বোস্টন টি পার্টি
NPR

বোস্টন টি পার্টি:-

নিঝুম রাত্রি। ঘুমে নিস্তেজ সমস্ত বোস্টন বন্দর। বন্দরের উত্তর পয়েন্টে সারি সারি করে নোঙর ফেলা ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজগুলিও যেন ঘুমিয়ে। সুদূর এশিয়া থেকে বেশ কয়েক টন চা বোঝাই করে নিয়ে এসে তারাও ক্লান্ত। পূর্ণ জ্যোৎস্নায় চায়ের বস্তাগুলো চক চক করছে।
হঠাতই প্রায় শ’খানেক তরুণ হানা দিল সে জাহাজে। ধীরে ধীরে

এগিয়ে গেল চায়ের বস্তাগুলোর দিকে। একটা একটা করে বস্তা নিক্ষেপ করল ঘুমন্ত আটলান্টিক মহাসাগরের জলে। একটা একটা করে বস্তা টুপ টুপ করে ডুবে যেতে থাকল কালো অতল জলে। সবাই মত্ত এই বিশাল ও ধ্বংসাত্মক কর্মযজ্ঞে। ঝুপঝাপ শব্দে জেগে উঠেছে পাশের জাহাজের নাবিকেরাও।চুপ করে দেখছে তারা। কিন্তু সবাই চুপ করে দেখলেও, মুখে টুঁ শব্দটি করল না। যদি কিছু বলতে গেলে তাদের জাহাজেও এই তাণ্ডব শুরু হয়। এক এক করে ৩৪২ বস্তা চা সমুদ্রে ফেলল তারা দুই ঘণ্টায়। প্রায় ৪৬ টন চা এর সেদিন সলিল সমাধি ঘটেছিল। তৎকালীন সময়ে যার বাজার দর ছিল, প্রায় ১০ হাজার পাউণ্ড। পৃথিবীর ইতিহাসে সেদিনের এই ঘটনাকে ‘বোস্টন টি পার্টি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ‘বোস্টন টি পার্টি’ ছিল বোস্টনে ‘সন্স অব লিবার্টি’দের একটি রাজনৈতিক প্রতিবাদ
দিনটা ছিল ১৬ই ডিসেম্বর, ১৭৭৩।

youtube

কেন এমন ঘটল?

অষ্টাদশ শতাব্দীর পৃথিবীতে ব্রিটিশদের আধিপত্য ছিল ব্যাপক। সর্বত্র ব্যবসার উদ্দেশ্যে এদের ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির তত্ত্বাবধানে উপনিবেশগুলোতে আরোপ করা হতো নানা রকম কর। ১৭৬৭ সালে নিত্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসের সাথে চায়ের উপরও কর আরোপ করে তারা। ফলে উপনিবেশগুলোর স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়লো। কিন্তু ব্রিটিশদের ওদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। উত্তর আমেরিকাও এই করের আওতায় ছিল।  ১৭৭০ সালের ৫ মার্চ বোস্টন রাজস্ব বিভাগের সামনে আমেরিকানদের সাথে ব্রিটিশ সৈনিকরা কর আদায়ের ইস্যুকে কেন্দ্র করে কয়েক দফা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে ব্রিটিশরা উত্তেজিত ব্যবসায়ীদের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করলে প্রায় ৫ জন নিহত হয়। আহত হয় ৬ জন। যা বোস্টন গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়। ফলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।

চা আইন এবং সন্স অফ লিবার্টি:-

ব্রিটিশ সরকার ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ এবং চাপের মুখে পড়ে ১৭৬৭ সালে প্রণীত কর নীতি বাতিল ঘোষণা করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং কাগজের উপর কর বাতিল করলেও আমেরিকানদের চায়ের উপর কর দিতে হবে বলে নতুন আইন প্রণয়ন করেছিল।

চা ব্যবসায়ীরা এই সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ ছিল। প্রতিবাদস্বরূপ ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে বর্জন করে ডাচ কোম্পানি থেকে চা অবৈধভাবে পাচার করা শুরু করেছিল। ফলে ব্রিটিশ কোম্পানি মহাবিপাকে পড়েছিল।

এরই মধ্যে ১৭৭৩ সালে “চা আইন” অনুযায়ী ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে শুল্কমুক্ত চা বিক্রি করার অধিকার প্রদান করা হলেও উপনিবেশের ব্যবসায়ীদের কর প্রদান করতেই হতো। কর প্রদান করার পূর্বে বন্দরে চায়ের বস্তা নামানোর অনুমতি
মিলতো না।

বোস্টন টি পার্টি
Slide share


ব্রিটিশদের ধারণা ছিল চায়ের স্বাদ উপভোগ করবার জন্য আমেরিকানরা চায়ের কর প্রদান করবেই। তাই নিয়মমতো চা বোঝাই করা জাহাজ ফিলাডেলফিয়া এবং নিউইয়র্ক বন্দরে ভিড়তে থাকে।


