পৃথা মহর্ষি ব্যাসের লেখা মহাভারতের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মহর্ষি ব্যাস বা ব্যাসদেবের লেখা মহাভারত সম্বন্ধে আমাদের অনেকেরই ধারণা আছে। অন্ততপক্ষে ঘটনাগুলি গল্পের আকারে ওপর ওপর আমাদের জানা। আমরা এই ধারণা নিয়েই বরং এগিয়ে চলি। ব্যাস রচিত মহাভারতের পরতে পরতে প্লটের যে মোচড় আছে তা সত্যিই অনন্য। এই মহাভারতেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পৃথা, থুড়ি কুন্তী।
পৃথা, ঠিক এই নামেই একটি অসামান্য গ্রন্থ আছে বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক কালকূট ওরফে সমরেশ বসুর। সেই গ্রন্থে তিনি খুব সুস্পষ্টভাবে পৃথার জীবন পথ বর্ণনা করেছেন। আমরা সেই পথ ধরে নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে আরো খানিকটা বিশ্লেষণ করবো মহাভারতের কিছু মিথ। এই বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরি বলে মনে হয়, কারণ কতগুলো ভুল ধারণার মধ্যে আমরা বসবাস করছি। আজ সেই সত্যিগুলি জানা খুব জরুরি। তবে তার আগে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের মতো জানিয়ে দেওয়া দরকার মহাভারত নিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত ধর্মীয় আবেগ থাকা খুবই স্বাভাবিক, আমরা সেই নিয়ে কোনো মন্তব্য করছি না।
কিন্তু মহাভারত যদি সত্যি ঘটনা হতো তাহলে মিথগুলির আড়ালে কোন সত্যি লুকিয়ে আছে সেটাই আমাদের খুঁজে দেখার বিষয়। তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই মহাকাব্যের বিভিন্ন চরিত্রের কার্যকলাপ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা অবশ্যই হওয়া জরুরী। অর্থাৎ আমরা ধরে নিচ্ছি পৃথা একটি বাস্তব চরিত্র এবং তার সঙ্গে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে তা সত্যি।
জন্ম:
পৃথার জন্ম হয়েছিল যাদব পরিবারে। তার জন্মদাতা পিতা শূরসেন ছিলেন অন্যতম একজন যাদব অধিপতি, বলা যায় যাদবদের একটি গোষ্ঠীর রাজা। পৃথার আপন ভাই ছিলেন বসুদেব। এই বসুদেবের পুত্র হলেন কৃষ্ণ ও বলরাম। তারমানে কৃষ্ণ-বলরামের আপন পিসি হলেন পৃথা।
রাজ পরিবারে জন্ম হলেও পৃথার জীবন খুব সরল পথে চলেনি। নিঃসন্তান অপর যাদব গোষ্ঠীপতি বা রাজা কুন্তী ভোজ তাকে দত্তক নেন। সেই সূত্রেই তিনি কুন্তী নামে পরিচিতি লাভ করেন। ছোট থেকেই কুন্তী খুব সেবাপরায়ণ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তার ফলে বিপত্নীক কুন্তীভোজের রাজ অন্দরমহল ওই ছোট্ট বালিকাটিই সামলে রাখত।
হল কি একদিন বিখ্যাত ঋষি দুর্বাসা মুনি কুন্তি ভোজ রাজ্যে আসলেন। একটুতেই রুষ্ট হয়ে অভিশাপ দেওয়া নিয়ে দুর্বাসার ‘কু’খ্যাতির কথা সবাই জানেন। তার ফলে এই ঋষির দেখভাল করা এবং সেবা করার দায়িত্বভার রাজা কুন্তি ভোজ কন্যার হাতেই অর্পণ করেন। কুন্তীর সেবাযত্নে সন্তুষ্ট হয়ে দুর্বাসা মুনি তাকে আশীর্বাদস্বরূপ বর দিতে চান। নাবালিকা কুন্তী ভেবে পায়না সে কি বর চাইবে। তখন দুর্বাসা তাকে আশীর্বাদ করে একটি মন্ত্র শিখিয়ে দেন। বলেন, “তুমি এই নির্দিষ্ট মন্ত্রটি যখনই নির্দিষ্ট দেবতার কথা মনে করে উচ্চারণ করবে তখনই সেই দেবতা এসে তোমার গর্ভে সন্তান দান করবেন!”
