পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোট 2021 এর দামামা  বাজলো

চারিদিকে যুদ্ধের ঘন্টার ন্যায় আগামী বিধানসভা ভোটের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে,  যেটা হয়নি সেটা বলাটা যেমন কঠিন তেমনই তারই আভাস পাওয়া যায় নানা ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে। কিন্তু এই সকল জিনিসই উলটপালট হয়ে যায় ভোটের কয়েকটা দিন আগেই,  সে ক্ষেত্রে বিচার-বিবেচনা পর্যালোচনা অনেক দূর যাওয়া বাকি। সেই জন্য এই কঠিন কাজটি করব অবশ্যই সঠিক সময়ে তার আগে দেখে নেওয়া যাক গত বিধানসভার ফলাফল কি হয়েছিল?

২০১৬ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যের বিধানসভার ২৯৪টি আসনের বিধানসভা নির্বাচন  আয়োজিত হয় ।মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস এই নির্বাচনে পুনঃ নির্বাচিত হয়। ১৯৬২ সালের পর এই প্রথম কোনো রাজনৈতিক দল জোট না করে একক শক্তিতে ক্ষমতায় আসেন এবং ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসান ঘটায় । এই একক গরিষ্ঠতার পেছনে কয়েকটি কারণ ছিল।

নিশ্চিত কারনগুলি ছিল

প্রথমত, কংগ্রেস ও বামপন্থীদের বিরোধী জোট একেবারেই কাজ করেনি – নির্বাচনী অঙ্কে তিন আর দুইয়ের যোগফল পাঁচ হয়নি, বড়জোর তিনেই আটকে গেছে।

আসলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে দুটো দল চিরকাল একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ে এসেছে – তারা ভোটের মাত্র কয়েকদিন আগে শুধু মমতাকে রোখার জন্য জোট গড়ছেন, এটা রাজ্যের মানুষ মেনে নিতে পারেননি। আর সে কারণেই ভোট ট্রান্সফার – যা এই ধরনের জোট সফল হওয়ার প্রধান শর্ত – তা মোটেই ঠিকঠাক কাজ করেনি।

অর্থাৎ কিনা যেখানে জোটের হয়ে সিপিআইএম প্রার্থী লড়েছেন, সেখানে কংগ্রেস সমর্থকরা তাকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভোট দেননি – এবং কংগ্রেস প্রার্থীর ক্ষেত্রেও তিনি সিপিএম ভোটের পুরোটা পাননি। জোটটা যে মসৃণভাবে দানাই বাঁধেনি, সেটা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম ফলপ্রকাশের মাত্র কয়েক ঘণ্টার ভেতর অভিযোগের সুরে বলেন, ‘কংগ্রেসের লোকজন তো আমাদের ভোটই দেননি!’

মমতা ব্যানার্জির সাফল্যের আর একটা বড় কারণ রাজ্যের মুসলিমরা প্রবলভাবেই তৃণমূলের পাশে থেকেছেন – যে কারণে মুর্শিদাবাদ, মালদা বা উত্তর দিনাজপুরের মতো নতুন নতুন এলাকাতেও তৃণমূল পায়ের তলায় জমি খুঁজে পেয়েছে। ২০১১তে তৃণমূল যখন ক্ষমতায় এসেছিল, রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজের সমর্থন তার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করা হয়। তারপর মুসলিম সমাজের একেবারে আশাভঙ্গ হয়নি তা বলা যাবে না, কিন্তু মমতার ওপর তাদের আস্থা এখনও যে অটুট আছে সেটা ভোটের ফলেই প্রমাণ হয়ে গেছে।

সব কেন্দ্রে আমাকেই প্রার্থী ভেবে ভোট দিন’ – গোটা রাজ্য জুড়ে মমতা ব্যানার্জির এই আবেদন ভীষণভাবে কাজে দিয়েছে।

