কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে দেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি কেউ। একসময় ভারতভূমিতে মিথ হয়ে গিয়েছিল এই আপ্তবাক্যটি। হাতে গরম উদাহরণ প্রণব মুখোপাধ্যায়। কয়েক দশক পর সেই মিথ ভেঙেছে। আর ভেঙেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।


তিনি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে করেছেন স্বপ্ন ঘোড়ার সওয়ার। বামেরা তখন গণহত্যা, দূর্ণীতির মতো একাধিক অভিযোগে বিদ্ধ। ৩৪ বছরের শাসনের অবসান চেয়ে আম বাঙালি উদ্বেল। মমতা তাঁদের চোখে পড়িয়েছেন স্বপ্নের মায়াকাজল। কংগ্রেস, সিপিএম ছেড়ে দলে দলে মানুষ তখন যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে।


মমতা পেরেছেন। বামেদের সরিয়ে তৃণমূলকে এনেছেন ক্ষমতায়। পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের ভিত শক্ত করেছেন। কিন্তু কালের নিয়মে ভাঙন ধরেছে তাঁর ঘরেও। দূর্নীতি, কাটমানির মতো অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছে খোদ তৃণমূল। লেগেছে সারদা, নারদার মতো কলঙ্কের দাগ। ফলে তৃণমূল ছাড়ারও হিড়িক পড়ে গিয়েছে।


একসময় যে সব রাজনীতিবিদরা জোড়াফুলের ঘর আলো করে ছিলেন আজ তাঁরাই পদ্মমুখী। শুধু তাই নয়, গেরুয়া শিবিরে গিয়ে হারিয়ে যাননি তাঁরা। বরং নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দল এবং জনতাকে ভরসা যুগিয়েছেন। তৃণমূল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েও বঙ্গের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন এমন ৫ রাজনীতিবিদকে নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।

১। মুকুল রায় – তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। একসময় ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডানহাত। তৃণমূলের প্রধান রণকৌশলী। দলে মমতার পরেই ছিল তাঁর স্থান। বলা হত, মুকুল হলেন তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড। জোড়াফুলের মন্ত্রী হয়ে রেল দপ্তরও সামলেছেন। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। ২০১৭ সালে নভেম্বরে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন মুকুল। পুরনো গেরুয়া কর্মীরা মুকুলের আগমনে খুশি হননি মোটেই। তবেই মুকুল সবুর করেছেন। মেওয়া ফলেছে। বিজেপি যোগ দেওয়ার তিন বছরের মাথায় দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি।

২। অনুপম হাজরা – ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল ছেড়ে গেরুয়া শিবিরে নাম লেখান অনুপম। আর সেই ভোটে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী মিমি চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিপুল ভোটে হেরে যান। তবে দমে যাননি। মাঠে ময়দানে বিজেপিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দলকে ভরসা যুগিয়েছেন। তারই পুরষ্কার জুটেছে। ৪০ বছর ধরে বিজেপি–র সঙ্গে যুক্ত পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্য বিজেপি সভাপতি রাহুল সিনহাকে সরিয়ে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদকের পদে আসীন হয়েছেন মুকুল ঘনিষ্ঠ অনুপম। যা দলে তাঁর ওজন বৃদ্ধিরই ইঙ্গিত করে।

৩। সৌমিত্র খান – ছিলেন কংগ্রেসে। মুকুল রায়ের হাত ধরেই ২০১৪ সালে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন সৌমিত্র। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে দলীয় নেতৃত্ব ও পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে একরাশ অভিযোগের ফিরিস্তি দিয়ে দিল্লী গিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন। মুকুলের খাস লোকেদের একজন বলে পরিচিত সৌমিত্র দ্রুত গেরুয়ার শীর্ষ নেতৃত্বের আস্থাভাজন হয়েছেন। ফলস্বরূপ চলতি বছরে বিজেপির যুব মোর্চার রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।

৪। লকেট চট্টোপাধ্যায় – মমতার ঘনিষ্ট বৃত্তে যে কয়েকটি মুখ নিয়মিত দেখা যেত তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লকেট। মুখ্যমন্ত্রী প্রতি আনুগত্য দেখিয়েই পুরস্কার স্বরূপ পেয়েছিলেন রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্যপদ৷ সারদা কাণ্ডে টালমাটাল অবস্থাতেও দলের পাশেই ছিলেন তিনি৷ ২০১৫ সালে তৃণমূল ছাড়ার কারণ হিসাবে সেই ‘সারদা’কাণ্ডকেই শিখণ্ডী করেছিলেন লকেট। যাইহোক, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে হুগলি কেন্দ্র থেকে বিপুল ভোটে জিতে বুঝিয়ে দেন বিজেপিতেও তাঁর জনভিত্তি মজবুত আছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টির মহিলা শাখার সভানেত্রী তিনি।

৫। অর্জুন সিং – চার বারের বিধায়ক অর্জুন সিং ছিলেন তৃণমূলের অন্যতম শক্তিশালী নেতা। সামগ্রিকভাবে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে তাঁর দাপট প্রশ্নাতীত। এছাড়াও দলের হিন্দিভাষী নেতা হিসাবেও বরাবর প্রথম সারিতে থেকেছেন অর্জুন। কিন্তু ২০১৯ লোকসভা ভোটের টিকিট না পেয়ে বিজেপিতে যোগ দেন। সাংবাদিকদের বলেন, ৩০ বছর ধরে মমতার সঙ্গে কাজ করলেও পুলওয়ামাকাণ্ডের পর তৃণমূল সুপ্রিমোর অবস্থান তিনি মেনে নিতে পারেননি। দেশের স্বার্থে তাই তিনি মোদীর দলে যোগ দিলেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে অর্জুন জানান, তৃণমূল এখন মা-মাটি-মানুষের দল থেকে ‘মানি-মানি-মানি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।