আগামী ২১ শে মার্চ, ভারতবর্ষে সম্ভবত এই প্রথম বিশেষভাবে সক্ষমদের আসন সংরক্ষণের দাবিতে জেলাশাসকের মাধ্যমে কোচবিহারের একটি বিশেষ rally-র হাত ধরে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চলেছে citizen’s forum for pwd। এক ঐতিহাসিক দিন কি আগত?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মানবাধিকারের ধারণা প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৪৮ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। এর পর থেকেই বিভিন্ন রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার সুরক্ষিত করার নীতি আনুসরণ করে। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়।
বিশেষভাবে সক্ষম মানুষেরাও ভারতের নাগরিক। তাদের আর্থ-সামাজিক অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য বহু কল্যাণমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে এক্ষেত্রে সরকার বিশেষ দৃষ্টি দেয়। প্রণয়ন করা হয় প্রতিবন্ধি আইন ১৯৯৫। এই আইনের বলে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের অধিকার প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন ও সমস্ত ক্ষেত্রে সার্বিক অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব, শিক্ষার প্রসার, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের ইতিবাচক ভূমিকা বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের প্রতি সাধারণ মানুষের ধ্যানধারণার পরিবর্তনের ফলে এক অংশের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ আর্থ-সামাজিক দিক থেকে যথেষ্ট উৎকর্ষতা লাভ করেছে। তবে পরিতাপের বিষয় বৃহৎ অংশের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ রয়েছে দারিদ্র ও অশিক্ষার অন্ধকারে। একবিংশ শতাব্দীতে বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ তাদের প্রতিবন্ধকতা জয় করতে সক্ষম হয়েছে। তারা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধূলা, গবেষণা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারতকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দিতে নিরলশ পরিশ্রম করছে।
গভীর অন্তদৃষ্টি দিয়ে দেখলে এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার ভারতীয় সংবিধানের ১৪ থেকে ৩২ নং ধারায় নাগরিকদের জন্য যে ছয়টি মৌলিক অধিকার রয়েছে এই অধিকারের মাধ্যমে প্রধানত রাজনৈতিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ এই অধিকারভোগের ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি বঞ্চিত। আইন সভায় তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। আইন সভার সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটাধিকার ভোগ করলেও আইনসভায় প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হতে পারছে না। এক্ষেত্রে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলির বিশেষভাবে সক্ষম মানুষের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই দায়ী।
পূর্নাঙ্গ রাজনৈতিক অধিকার অর্জন করার জন্য আত্মসচেতন বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের মধ্য থেকে আইনসভা ও সায়ত্বশাসন সংস্থাগুলিতে বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য আসন সংরক্ষণের দাবি উঠছে। এই সমস্ত মানুষদের রাজনৈতিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে গেলে আসন সংরক্ষণ অপরিহার্য। সংরিক্ষত আসন থাকলে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দিতে বাধ্য হবে।
এই দাবি যুক্তিসঙ্গত ও সংবিধান সম্মতও বটে। আইন সভায় যদি বিশেষভাবে সক্ষমদের কোনো প্রতিনিধি না থাকে তাহলে তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা, অভাব, অভিযোগ আইন সভায় তুলে ধরবে কে? একজন প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ একজন প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের সমস্যা সবথেকে ভালো অনুধাবন করতে পারবে এটাই স্বাভাবিক। সমাজবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী বিশেষভাবে সক্ষমদের দাবি একদিন পুরোন হবেই।
আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে এই দাবির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বিগত শতাব্দীতে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছিল অনুন্নত। সেই তুলনায় একবিংশ শতাব্দীতে এই অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আর্থ-সামাজিক এই বিশেষ অবস্থা বিশেষভাবে সক্ষম মানুষের মনে পূর্নাঙ্গ রাজনৈতিক ভোগের স্পৃহা জাগাচ্ছে। বিশেষভাবে সক্ষম মানুষেরও সৃজনশীল চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে। তাদের ব্যক্তিত্ব নেতৃত্ব দক্ষতা বিচক্ষণতার সাহায্যে তারাও দেশ সেবা করতে পারে।
ভারতীয় সংবিধান পরোক্ষ সংসদীয় গণতন্ত্র গ্রহণ করেছে। এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। জনপ্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। এই পরিস্থিতিতে বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের আসন সংরক্ষণ ছাড়া বিকল্প কোনো রাস্তা নেই।
চলার পথেই এমন কিছু জটিল সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে যা অপ্রতিবন্ধি মানুষ তা উপলব্ধি করতে সক্ষম নাও হতে পারে। গত সত্তর বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস এই সত্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলির চরম অনীহা রয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের সাহায্য ছাড়া বিশেষভাবে সক্ষম নাগরিকদের নির্দল প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হওয়া দুরুহ ব্যাপার। এই অবস্থায় বিশেষভাবে সক্ষম নাগরিকদের জন্য আসন সংরক্ষণ অপরিহার্য।
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতে দুই কোটি আটষট্টি লক্ষ বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ রয়েছে। ২০১৬ সালের প্রতিবন্ধি আইনে প্রতিবন্ধকতার সংখ্যা সাত থেকে বাড়িয়ে একুশ করা হয়েছে। এর ফলে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ পূর্নাঙ্গ রাজনৈতিক অধিকার থেকে যদি বঞ্চিত হয় তাহলে গণতন্ত্রের ভিত দুর্বল হয়ে পড়বে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বৃহত্তর স্বার্থে রক্ষণশীল মানসিকতা, সংকীর্ণ স্বার্থ পরিত্যাগ করে এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
৭৫ তম স্বাধীনতার বর্ষে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলি এই বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ পূর্নাঙ্গ রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করবে এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।