আদিম গুহাপর্ব ছাড়িয়ে মানবসভ্যতা পৌঁছে গেছে একু্শ শতকের আধুনিকতায়। বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নতি, মানুষের নিত্যনতুন উদ্ভাবনী শক্তি ছুঁয়ে এসেছে আকাশের চাঁদকেও। কিন্তু এই একুশ শতকেও আদিম প্রবৃত্তির যে পাশবিক ছাপ রয়ে গেছে সমাজে তা হল ধর্ষণ। ধর্ষণ বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন সম্ভোগকে আধুনিক সমাজের এক চরমতম অভিশাপ বলা চলে। আর বিশ্বের দরবারে ভারতের সমস্ত সাফল্যকে ম্লান করে দিয়ে পরিসংখ্যান জানান দেয়, মহিলাদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ হল ভারতবর্ষ।

ভারতের যে রাজ্য গুলি বারবার ধর্ষণের ঘটনায় শিরোনামে উঠে আসে তাদের মধ্যে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, দিল্লি, অন্ধ্রপ্রদেশ কিংবা কেরালার নাম করা যায়। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ভালো। আসুন দেখে নেওয়া যাক ২০২০ সালের নিরিখে ভারতে ধর্ষণের ঘটনায় শীর্ষে আছে কোন রাজ্য।
ধর্ষণে প্রথম যে রাজ্য:
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে ভারতে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়েছে রাজস্থানে।গোটা বছরে রাজস্থানে দায়ের হওয়া ধর্ষণ বা মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যাটা ৫৯৯৭, অর্থাৎ প্রায় ৬০০০। বলা বাহুল্য, এর বেশিরভাগই প্রচারে আসে নি।

ধর্ষণে দ্বিতীয় যে রাজ্য:
ধর্ষণের ঘটনায় দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে উত্তর প্রদেশের নাম। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ পরিচালিত এই রাজ্যে ২০২০ সালে মোট ৩০৬৫টি ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়েছে।

ধর্ষণের ঘটনায় মুখ পুড়েছে কোন রাজ্যের?
বস্তুত, পরিসংখ্যান অনুযায়ী ধর্ষণ কান্ডে রাজস্থান এগিয়ে থাকলেও গত কয়েক মাসে ধর্ষণের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি শিরোনামে উঠে এসেছে উত্তরপ্রদেশ। এ ব্যাপারে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ মন্তব্য করেছিলেন, “ধর্ষণ তো রাজস্থানেও হয়, উত্তরপ্রদেশেও হয়, তবে শুধু উত্তরপ্রদেশ নিয়েই এত শোরগোল কেন?” রাজস্থানে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় থাকায় নাম না করে বিরোধীদের এভাবে কটাক্ষ করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ধর্ষণের মতো পাশবিক ঘটনায় এ ধরণের রাজনীতির অনুপ্রবেশ কতটা কাম্য সে বিষয়ে তর্ক চলতে পারে কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রচারের সুবাদে ধর্ষণের ঘটনায় চলতি বছরে যে রাজ্যের মুখ পুড়েছে তা যে নিঃসন্দেহে উত্তরপ্রদেশ, তা বলাই বাহুল্য।

উত্তরপ্রদেশের কয়েকটি ধর্ষণ কান্ড যা সাড়া ফেলেছে:
চলতি বছরে গোটা ভারতকে তোলপাড় করে দিয়ে প্রকাশ্যে এসেছিল যে গণধর্ষণের ঘটনা তা ঘটে উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে। উত্তর প্রদেশের হাথরাস গ্রামে তথাকথিত নিম্ন বর্ণের তরুণীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া গণধর্ষণের ঘটনায় কিছুদিন আগে কার্যত উত্তাল হয়েছিল গোটা দেশ। ঘটনার প্রায় ১৫ দিন পর দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল মনীষা বাল্মীকি নামের বছর উনিশের ওই তরুণী। আর তারপরেই এই পৈশাচিক নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী। ৪ জন ধৃত অভিযুক্তের কঠোর, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন দেশের মান্য গণ্য ব্যক্তিবর্গ।

হাথরাসের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সামনে এসেছিল আরো এক ধর্ষণ। বলরামপুরের সেই ঘটনাতেও শিরোনামে উঠে এসেছিল যোগী রাজ্য। এক্ষেত্রে ২২ বছরের ছাত্রীকে গণধর্ষণের পর কোমর ভেঙে খুন করা হয়। ধর্ষণের অপরাধে কঠোর থেকে কঠোরতর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ঘোষণা করা হয় উত্তরপ্রদেশের সরকারের তরফে। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনা তাতে কমে না, বরং ক্রমশ যেন বেড়েই চলে। উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজস্থান কিংবা মধ্যপ্রদেশ থেকেও আসতে থাকে ধর্ষণের খবর। কিন্তু নৃশংসতায় যেন সকলকে ছাপিয়ে যায় উত্তরপ্রদেশ। এছাড়া, শুধু ধর্ষণই নয়, অন্যান্য অপরাধমূলক প্রবণতার দিক থেকেও গোটা দেশের মধ্যে শীর্ষে উত্তরপ্রদেশের নাম।

ধর্ষণের সমাধান কোথায়?
বস্তুত, ভারতবর্ষের মতো দেশে, সমীক্ষা অনুযায়ী যেখানে প্রতি পনেরো মিনিটে একটা করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, অর্থাৎ দৈনিক ধর্ষণের সংখ্যা প্রায় ১০০ ছুঁইছুঁই, সেখানে ধর্ষণ কান্ড আমাদের আর নতুন করে ভাবায় না। আমরা কেবল নৃশংসতার দৃষ্টান্তে আরো একবার শিহরিত হই মাত্র। যেমন শিহরিত হয়েছিলাম নির্ভয়া, পার্কস্ট্রিট, কাঠুয়া, মুম্বই কিংবা হায়দ্রাবাদ কান্ডে। যেমন শিহরিত হব আরো শত শত নাম না জানা ধর্ষণ কান্ডে। আর তারপরও গঙ্গা যমুনা দিয়ে একইভাবে বয়ে যাবে জল। কিন্তু এর সমাধান কোথায়? দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করা হয়ে থাকে বটে, কিন্তু যত দিন পর্যন্ত না পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিগড় ভারতীয় সমাজের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বিদায় নেবে, ততদিন ধর্ষণ কমার সম্ভাবনা নেই, সম্ভাবনা নেই ভারতীয় মেয়েদের নিরাপদে বেঁচে থাকার।
