দীর্ঘ ৩৪ বছর বাংলার শাসনের মসনদে আসীন দলটার যবনিকাপতনের যে সূচনা হয়েছিল ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে, তা আরও প্রকট রূপ ধারণ করে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি তে বামদূর্গের কেবল পতন হয়নি_ এক কথায় আজ তা ধূলিসাৎ। তা হলে কি বলা চলে সিপিএম আজ অপ্রাসঙ্গিক? ব্যালট বক্সের অঙ্ক তো তাই-ই বলছে। দেখে নেওয়া যাক এর পিছনে দায়ী পাঁচটি ফ্যাক্টর।
আদর্শ বিচ্যুতিঃ
কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক পদক্ষেপ নির্ধারিত হয় শ্রেণিচরিত্রের নিরিখে। সে ক্ষেত্রে বঙ্গ নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের সাথে জোটবদ্ধ হওয়া নিশ্চিত পক্ষেই গুরতর আদর্শ বিচ্যুতি। সিপিএম এর বঙ্গ নেতৃত্ব বারবার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে উদ্দেশ্যে এই জোট কে তুলে ধরতে চাইলেও ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব।১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধের সময় বামপন্থীদের একাংশকে ‘চিনপন্থী’ আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার কিংবা ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের কন্ঠরোধের পুরোধা ছিল যেই কংগ্রেস দল_ তাদের ‘হাত’ ধরে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্লোগান আদর্শ বিচ্যুতি ছাড়া আর কি?
জমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গঃ
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মঞ্চে সিপিএম এর বিদায়ী ঘণ্টা বাজিয়েছিল সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণ বিবাদ। যে জমিগ্রহণ বিলটিকে কেন্দ্র করে এই কর্মসূচি শুরু হয় তা ছিল প্রকৃতপক্ষে অগণতান্ত্রিক। সিঙ্গুরে কৃষকদের উপর পুলিশি অত্যাচার, গুলি চালনা,তাপসী মালিক হত্যাকাণ্ড-র মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দেশব্যাপী জনগণের উপর যে বিরূপ প্রভাব ফেলে তার সামনে সিপিএমের শিল্পায়নের যুক্তি মুখ থুবড়ে পরে।এর ফলাফল ২০১১র বিধানসভা ভোটে প্রকট ভাবে ফুটে ওঠে। এর ফলে যে গ্রহণযোগ্যতা তারা একবার হারিয়েছে তা ফিরে পাওয়া এক কথায় প্রায় অসম্ভব
একচেটিয়া আধিপত্যঃ
দীর্ঘ ৩৪বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে রাজ্য রাজনীতিতে সিপিএমের যে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় তার ফলে স্থানীয় স্তরের নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ অঞ্চলের কার্যত হর্তাকর্তা বিধাতা হয়ে উঠেছিল। ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজন পোষণের মতোন ঘটনা সরকারি নিয়োগ থেকে শুরু করে আমজনতার দৈনন্দিন জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করতে শুরু করে। বামজমানায় গণতন্ত্রের বিকৃতি যে চরম আকার ধারণ করেছিল তা এখনও মানুষ ভোলেনি। তাই বিরোধী দল হিসেবে শাসক শ্রেণীর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাদের বিরোধিতা ও সমালোচনা আমজনতার কাছে আর কোনো দাম রাখেনা।
রাজ্য নেতৃত্বে নতুন মুখের অভাবঃ
যুব সমাজের অংশগ্রহণ প্রাসঙ্গিকতার নিশ্চিত পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। সিপিএমের রাজ্য কমিটিতে নতুন মুখের অভাব বারবার দলের রক্ষণশীল মানসিকতার পরিচায়ক। প্রেসিডেন্সী বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোন রাজ্যের সেরা দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদে কিন্তু এখনও বাম রাজনীতির জয়জয়কার। কিন্তু রাজ্য নেতৃত্বে কিন্তু বহুদিন কোনো নতুন মুখ উঠে আসেনি। দলীয় এই রক্ষণশীলতাই কিন্তু অপ্রাসঙ্গিকতার এক মস্ত বড়ো কারণ।
তত্ত্বকথার বাহুল্যঃ
নিশ্চিতভাবেই মার্ক্সিজমের যেকোনো দেশে, যে কোনো সময়ে, যে কোনো ভাবেই প্রযোজ্য। কিন্তু শ্রেণিসংগ্রাম,ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, উদবৃত্ত মূল্যের তত্ত্বের মতো জটিলতা বহুল ধারণা এই প্রেক্ষাপটে কার্যত অবাস্তব। বাংলার গ্রামীণ এক কৃষকের কাছে ভিয়েতনামের মুক্তি যুদ্ধের কথা কোনো দাম রাখেনা। চিনের প্রেসিডেন্ট কেন আমার প্রেসিডেন্ট তা বোঝার মতোন প্রয়োজন ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালির নেই। এই তত্ত্ববহুল রাজনীতি শিক্ষিত মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী সমাজের কাছে পাথেয় হলেও আমজনতার কাছে তা অপ্রাসঙ্গ
তাই বলা চলে,সিপিএম আজ বহুলাংশেই অপ্রাসঙ্গিকতায় ভুগছে। প্রাসঙ্গিকতায় ফিরতে প্রয়োজন একাধিক সংশোধন, তা হলেই হয়তো আবার পলাশ ফুটলে দিন বদলের স্বপ্ন দেখা যেতে পারে।