নিজস্ব সংবাদদাতা: নির্বাচনী যুদ্ধে তাঁর প্রধান ২ প্রতিপক্ষের একজনের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আরেকজন শুভেন্দু অধিকারী। ফলত প্রায় সকলেই জানেন, এই নির্বাচনে তাঁর জেতার আশা তো নেই-ই, বরং দ্বিতীয় স্থানেও তিনি নাও থাকতে পারেন। তবু সিপিএমের তরুণ নেত্রী ৩৩ বছর বয়সি মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের নতুন তারকা হিসেবে অভাবনীয় ভাবেই উঠে এসেছেন। নন্দীগ্রামে তাঁর শান্ত অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রচারের ভিডিও ইতিমধ্যেই নেটমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি যাঁরা সে অর্থে বাম সমর্থক নন, তাঁরাও মিনাক্ষীর প্রতি একটা সমীহ দেখাচ্ছেন।

নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম শুভেন্দু অধিকারীর লড়াইয়ের চড়া সুরে বাঁধা কোলাহলের মধ্যেও যে ভাবে মিনাক্ষী নিজের উপস্থিতিকে স্পষ্ট করে তুললেন, তা এই সমীহের পিছনে সব থেকে বেশি পরিমাণে কাজ করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই হঠাৎ মাথাচাড়া দেওয়া জনপ্রিয়তার পিছনে এই বামনেত্রীর ব্যক্তিত্ব যতটা না কাজ করেছে, তার থেকেও যে বিষয়টি বেশি মাত্রায় কাজ করেছে, তা হল রাজ্য রাজনীতিতে তাঁর অস্তিত্ব। সে ভাবে দেখলে এই ‘বিষয়’টি হল ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে এ রাজ্যে বামশক্তির পুনরুত্থান-প্রচেষ্টার অঙ্গ হিসেবে উঠে আসা বেশ কিছু তরুণ মুখচ্ছবি।

রাজনৈতিক মহলের মতে, বামেরা এই নির্বাচনে এক নতুন কৌশল অবলম্বন করেন, যা অনেকের মতে এই ‘ইয়ুথ ফ্যাক্টর’। জানুয়ারি মাসে সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠকে স্থির হয়, তাদের প্রার্থীদের ৬০ শতাংশ হবেন ৪০ বছরের কম বয়সি এবং কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া কোথাওই যেন প্রার্থীর বয়স ষাটোর্ধ্ব না হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় ছাড়াও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেত্রী দীপ্সিতা ধরকে বালিতে, জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ঐশী ঘোষকে জামুরিয়ায়, এসএফআই-এর রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্যকে সিঙ্গুরে, এসএফআই সভাপতি প্রতিকুর রহমানকে ডায়মন্ড হারবারে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানোয় তা গণমাধ্যমের নজর কেড়েছে।

শুধু মাত্র তারুণ্যের কারণে এঁদের সঙ্গে পূর্বসূরীদের পার্থক্য, তা কিন্তু নয়। এঁদের অনেকেই এসেছেন খুব সাধারণ পরিবার থেকে। যেমন, নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের প্রার্থী ঝুনু বৈদ্য এক ভাগচাষি ঘরের সন্তান অথবা বর্ধমানের চণ্ডীচরণ লেটের বাবার একটা সাইকেল সারাইয়ের দোকান রয়েছে। যা দেখে রাজ্যের এক বৃদ্ধ বাম সমর্থকের বক্তব্য,, “দীর্ঘ দিন পরে দেখলাম, কমিউনিস্ট পার্টি কমিউনিস্ট প্রার্থীদেরই মনোনয়ন দিল।”

সিপিএম এ বার শুধুমাত্র তরুণ তুর্কিদের প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করায়নি, নির্বাচনী প্রচার ও অন্যান্য পরিকল্পনার দায়িত্বও তরুণদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে। গত কয়েক দশকের ভোটে বামেদের এই চিত্র একেবারেই দেখা যায়নি। বলা যেতে পারে, এর ফলে একটা খোলা হাওয়া দেখা দিয়েছে বাম-বাতাবরণে। সমাজমাধ্যমে বুদ্ধিদীপ্ত অথচ মজাদার মিম, নজরটানা ভিডিওর ক্রমাগত উপস্থাপন রাজ্যের নব্য প্রজন্মের একাংশকে নিঃসন্দেহে এ দিকে নজর দিতে বাধ্য করে। ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিগ্রেডের আগে চলতি হিট ‘টুম্পা সোনা’-র প্যারোডি পার্টির বয়স্ক কমরেডদের গণনাট্য-গণসঙ্গীতে অভ্যস্ত কানে কিছুটা ‘শক’ হিসেবে প্রতিভাত হয়। কিন্তু এটা অস্বীকার করা যাবে না যে ‘টুম্পা’-র এই প্যারোডি বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এবং বামেদের তরফে প্রার্থী তালিকা ঘোষণার আগেই যে এক ‘বদল’ যে আসছে, তা বোঝাতে সমর্থ হয়।

বাংলায় বামশক্তি আজ দুর্বলতম এবং রাতারাতি যে তাদের পুনরুজ্জীবনের কোনও সম্ভাবনা নেই, সেটাও পরিষ্কার। তবুও এখন যে সব তরুণ-তরুণীরা দলে যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের সামনে সুবিধাবাদ আর আখের গোছানোর রাস্তা আর খোলা নেই। বরং এক ধরনের আদর্শ আর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই তাঁরা দলে আসছেন। তাঁরা জানেন, নির্বাচনের এই লড়াই তাদের প্রথম পদক্ষেপ মাত্র, এর পরে সামনে পড়ে দীর্ঘ যাত্রাপথ। এই নির্বাচন বৃহত্তর এক সংগ্রামের সূচনা মাত্র। এখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি।