১৭ এপ্রিল পঞ্চম দফার ভোট পশ্চিমবঙ্গে। এই দফায় রাজ্যের ৪৫ টি কেন্দ্রে নির্বাচন হবে। ভোটের গাড়ি এই দফায় প্রথম প্রবেশ করবে নদিয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বর্ধমান পূর্ব, দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলায়। অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গ মিলিয়ে বেশ জমজমাট ভোটের লড়াই। রাজনৈতিক সমীকরণের দিকে লক্ষ্য রাখলে অনেক বিচিত্র চিত্র উঠে আসবে পঞ্চম দফায়। কোথাও বিজেপি পাকাপোক্ত ঘাঁটি তৈরি করে ফেলেছে, আবার কোন‌ও জায়গায় তৃণমূলের গড় অটুট। এই দুই প্রবল প্রতিপক্ষের ফাঁক দিয়ে নির্বাচনী ময়দানে কোথাও কোথাও সংযুক্ত মোর্চার জন্য বেশ ভালই জমি চাষ হয়েছে।

পঞ্চম দফার ভোটে তিন পক্ষ মিলিয়ে যে সমস্ত প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তাদের মধ্যে অনেকেই রাজ্য রাজনীতিতে যথেষ্ট হেভিওয়েট হিসেবে পরিচিত। তাই এই দফায় শুধুমাত্র বিনোদন জগতের তারকারা নয়, অনেক সময় রাজনীতিবিদরাও তারা হিসেবে উঠে এসেছেন। আমরা এই দফার ভোটে প্রধান পাঁচ তারকা প্রার্থীর ওপর নজর রাখব।


১) ব্রাত্য বসু-

কলকাতা লাগোয়া উত্তর চব্বিশ পরগনার দমদম কেন্দ্রের বিধায়ক ব্রাত্য বসু। ২০১১ সাল থেকেই তিনি এই কেন্দ্রের বিধায়ক। তৃণমূল সরকারে প্রথমে শিক্ষা মন্ত্রী হয়েছিলেন এই নাট্যকার। পরবর্তীকালে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। তবে ব্রাত্য বসু বর্তমানে শুধুমাত্র বাংলা নাটকের তারকা নন, তিনি রাজ্য রাজনীতির‌ও অন্যতম তারকায় পরিণত হয়েছেন।

২০১৯ এর লোকসভা ভোটের পর তৃণমূলের অন্যতম দলীয় মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করছেন ব্রাত্য। সেই সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম প্রধান মুখ তিনি। যদিও এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বেশ চাপে এই তারকা প্রার্থী। তার নিজের দল তৃণমূলের ভিতরে একের পর এক গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ঘটনা সামাল দিতে গিয়ে তিনি রীতিমতো হিমশিম খেয়েছেন। তার একসময়ের ভোট ম্যানেজার হিসেবে পরিচিত প্রবীর পাল ওরফে কেটি দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত দলত্যাগ না করলেও তাকে খুব একটা সক্রিয় ভূমিকায় ময়দানে দেখা যাচ্ছে না। উল্টোদিকে সিপিআই(এম) প্রার্থী পলাশ দাস এই এলাকার যথেষ্ট পরিচিত মুখ। সেইসঙ্গে বিজেপি প্রার্থী করেছে আর এক পরিচিত মুখ অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দকে। তাই তৃণমূলের তারকা প্রার্থী ব্রাত্য বসুকে এবার হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে পঞ্চম দফার ভোটে।


২) অশোক ভট্টাচার্য-

শিলিগুড়ি এবং অশোক ভট্টাচার্য প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছে। বামফ্রন্ট আমলে উত্তর বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। তৃণমূলের ঝড় থামিয়ে দিয়ে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মহাজোটের প্রথম সফল প্রয়োগ শিলিগুড়িতে করেছিলেন এই সিপিআই(এম) নেতা। এবারের‌ও নিজের গড় শিলিগুড়ি ধরে রাখার লড়াই লড়ছেন অশোকবাবু।

তবে বিধানসভা ভোটের প্রার্থী ঘোষণার ঠিক আগে অশোক ভট্টাচার্যের ডানহাত হিসেবে পরিচিত শিলিগুড়ির তরুণ প্রজন্মের সিপিআই(এম) নেতা শঙ্কর ঘোষ বিজেপিতে যোগদেন। গেরুয়া শিবিরের পক্ষ থেকে তিনিই এখানে প্রার্থী হয়েছেন। তাই কিছুটা হলেও হয়ত চাপে পড়তে পারেন অশোক ভট্টাচার্য। অন্যদিকে তৃণমূল প্রার্থী করেছে রাজ্য রাজনীতির পরিচিত মুখ ওমপ্রকাশ মিশ্রকে। কিন্তু বহিরাগত তকমা এবং প্রার্থীকে ঘিরে তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে এই কেন্দ্রের লড়াই থেকে জোড়া ফুল শিবির একরকম ছিটকে গিয়েছে। তবে সব মিলিয়ে বলা যায় পঞ্চম দফার ভোটে শিলিগুড়িতে অ্যাডভান্টেজ অশোক ভট্টাচার্য।


৩) অদিতি মুন্সি-

বাংলা কীর্তনকে নতুন করে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছেন অদিতি মুন্সি। তাকেই এবার উত্তর চব্বিশ পরগনার রাজারহাট-গোপালপুর কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। অবশ্য তাঁর আরেকটি পরিচয় আছে। উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি দেবরাজ চক্রবর্তী তার স্বামী। পারিবারিক প্লাস পয়েন্টের ওপর ভর করে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন অদিতি।

তারকা প্রার্থী অদিতি মুন্সির প্রতিদ্বন্দী অবশ্য রাজ্য রাজনীতির অন্যতম তারকা। রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য রাজারহাট-গোপালপুর কেন্দ্রে অদিতি মুন্সির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাই বলা যেতে পারে উত্তর চব্বিশ পরগনার রাজারহাট-গোপালপুর কেন্দ্র এবারের বিধানসভা ভোটে রাজ্যের অন্যতম তারকাখচিত আসন। নির্বাচনী লড়াইয়ে এই কেন্দ্রে তৃণমূল এবং বিজেপি একে অপরকে কড়া টক্কর দিলেও কিছুটা বোধহয় এগিয়ে আছেন শমীক ভট্টাচার্য।


৪) চিরঞ্জিত চক্রবর্তী-

বাংলা সিনেমার একসময়ের সুপারস্টার চিরঞ্জিত চক্রবর্তী এই নিয়ে তৃতীয় বার প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে চলেছেন উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাত কেন্দ্রে। তিনি এখানকার দুবারের বিধায়ক হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এলাকাবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ যথেষ্ট ভালো। এখানে তৃণমূলের অভ্যন্তরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সেভাবে নেই। আর চিরঞ্জিত যেখান থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন সেই কেন্দ্রটি তারকাখচিত হবে না তা কখনও হতে পারে না।

চিরঞ্জিতকে অবশ্য এইবার তৃণমূলের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়ার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে সংযুক্ত মোর্চার পক্ষ থেকে ফরওয়ার্ড ব্লক এই কেন্দ্রের প্রার্থী করেছে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়কে। এলাকাবাসীর কাছে তিনি কাছের মানুষ, কাজের মানুষ হিসেবে পরিচিত। করোনার কারণে লকডাউনের সময় সঞ্জীববাবুকে প্রতিমুহূর্তে এলাকার মানুষজনের পাশে দেখা গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আগের দুবারের থেকে এবারে বেশ কিছুটা কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হচ্ছে চিরঞ্জিতকে।