বিশেষ করে এটা আরও বেশি বোঝা যাচ্ছে মুর্শিদাবাদ বা মালদার ফল থেকে – রাজ্যের মুসলিম-প্রধান যে দুটো জেলাতে এতদিন তৃণমূল বিশেষ দাঁত ফোটাতে পারেনি। কংগ্রেসের গড় বলে পরিচিত এই দুই জেলাতেও তৃণমূল বেশ ভাল ফল করেছে – তাদের আসনসংখ্যা খুব একটা না-বাড়লেও শতকরা ভোটের হার অনেকটাই বেড়েছে।

তৃতীয়ত, তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মানুষ তেমন গুরুত্ব দেননি। গোপন ক্যামেরায় নেতাদের টাকার বান্ডিল নেওয়ার ছবি গ্রামবাংলায় তো নয়ই, শহরেও তেমন প্রভাব ফেলেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল – গ্রামে না-হোক, শহরের শিক্ষিত সমাজ তৃণমূল নেতাদের টাকা নেওয়ার দৃশ্য বিরূপ প্রভাব ফেলবে – কিন্তু দেখা গেল সেই নারদ স্টিং অপারেশনের কথা ভেবে মানুষ ভোট দেননি।

শুভেন্দু অধিকারীর মতো ডাকসাইটে তৃণমূল নেতা, যাকে সেই স্টিং অপারেশনে টাকা নিতে দেখা গেছে, তিনিও কিন্তু নিজের কেন্দ্র থেকে রেকর্ড ভোটে জিতেছেন।

আসলে ‘সব কেন্দ্রে আমাকেই প্রার্থী ভেবে ভোট দিন’ – গোটা রাজ্য জুড়ে মমতা ব্যানার্জির এই আবেদন ভীষণভাবে কাজে দিয়েছে। মানুষ শেষ পর্যন্ত তার নিজের কেন্দ্রের প্রার্থীর দোষগুণ দেখে নয়, মমতা ব্যানার্জিকে দেখেই ভোট দিয়েছেন, তার উন্নয়নের কর্মসূচীতে সিলমোহর দিয়েছেন। ‘তৃণমূলে আসলে একটাই পোস্ট, বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট’ বলে বিরোধীরা তা নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি করেছেন – কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে ব্যক্তি মমতা ব্যানার্জির সেই দুর্নীতিমুক্ত ভাবমূর্তি, কাজপাগল সাদামাটা জীবনযাপনের ইমেজটাই তৃণমূলকে ভোটে উতরে দিয়েছে।

গ্রামবাংলায় কন্যাশ্রী বা সবুজ সাথীর মতো প্রকল্প – যাতে গ্রামের অবিবাহিত মেয়েরা আর্থিক অনুদান পেয়েছেন, স্কুলের ছেলেমেয়েরা বিনা পয়সায় সাইকেল পেয়েছেন – কিংবা সরকারি হাসপাতালের ফেয়ার প্রাইস শপে অনেক কম দামে ওষুধ কিনতে পেরেছেন – এই সব প্রকল্পেরও সুফল পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।

পশ্চিমবঙ্গে এবারের ভোটে মূল প্রশ্ন ছিল ‘পরিবর্তন টু’ না কি প্রত্যাবর্তন ? অর্থাৎ পাঁচ বছরের মধ্যে রাজ্যে আরও একবার ক্ষমতার পালাবদল, না কি মসনদে ফের মমতাই? ভোটের ফলে স্পষ্ট, প্রত্যাবর্তনের পক্ষেই রায় দিয়েছ পশ্চিমবঙ্গ। বোঝা যাচ্ছে, সাড়ে তিন দশকের বামপন্থী শাসনের অবসান ঘটিয়ে যিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন তার ওপর এত তাড়াতাড়ি মানুষ ভরসা হারাতে রাজি নয় ।

এখন দেখার ২০২১ এই ম্যাজিক কাজ করে কিনা কারণ  রাজনীতির খাতে অনেক জল বয়ে গেছে সঙ্গে যোগ হয়েছে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা শাসক শ্রেণীর কাজের মূল্যায়ন চরম প্রকাশে এসে গেছে ।তারপর তো করোনা এখন নতুন সংযোজন ।মানুষের ভোগান্তির কারণ কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয় ।