স্বাধীনতাসংগ্রামী শ্রী সুশীল দাসগুপ্ত
স্বাধীনতাসংগ্রামী শ্রী সুশীল দাসগুপ্ত
,
স্বাধীনতাসংগ্রামী শ্রী সুশীল দাসগুপ্ত

১৭ই আগষ্ট ১৯৩২ । সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে একটা জাহাজ এসে ভিড়লো পোর্ট ব্লেয়ার জাহাজ ঘাটায়। ডান্ডাবেড়ি লাগিয়ে নামিয়ে আনা হলো একদল তরুণ স্বাধীনতাসংগ্রামী কে। শাসকের বয়ানে এরা ছিলেন বিপজ্জনক কয়েদী। দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে সেদিন তাঁরা তুলে নিয়েছিলেন হাতিয়ার। পশুর মতো হাঁটিয়ে এনাদের নিয়ে যাওয়া হলো সেলুলার জেলে। দিনের আলো নিভে যাচ্ছে তখন, বিশাল লোহার দরজা পেরিয়ে ঢুকলেন তাঁরা কারা অভ্যন্তরে। চোখের সামনে দেখতে পেলেন ধরিত্রীর বুকে একটুকরো নরক !নতুন বন্দীদের সাথে সেদিন এসেছিলেন বছর বাইশের এক তরুণ স্বাধীনতাসংগ্রামী সুশীল দাশগুপ্ত।

বয়স কম হলে কি হবে, ঐ বয়সেই ঘোল খাইয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ প্রশাসনকে ।বরিশালের ছেলে স্বাধীনতাসংগ্রামী সুশীল স্কুলে থাকতেই গুপ্ত সংগঠন ‘যুগান্তর’ দলের সদস্য হন। সাহসী ও ডানপিটে স্বভাবের জন্য অচিরেই নেতাদের নজরে আসেন। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য সরকারের টাকা লুঠ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁর ওপর। ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে একদিন তাঁরা দলবল নিয়ে হানা দেন জেলার পুঁটিয়া ডাকঘরের জন্য আসা এক মেলভ্যানে। তাঁদের জানা ছিলো না সেদিন ভ্যানে রক্ষীর সংখ্যা ছিল অনেক।

সংঘর্ষে আহত হয়ে ধরা পড়ে যান সুশীল। বিচারে তার দশবছর কারাদণ্ড হয়, পাঠিয়ে দেয়া হলো মেদিনীপুর জেলে। সংযোগ বশত ওখানে তখন বন্দী ছিলেন বিপ্লবী দীনেশ মজুমদার। বছর খানেকের মধ্যেই জেলের উঁচু পাঁচিল ডিঙিয়ে পালালেন দীনেশ, সঙ্গী হলেন স্বাধীনতাসংগ্রামী সুশীল ও শচীন করগুপ্ত। প্রায় আটমাস পর ধরা পড়লেন সবাই, দীনেশ মজুমদার ফাঁসির মঞ্চে শহীদ হলেন। সুশীল ও শচীনের ঠাঁই হল সেলুলার জেল

সেলুলার জেলের অত্যাচার স্বাধীনতাসংগ্রামী শ্রী সুশীল দাসগুপ্ত 1932

cellular jail
https://www.independent.co.uk/

কেমন ছিলো পরাধীন দেশের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এই কারাগার? ৪.৫ বাই ২.৭ মিটার সাইজের ৬৯৩ টা কুঠুরি বা সেল নিয়ে তৈরি হয়েছিল সেলুলার জেল। হাওয়া চলাচলের জন্য পেছনের দেয়ালে ৩ মিটার উচ্চতায় ছিল শুধু একটা ঘুলঘুলি। সাতটি সারির প্রতিটি কুঠুরির দরজা ছিল সামনের সারির পেছন দিকে। ফলে কোন আবাসিকই কারো মুখ দেখতে পারতো না। সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে থাকা স্কটিশ জেলার ডেভিড বেরির স্ট্রাটেজি ছিল hunger, torture এবং isolation. নতুনদের কাছে নিজের পরিচয় দিতো, when you are here, I am your God! সত্যিই ছিল সে এক অঘোষিত ঈশ্বর।