৫) মদন মিত্র-

বাংলার রাজনীতির ময়দানে মদন মিত্রের ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মা আচ্ছা আচ্ছা রুপোলি পর্দার তারকাকে লজ্জায় ফেলে দিতে পারে। উত্তর চব্বিশ পরগনার কামারহাটি কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে আবারও ভোট ময়দানে নেমেছেন মদন। এই কেন্দ্রের তিনি প্রাক্তন বিধায়ক। যদিও ২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে জেলবন্দি অবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কামারহাটিতে সিপিআই(এম) এর মানস মুখার্জির কাছে তিনি হেরে গিয়েছিলেন।

কামারহাটি কেন্দ্রে মদন মিত্রের নিজস্ব একটা জনপ্রিয়তা আছে। এর পাশাপাশি তৃণমূলের দলীয় সংগঠনের ফলে করে বেশ ভালো জায়গায় আছেন তিনি। কিন্তু তা বলে যদি ভাবা যায় মদন মিত্রের জয় একেবারে নিশ্চিত তাহলে খুব ভুল হবে। কারণ কামারহাটি কেন্দ্রে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন সংযুক্ত মোর্চার পক্ষ থেকে সিপিআই(এম) এর প্রার্থী সায়নদ্বীপ মিত্র। ডিওয়াইএফআই এর রাজ্য সম্পাদক হিসেবে এমনিতেই পরিচিত মুখ সায়নদ্বীপ। এর পাশাপাশি লকডাউনের সময় থেকে এলাকাবাসীর পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাওয়ায় যথেষ্ট জনপ্রিয় এই তরুণ বামপন্থী নেতা। তাই মদন মিত্রকে হারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন তিনি। তবে এই দুই পরিচিত মুখের বিরুদ্ধে রাজ্য রাজনীতি আর এক পরিচিত মুখকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মফুল শিবিরের হয়ে এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। যদিও মদন মিত্র ও সায়নদ্বীপের দ্বিমুখী লড়াইয়ের তিনি খুব একটা পাত্তা পাবেন বলে মনে হয় না।


আমরা পঞ্চম দফার ভোটের তারকা প্রার্থী হিসেবে পাঁচজনের নাম বেছে নিলাম। কিন্তু এই তালিকা বোধহয় আরও অনেকটা লম্বা করা গেলে সুবিধে হত। কারণ এই দফাতেই ভোট হবে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কলকাতা লাগোয়া বরানগর কেন্দ্রে। সেখানে বিজেপির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন টলিউড অভিনেত্রী পার্নো মিত্র। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যের অন্যতম তারকা প্রার্থী হিসেবে তার নাম বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু মাত্র পাঁচ জনের তালিকা তৈরি করতে হ‌ওয়ায় পার্নোর নামটা মূল তালিকায় রাখা যায়নি। যদিও পঞ্চম দফার নির্বাচনে তিনি অন্যতম প্রধান তারকা প্রার্থী।

আরও লম্বা পঞ্চম দফার নির্বাচনের তারকা প্রার্থীর তালিকাটা। নদীয়া জেলার রানাঘাট উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন রাজ্য রাজনীতির অন্যতম তারকা মুখ শঙ্কর সিং। তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে এই প্রথম ভোটে লড়বেন তিনি। এর পাশাপাশি জলপাইগুড়ি সদর কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী সুখবিলাস বর্মা ভোটের ময়দানে অন্যতম তারকা। তিনি একসময় আমলা ছিলেন। অবসর পরবর্তী জীবনে ভাটিয়ালি গান গেয়ে রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন সর্বত্র।

দ্বিতীয় কলকাতা হিসেবে পরিচিত সল্টলেক যে কেন্দ্রের অন্তর্গত সেই বিধান নগরে যুযুধান দুই শিবিরের প্রার্থী হলেন রাজ্য রাজনীতির অন্যতম তারকা। তৃণমূলের প্রতীকে এখান থেকে লড়ছেন সুজিত বসু। আবার বিজেপি এই কেন্দ্রের প্রার্থী করেছে সব্যসাচী দত্তকে সব মিলিয়ে বলা যায় পঞ্চম দফার নির্বাচন তারকায় ছড়াছড়ি