে হয়েছে তারা নাকি রাজ্যের বেশিরভাগ আসনে লড়াই করবে এবং মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী তাদের দল থেকেই কেউ হবে। এটুকু পরিষ্কার করে বলে দেওয়া যায় এটা দাবির স্তরেই থেকে যাবে। কারণ মুর্শিদাবাদ, মালদা এবং দুই দিনাজপুর জেলা ছাড়া রাজ্যের আর কোথাও কংগ্রেসের অস্তিত্বই নেই। তাই এই প্রস্তাবকে দর কষাকষির একটা উপায় ছাড়া আর কিছু ভাবার দরকার নেই। অর্থাৎ এখান থেকে বোঝাই যাচ্ছে জোট হলেও রাজ্যের বেশিরভাগ আসনে বামফ্রন্ট‌ই প্রার্থী দেবে এবং সে ক্ষেত্রে সিপিআই(এম) এর কোনও নেতাকেই জোটের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে তুলে ধরা হবে।

মুখ্যমন্ত্রী,
The Live Mirror

এই পর্যায়ে আসার পর থেকেই আমাদের আলোচনাটা সম্পূর্ণ অন্য দিকে মোড় নেবে। আমরা আলোচনা করে দেখব কোন কোন সিপিআই(এম) নেতা আগামী বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন, অবশ্যই যদি বামফ্রন্ট বা বাম-কংগ্রেস জোট রাজ্যের ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়।

১) মহম্মদ সেলিম

একুশের বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআই(এম) এর প্রধান মুখ হ‌ওয়ার ক্ষেত্রে তাদের দলের এই পলিটব্যুরো সদস্য সবচেয়ে এগিয়ে আছেন বলে মনে হয়। সে ক্ষেত্রে সেলিমকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করলে বা দলের প্রধান মুখ করলে এই রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছেও বিশেষ বার্তা দেওয়া সম্ভব হবে। কারণ স্বাধীনতার পর থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো সংখ্যালঘু নেতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হননি। সত্যি বলতে কি উঁচু জাতের নেতারাই বার বার ঘুরে ফিরে এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মহম্মদ সেলিম একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। সিপিআই(এম) এর ছাত্র সংগঠন এসএফআই থেকে তার রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয়। তারপর যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই ঘুরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারে যুব কল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। পরবর্তীকালে তিনি লোকসভায় সিপিএমের দলনেতা হয়েছিলেন। এই মুহূর্তে পলিটব্যুরো সদস্য হওয়ার সূত্রে তিনি দলের অন্যতম প্রধান নীতিনির্ধারক। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর‌ও সদস্য সেলিম। এই ধর্মনিরপেক্ষ নেতা বাংলা ও হিন্দির পাশাপাশি উর্দু ভাষাতেও সমান স্বচ্ছন্দ। তার ফলে এই রাজ্যের বাঙালি এবং উর্দুভাষী উভয় শ্রেণীর মুসলমানদের কাছেই তার যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা আছে।

হারানো সংখ্যালঘু ভোট ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে বলিয়ে ক‌ইয়ে এই নেতাকে দলের প্রধান মুখ হিসাবে সিপিআই(এম) নির্বাচিত করলে তা অত্যন্ত যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত হবে বলে আমাদের মনে হয়।

images 1 13
Twitter

২) সুজন চক্রবর্তী

একসময় এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সুজন বাবু। পরবর্তীকালে তিনি বিধায়ক এবং সাংসদ হিসাবে পরিষদীয় রাজনীতিতে এই দুই ভূমিকা‌ই পালন করেছেন। একসময় দীর্ঘদিন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিআই(এম) এর সম্পাদক থাকার সূত্রে তার সাংগঠনিক দক্ষতাও যথেষ্ট। বর্তমানে তিনি বিধানসভায় বাম দলনেতার ভূমিকা পালন করছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সুজন বাবুকে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে দলের মুখ করার একটা সম্ভাবনা আছে।