সুশীল দাশগুপ্তকে দেওয়া হল ছোবড়া থেকে দড়ি তৈরীর কাজ। অসহ্য গরমে কাঠ ফাটা রোদ্দুরে বসে তাঁকে নারকেল ছাড়াতে হত । হাত ফেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। জল চাইলে মিলছে চাবুকের ঘা।

এটাই ছিলো ডেভিডের দাওয়াই । বন্দীদের প্রধান কাজ ছিল দুটো, নারকেল থেকে দড়ি ও তেল বের করা কিন্তু সেই কাজের কোনো হিসাব ছিল না ৷ তেলের ঘানিতে প্রত্যেককে অন্তত দুলিটার তেল বার করতে হত । বলদের বদলে ঘানি টানত বন্দীরা,ফলে ক্লান্তিতে অজ্ঞান হওয়া ছিল রোজকার ঘটনা । তাতেও রেহাই মিলতো না ।পানীয় জলের বরাদ্দ ছিল অত্যন্ত কম, খাবার হিসাবে দেওয়া হত খুদ দিয়ে তৈরী সামান্য ভাত আর বুনো ঘাস সিদ্ধ ৷

শৌচাগার বলে কিছু নেই, যার যার সেলে রাখা একটি ছোট মাটির পাত্রে মল মূত্র ত্যাগ করতে হত ৷ মশামাছির উপদ্রব বাদ দিলেও চাবুকের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত বন্দীর জন্য থাকত দড়ির জালের পোশাক যাতে ঘামে সারা পিঠে জ্বলুনি দ্বিগুন বেড়ে যায় ৷ঘানি টানা ও নারকেল থেকে তেল ও দড়ি প্রস্তুতির সময় অসহনীয় অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত কে পেতে হয়েছিল কঠিন সাজা। চাবুকের ঘায়ে ক্ষত বিক্ষত হওয়ার পর তিন দিন ও রাত তাকে হাতে পায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছিল বেরি, ফলস্বরূপ তিনি উন্মাদ হয়ে যান ।

ডেভিড বেরি চাইতো পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে কি ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত করে দেওয়া যায় , কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মনোবল তাতেও ভাঙা যায়নি কখনও ৷ বন্দীদের সাথে ভালো ব্যবহার ও পানীয় জল খাদ্য এবং শৌচাগারের দাবিতে ১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে আটজন বন্দীকে নিয়ে অনশন শুরু করলেন সুশীল।

ধীরে ধীরে এটা গণ অনশনে পরিণত হয়।প্রথমে ধমকানো চমকানো, তারপর জলের পাত্রে মেটরা দুধ রেখে দিয়ে যায়। উত্তেজিত স্বাধীনতাসংগ্রামী সুশীল পাশের সেলে বন্দী ডাক্তার নারায়ন রায়কে ( টেগার্ট খুনের চেষ্টার অভিযোগে ধৃত) চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি করবো দাদা ?

ডাক্তারবাবু উত্তর দিলেন, বরিশালে কি তোরা ফুটবল খেলতিস না ? সেল থেকে সেলে ছড়িয়ে পড়লো এই উত্তর, পরমুহূর্তেই সামনের করিডোরে দুধের বন্যা বয়ে গেল। তৃষ্ণায় বুক ফাটলেও একজনও দুধ মুখে তুললেন না ।কারারক্ষীদের সন্ত্রাস তখন চরম আকার নিল।তলব করা হলো ডাক্তার এজ কে, তার নির্দেশে রক্ষীরা এরপর একে একে বের করে নিয়ে এল অনশন কারীদের। হাত পা বেঁধে নাকে রবারের নল ঢুকিয়ে ডাক্তার রাতভর তাদের খাওয়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু এক ফোঁটাও দেহের ভেতরে প্রবেশ করাতে দিলেন না তাঁরা । দুদিনের এই নিদারুন অত্যাচারের চেষ্টাকে বিফল করে বন্দীরা ফিরে অসেন নিজের কুঠুরিতে, মুখে তখন একটাই ধ্বনি ….বন্দেমাতরম !