এই অদ্ভুত আশীর্বাদ পেয়ে স্বভাবতই নাবালিকা কন্যার তা প্রয়োগ করে দেখতে ইচ্ছে হয়। তিনি সূর্যদেবের কথা মনে করে মন্ত্রটি উচ্চারণ করেন এবং সূর্যদেব এসে আশীর্বাদস্বরূপ তার গর্ভে সন্তানের বীজ স্থাপন করেন। জন্ম হয় এক ফুটফুটে অসীম তেজস্বী সন্তানের, যে পড়ে কর্ণ নামে বিখ্যাত হয়!
ঠিক এখান থেকেই আমাদের ব্যাখ্যার শুরু। কারণ এই মিথটি সকলেরই জানা। হ্যাঁ, সচেতনভাবে ‘মিথ’ বললাম। আচ্ছা ভেবে বলুনতো সত্যিই কি আশীর্বাদ দিয়ে গর্ভ স্থাপন করা যায়? যায়না। তখনকার সমাজ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে কুন্তী অল্প বয়সের সারল্যে এবং স্বাভাবিক দৈহিক তাড়নায় হয়তো সূর্যদেব স্বরূপ এক তেজস্বী মানবের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু অবিবাহিতা অবস্থায় গর্ভবতী হয়ে পড়লে স্বাভাবিকভাবেই দুশ্চিন্তায় পড়েন তিনি। তাই প্রথম সন্তানের জন্ম হলে লোকলজ্জার ভয়ে তিনি তাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল।
বিবাহ:
কুন্তীর বিবাহ হয়েছিল হস্তিনাপুরের বিখ্যাত ভরত বংশীয় রাজা পান্ডুর সঙ্গে। মহাভারত খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লে দেখা যাবে জন্ম থেকেই পান্ডু শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন। সেই কারণেই হয়তো ছিলেন যৌননতায় অক্ষম। কিন্তু তখন রাজ-রাজড়াদের আমল, রাজার এই অক্ষমতার কথা চারিদিকে প্রচার হয়ে গেলে রাজ পরিবারের মান-সম্মান ধূলোয় মিশে যাবে। প্রজারা তাদের নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে।
স্বাভাবিকভাবেই রাজ খেয়ালে বিবাহ হয়ে গেল পান্ডুর। বিয়ে হল যাদব রাজ কুন্তী ভোজের পালিত কন্যা পৃথার সঙ্গে। এর কিছুদিন পর মদ্র রাজ্য জয় করে সেখানকার রাজকন্যা মাদ্রীকে বিবাহ করে নিয়ে ফিরে আসেন পান্ডু। অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন এই দুই সতিন পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে উঠবেন। কিন্তু পৃথা তার স্নেহ-মমতা দিয়ে মাদ্রীকে আপন করে নেন। তার ফলে পান্ডু দুই স্ত্রীকে নিয়ে সুখে সংসার করতে থাকেন।
সুখ! সত্যিই কি সুখ ছিল হস্তিনাপুর রাজার মনে? কারণ দুই স্ত্রী থাকা সত্বেও রাজার কোনো সন্তান হচ্ছে না, এই ঘটনা নিয়ে তখনকার জনসমাজে নিশ্চয়ই শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। যদিও এই ঘটনা বেদব্যাসের মহাভারতে আলাদা করে উল্লেখ করা নেই। কিন্তু সমাজ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বোঝাই যায় এটা হওয়াটাই বোধহয় স্বাভাবিক। অন্যদিকে বড় ভাই ধৃতরাষ্ট্রের সন্তান যদি আগে জন্ম লাভ করে তাহলে সিংহাসন তাদের দিকে চলে যাবে এই চিন্তা থাকাও পান্ডুর পক্ষে অস্বাভাবিক ছিল না।
কিছুদিন পর হস্তিনাপুর রাজ পান্ডু তার দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনে মৃগয়া গেলেন। সত্যিই কি মৃগয়ায় গিয়েছিলেন তিনি? নাকি তাঁর ঠিক যেভাবে জন্ম হয়েছিল সেই ‘নিয়োগ’ প্রথার মাধ্যমে নিজের দুই স্ত্রীকে গর্ভবতী করে লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন পান্ডু? পান্ডুর প্রকৃত জন্মদাতা মহর্ষি বেদব্যাস সম্ভবত এই বিষয়টিই আড়াল করে যেতে চেয়েছেন মহাভারতে। কারণ কেইবা চায় তার প্রিয়জনকে নিয়ে মানুষ হাসাহাসি করুক!