এই বামপন্থী নেতা দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য হওয়ার পাশাপাশি সিপিআই(এম) এর অন্যতম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যর ভূমিকাও পালন করছেন। বামপন্থী রাজনীতির সর্বোচ্চ স্তরের অভিজ্ঞতা তার আছে। গত পাঁচ বছর ধরে বামফ্রন্টের পরিষদীয় দলনেতার ভূমিকায় তিনি বার বার বিভিন্ন জেলায় ছুটে বেড়িয়েছেন, যা মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে তার দাবীকে আরো জোরদার করে তুলেছে।

images 2 13
Frontline- The Hindu

৩) সূর্যকান্ত মিশ্র

২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোটের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ছিলেন সূর্যকান্ত মিশ্র। যদিও সেই নির্বাচনে বাম কংগ্রেস জোটের পরাজয়ের পাশাপাশি সূর্যবাবুর নিজেও তার দীর্ঘদিনের জেতা আসন নারায়ণগড় থেকে পরাজিত হন। তারপর সংসদীয় রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে দলীয় সংগঠনেই মন দিয়েছেন তিনি। এই মুহূর্তে তিনি সিপিআই(এম) এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি অন্যতম পলিটব্যুরো সদস্য।

দীর্ঘদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন পেশায় চিকিৎসক সূর্যবাবু। তার এই অভিজ্ঞতাকে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতেই পারে সিপিআই(এম)। তবে দল চাইলেও তিনি আরও একবার মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে নির্বাচনের ময়দানে নামতে কতটা আগ্রহী হবেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

images 3 14
Zee News

৪) অশোক ভট্টাচার্য

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারে অশোক বাবু যখন পুর ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রকের মন্ত্রী ছিলেন তখন তাকে বিরোধীরা কটাক্ষ করে “উত্তরবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী” বলতো। ঘটনা হলো বর্তমানে উত্তরবঙ্গে সিপিআই(এম) এর সবচেয়ে পরিচিত এবং জনপ্রিয় নেতা হলেন অশোক ভট্টাচার্য। রাজনৈতিক মহলে বারবার বলা হয় উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের বিজয়রথ শিলিগুড়িতে তিনিই একমাত্র থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বর্তমানে একইসঙ্গে শিলিগুড়ির বিধায়ক এবং শিলিগুড়ি কর্পোরেশনের প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে শিলিগুড়ির মেয়র ছিলেন। কর্পোরেশনের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে তাকে রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রশাসকের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়।

স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কোনো সংখ্যালঘু নেতা যেমন মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে বসেননি, তেমনি উত্তরবঙ্গের কোনো নেতা বা নেত্রীকেও মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এই নিয়ে উত্তরবঙ্গ বাসীদের মনে যথেষ্ট ক্ষোভ আছে। অশোক ভট্টাচার্যকে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে মাস্টার স্ট্রোক দিতেই পারে সিপিআই(এম)। সে ক্ষেত্রে তারা উত্তরবঙ্গের বাসিন্দাদের ভোট একচেটিয়া পাওয়ার আশা করতে পারে।

দীর্ঘদিনের পরিষদীয় রাজনীতির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অশোক বাবু অতীতে দলের দার্জিলিং জেলা সম্পাদকের ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য। তাই দলের অভ্যন্তরে তার রাজনৈতিক উচ্চতা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বরাবরের ফ্রন্ট ফুটে খেলা এই রাজনীতিকে দলের মুখ করলে লাভ বই কোনো ক্ষতি হবে না সিপিআই(এম) এর।

images 4 12
Facebook

৫) শতরূপ ঘোষ

টানা দুবার বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সত্ত্বেও জয়লাভ করতে ব্যর্থ হলেও এই ছাত্রনেতা বর্তমানে সিপিআই(এম) এর প্রধান যুব মুখ। সিপিআই(এম) এর বিরুদ্ধে বিরোধীরা সহ রাজ্যের মানুষ বারে বারে অভিযোগ তুলেছে তারা নতুন প্রজন্মের কাউকে ক্ষমতা ছাড়ে না বা সামনে তুলে আনে না। এক্ষেত্রে শতরূপকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে রাজ্যের যুব সমাজের কাছে সুস্পষ্ট বার্তা দিতে পারে এই বামপন্থী দলটি। সে ক্ষেত্রে যুবসমাজের ভোট একচেটিয়াভাবে তাদের ঝুলিতে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।

আমরা এই আলোচনাটা একটি সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে করলাম। তবে এটা পরিষ্কার কোনোভাবে বামেরা এই রাজ্যে সরকার গড়তে সক্ষম হলে এই পাঁচজনের মধ্যে থেকেই কোনো একজন মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পাবেন। এই বিষয়ে আমরা ১০০ শতাংশ নিশ্চিত!