কিন্তু ব্যবসায়ীরা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। তারা কর প্রদান করতে অস্বীকার করলে বন্দরে চা বোঝাই করা বেশ কয়েকটি জাহাজ আটকে পড়ে থাকে। বোস্টন বন্দরেও তিনটি চা বোঝাই করা জাহাজ পাঠানো হয়।

বোস্টন টি পার্টি
slideserve


এই ঘটনায় বোস্টনের ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রায় ৭ হাজার বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ী বোস্টনে প্রতিবাদ সভায় অংশ নেয়। ঠিক তখন বোস্টনে ‘সন্স অফ লিবার্টি’ নামক একটি দলের আবির্ভাব ঘটে। ঔপনিবেশিক ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত সেই সংগঠনটি স্টাম্প আইন এবং চা আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে।
এই গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে বেনেডিক্ট আরনল্ড, পেট্রিক হেনরি, পল রিভিয়ার, হ্যানকক প্রমুখ রাজনীতিবিদ ছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর দিনে হাজার ব্যবসায়ী সদস্যদের নিয়ে তারা সমাবেশ আয়োজন করে এবং একটি গণভোটের আয়োজন করে। গণভোটে ব্যবসায়ীরা কর প্রদানের বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করে। কিন্তু গভর্নর থমাস হাচিসন তাদের দাবি মানতে নারাজ। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, “কর না দিলে একটি জাহাজ থেকেও চা বোস্টনে নামবে না।” roar media

https://www.google.com/url?sa=t&source=web&rct=j&url=https://roar.media/bangla/main/history/boston-tea-party-brief-history-of-a-movement-that-made-americans-rise-for-their-independence/amp&ved=2ahUKEwj_zb2R39HtAhVOWysKHaLkCsoQFjABegQIAhAB&usg=AOvVaw0H8N0p693_Ap3t-kUQ3KcE

বোস্টন টি পার্টির অভিজ্ঞতা:-

এই বোস্টন টি পার্টির রাতের ঘটনা বর্ননা করেন, জর্জ জেমস হক্স নামক এক আন্দোলনকারী, “আমাদের কমাণ্ডার নির্দেশ দিলেন যেন আমরা বস্তাগুলো খুলে চা নিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেই। আমরা আদেশ পাওয়া মাত্র কাজে লেগে গেলাম। একে একে সবগুলো বস্তা খালি হয়ে গেলো। আমাদের জাহাজটি ব্রিটিশদের সামরিক জাহাজ দ্বারা ঘেরাও করা ছিল। কিন্তু সেদিন তারা আমাদের একবারও থামাতে আসেনি। তাদের সেই সাহস ছিল না।”

বোস্টনের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিলো টন টন চা। এই ঘটনায় আমেরিকান রাজনীতিবিদদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়। মাত্র একজন গ্রেফতার হয়। এটাই বোস্টন টি পার্টির ট্রাজেডি।

বোস্টন টি পার্টির পরের ঘটনা:-

বোস্টন টি পার্টির ঘটনার পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক আইন পাশ করেন। এর মাধ্যমে চায়ের ক্ষতিপূরণ আদায়ের পূর্ব পর্যন্ত বোস্টন বন্দর বন্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়। আমেরিকানরা ব্রিটিশদের এই সিদ্ধান্তে হতবাক হয়ে যায়। কিন্তু তারাও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। ১৭৭৪ সালের মার্চ মাসে তারা দ্বিতীয়বারের মতো টি পার্টি আন্দোলন শুরু করে। এবার ৬০ জন আন্দোলনকারীর সাহায্যে ফরচুন নামক একটি জাহাজের প্রায় ৩০ বস্তা চা পানিতে ফেলে দেয়া হয়। বোস্টনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিউইয়র্কেও টি পার্টি আন্দোলন শুরু হয়।

বোস্টন টি পার্টির পর সিদ্ধান্ত:-

১৭৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশ থেকে প্রতিনিধিরা একত্রিত হয়ে আলোচনায় বসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন:-
১. অবিলম্বে এই আইন বাতিল করে বোস্টন বন্দরের কাজ শুরু করতে হবে।
২.সকল ব্রিটিশ পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
৩. আমেরিকা মহাদেশের সকল উপনিবেশকে স্বায়ত্ত্বশাসিত ঘোষণা করা হয়।
৪. উপনিবেশের স্থানীয় সৈনিকদের নিয়ে স্বতন্ত্র সেনাবাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বোস্টনের একশ’ আন্দোলনকারীর ‘টি পার্টি’ রূপ নেয় গণমানুষের স্বাধীনতা যুদ্ধে। ‘বোস্টন টি পার্টি’ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, নিপীড়িত জনগণের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একশ’ মানুষের সাহসী পদক্ষেপের ফলে পরবর্তীতে শুরু হয় এক স্বাধীনতা সংগ্রাম। আর এর ফলে জন্ম নেয় নতুন দেশ যুক্তরাষ্ট্র।