পান্ডু সম্ভবত কুন্তীকে আশীর্বাদস্বরূপ দুর্বাসা মুনির দান করা মন্ত্রের কথা জানতে পেরেছিলেন। ওই মন্ত্র উচ্চারণ করলে অর্থাৎ নির্দিষ্ট দেবতার তপস্যা করলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তিনি কুন্তীর কাছে এসে হাজির হতেন। বিভিন্ন পুরাণ এবং মহাভারতেরও অনেক জায়গায় দেখেছি দেবতারা একটুতেই কামার্ত হতেন। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ যৌনতা প্রাণীর স্বাভাবিক ধর্ম, সেখানে কুন্তীর মত একজন সুন্দরী নারীকে সামনে দেখে দেবতারা কেবলমাত্র পেট ছুঁয়ে চলে যাবেন এটা আসলে মোড়কের ওপরে রাখা ছলচাতুরি!
এমনিতেও মানুষ অতীতে যতটা যৌনতা নিয়ে খোলামেলা ছিল তা সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে। স্বভাবতই সেই মহাভারতের কালে স্বাভাবিক দৈহিক তাড়নায় কুন্তী একাধিক পুরুষের সঙ্গে সঙ্গম করে থাকতেই পারেন। বিশেষত নিজের স্বামী যখন অক্ষম। নিজের অক্ষমতার কথা পাঁচকান হয়ে যাক তা চাননি বোধহয় পান্ডু। তাই কুন্তী তিনজন ভিন্ন ভিন্ন পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার ঘটনায় কোনো আপত্তি করতে পারেননি তিনি। পরবর্তীতে সেই একই ধারা অনুসরণ করে তার দ্বিতীয় স্ত্রী গর্ভবতী হয়ে পড়েন।
তাহলে পান্ডুর মৃত্যু কি করে হলো? মহাভারতের ঘটনা ব্যাখ্যা করে আমরা মনে করতেই পারি নিজের স্ত্রীদের এই ভাবে সন্তান জন্ম দেওয়ার ঘটনার বিরোধিতা করতে না পারলেও মন থেকে তিনি হয়ত মেনে নিতে পারেননি। তাই মানসিক চাপে থাকতে থাকতে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে সম্ভবত হস্তিনাপুরের রাজা মারা গিয়েছিলেন। অথবা মানসিক স্থিতি হারিয়ে অক্ষমতা সত্বেও দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রীর সঙ্গে জোর করে সঙ্গম করতে গিয়ে মারা যান তিনি।
আমাদের বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং পুরাণের চরিত্র নিয়ে অদ্ভুত একটা মনোভাব আছে, যেমন খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক যীশুর জন্ম নিয়ে আমরা মনে করি যীশুর মা মেরি বা মরিয়ম ঈশ্বরের আশীর্বাদে যীশুর জন্ম দিয়েছিলেন। তিনি কোনো পুরুষের সঙ্গে সঙ্গম করেননি বলেই আমাদের বিশ্বাস। আসলে আমাদের আরাধ্য দেবতাদের যে যৌন জীবন থাকতে পারে এই বাস্তবটাই আমরা মেনে নিতে চাইনা। চাইনা কারণ তারাও যদি আমাদের মত খাওয়া-দাওয়া, হাসি-দুঃখ, যৌনতা নিয়ে মেতে থাকেন তাহলে larger than life ব্যাপারটাই তৈরি হয় না। আর এই larger than life ব্যাপারটা তৈরি না হলে কেউ দেবতা বা ঈশ্বর হয়ে উঠতে পারেন না! কারণ আমরা আসলে কল্পনার ভক্ত।