অত্যাচারের কবলে পড়ে ফুসফুসে দুধের মিশ্রণ ঢুকে মারা যান স্বাধীনতাসংগ্রামী মহাবীর সিং , যিনি ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত কে লাহোর থেকে পালাতে সাহায্য করেছিলেন । একই ভাবে মারা যান বিপ্লবী মোহিত মৈত্র ও মোহন কিশোর নমদাস । দুই খেপে প্রায় পঁয়তাল্লিশ দিন ধরে চলা এই অনশন আন্দোলনের পর আবাসিক দের দাবি কিছুটা মেনে নিতে বাধ্য হয় জেল কর্তৃপক্ষ। ১৯৩৭ সালে অমানবিক ব্যবহারের প্রতিবাদে আবারও তাঁরা অনশনে সামিল হয়েছিলেন।

বারবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগোর কাছে একযোগে প্রতিবাদ জানালেন মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , ফলস্বরূপ সেলুলার জেল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার ৷ কালাপানি থেকে ধীরে ধীরে বন্দী বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাঠানো হতে লাগলো ভারতের মূল ভূখন্ডে তাঁদের নিজেদের প্রদেশের জেল গুলিতে ৷ ১৮ই জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে স্বাধীনতাসংগ্রামী সুশীল দাশগুপ্তকে দেশে এনে বন্দী করে রাখা হলো প্রেসিডেন্সি জেলে। মুক্তি পেলেন ১৯৪৩ এর শুরুতেই।ছেচল্লিশের আগষ্টে কলকাতা ও নোয়াখালী সাক্ষী হল বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার। গান্ধীজীর আবেদনে অনেক সশস্ত্র সংগ্রামীর মতো স্বাধীনতাসংগ্রামী সুশীলও অস্ত্র ছেড়ে সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে ঘুরতে লাগলেন কলকাতার দাঙ্গাপ্রবণ এলাকায়। এরমধ্যেই স্বাধীন হলো দেশ, আর ঠিক তার একমাস পর……‌‌

susil dasgupta murti
https://www.banglakhabor.in

দিনটি ছিলো ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৭। পার্ক সার্কাস এলাকার কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্ত ভাবে জ্বলে উঠলো সাম্প্রদায়িক আগুন। দুপুরের দিকে সেখানে শান্তি মিছিল বের করলেন সুশীল। ধর্মোন্মাদ একদল মানুষ দা রড ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরস্ত্র সেই মিছিলের ওপর। চপারের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত বিপ্লবী মানুষটি রাস্তাতেই প্রাণ হারালেন।যাদের স্বাধীনতার জন্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা কাটিয়েছেন কালাপানি তে, তারাই কেড়ে নিলো তাঁর প্রাণ !

আটত্রিশ বছর বয়স হতে তখনো তাঁর কয়েক মাস বাকি ।জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেহ বাড়িতে এলে হতবাক হয়ে গিয়েছিল তাঁর তিনবছরের সন্তান অনুপ।তখন বুঝতে না পারলেও পরে নিশ্চয়ই আক্ষেপ করেছিলেন, এই দেশবাসীদের জন্য তাঁর বাবা জীবন দিলেন ! শ্রদ্ধাঞ্জলি নেবেন স্যার, ক্ষমা চাইবার মুখ আমাদের আর নেই !

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: অভিক মন্ডল 

https://www.banglakhabor.in/%e0%a6%9a%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a6%a8%e0%a6%a8%e0%a6%97%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%87%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%87-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%be/