ঘটনাহলো মহাভারতের নায়ক পক্ষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত যুধিষ্ঠির অর্জুনের জন্মের ঘটনার সঙ্গে যদি দৈবিক যোগ স্থাপন না করা যায় তাহলে ব্যাপারটা ঠিক জমে না। তাহলে যুধিষ্ঠিরকে ধর্মপুত্র বলে মেনে নিতে আমাদের কোথাও একটা অসুবিধা তৈরি হয়! অর্জুনকে বিষ্ণুর অবতার বলে পরিচিত কৃষ্ণ এই যে এতো ভালোবাসতেন, সেটাও কোথাও আমাদের তখন হজম হয়ে উঠতো না! তাই তাদের জন্ম বৃত্তান্তকে মহাভারতের কবি ব্যাসদেব বোধহয় একটা অলৌকিকতার মোড়কে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন।
এই অলৌকিকতার মোড়ক দেওয়ার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো তথাকথিত যৌনতাকে অস্বীকার করতে চাওয়া। স্বামী অক্ষম হলেও মহিলাদের যৌন ইচ্ছা যে বিনষ্ট হয়ে যায় না, তা যে আহার প্রাতঃকৃত্যের মতোই স্বাভাবিক ঘটনা এটা মেনে নিতে ভারতীয় জনসমাজে তখনও অসুবিধা ছিল, এখনও অসুবিধা আছে। তাইতো কুন্তীকে পবিত্র দেখানোর এই এক অদম্য বাসনা আমাদের। অথচ পবিত্রতা সম্পূর্ণভাবে মনের বিষয়, তার সঙ্গে শরীরের কোনো সম্পর্ক নেই। একবার ভেবে দেখুনতো এই পবিত্রতার আরোপ কুন্তীর ওপর কতটা চাপ সৃষ্টি করেছিল? আজীবন তাকে একটা ভেক ধরে থাকতে হয়েছিল, এর যে কি যন্ত্রনা তা অনুভবী মন না থাকলে বোঝা সম্ভব নয়!
পরিশেষে বলব কুন্তীর যৌন জীবনকে মানসিকভাবে স্বীকার করে নিয়ে তাকে শ্রদ্ধা করার চেষ্টা করুন। দেখবেন কুন্তীর জ্বালা-যন্ত্রণাগুলো আরো বেশি করে বুঝতে পারছেন বুঝতে পারবেন। ভিন্ন ভিন্ন পুরুষের দ্বারা গর্ভবতী হয়ে সন্তানদের জন্ম দিলেও তাদের কারোর প্রতিই তিনি অবহেলা করেন নি। বরং সবাই ছিল তার কাছে সমান। এই সাম্য বোধ কিন্তু কোনো হেলাফেলার বিষয় নয়। তা চাইলেও সবাই রপ্ত করতে পারেন না। আর এই সাম্য বোধ যার মধ্যে থাকে তিনি সত্যিই গড়পড়তা মানুষের তুলনায় অনন্য হয়ে ওঠেন। তার মন সত্যিই পবিত্র পৃথিবীর কাছে!